Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Face Recognition

নাগরিকের উপর নজরদারি

সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপই কিন্তু আইনমাফিক করা হয়েছে। ঘটনাচক্রে প্রতিটি আইনই ঔপনিবেশিক আমলের আইন, কিংবা তার আদলে তৈরি নতুন আইন। এখানেই সংশয়।

A Photograph representing Facial Recognition

নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশ করতে সকলের ‘ফেশিয়াল রেকগনিশন’ অর্থাৎ মুখের ছবি দিয়ে চিনতে পারার প্রযুক্তি চালু হবে, তাই এই ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। প্রতীকী ছবি।

সুমন সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৬:১২
Share: Save:

আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন হবে। যদিও এখনও কেন্দ্রীয় সরকার কোনও স্পষ্ট তারিখ দেয়নি, কিন্তু সেই নতুন ভবনের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিয়ে সরকার ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। বলা হয়েছে, নতুন সংসদ ভবনে আয়োজিত প্রথম সংসদীয় অধিবেশন থেকেই সমস্ত সরকারি কর্মী, সাংসদ, মন্ত্রী, আমলাদের গলায় থাকবে স্মার্ট কার্ড ভিত্তিক সচিত্র পরিচয়পত্র। এই পরিচয়পত্রের মধ্যে থাকা মাইক্রোচিপে সংরক্ষিত থাকবে সেই ব্যক্তির সমস্ত তথ্য। সরকারের খবর অনুযায়ী, সেই মর্মে পার্লামেন্ট সিকিয়োরিটি সার্ভিসের তরফে, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের সমস্ত সাংসদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাঁদের প্রত্যেকের বায়োমেট্রিক্স-সহ যাবতীয় তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে।

এখানেই শুরু হয়েছে একটা বিতর্ক। জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় তো সরকারের ঘরে তাঁরা সমস্ত তথ্য জমা করেছেন, তার পরে মানুষ তাঁদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছেন, তা হলে আবার নতুন কী তথ্য জমা দেওয়ার কথা বলছে সরকার? যে চিঠি পাঠানো হয়েছে সমস্ত সাংসদের কাছে, তাতে বলা হয়েছে, নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশ করতে সকলের ‘ফেশিয়াল রেকগনিশন’ অর্থাৎ মুখের ছবি দিয়ে চিনতে পারার প্রযুক্তি চালু হবে, তাই এই ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন, এই পদ্ধতিতে তো অপরাধীদের শনাক্তকরণ করা হয়, এই পদ্ধতি কি নির্বাচিত সাংসদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে?

নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার নাম করে, নাগরিকদেরকেই নজরবন্দি করার এই পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ স্বাভাবিক। ১৯৪৭ সালের পর থেকে আজ অবধি স্বরাষ্ট্র দফতর প্রত্যেক বছর একটি বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে যেন স্পষ্ট, ক্রমাগতই এই দেশ নজরদার রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়েছে। দেশের মধ্যে কোথাও কোনও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’ মাথাচাড়া দেয় না যেন, এটাই প্রধান লক্ষ্য, তাই এত নজরদারির প্রয়োজন। তবে কিনা, পৃথিবী পাল্টেছে, রাষ্ট্রবিরোধিতার ধরনও পাল্টেছে, এখন প্রযুক্তির দৌলতে এই প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়েছে। এবং নজরদারির পরিসরও ব্যাপ্ত হতে হতে সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে।

লক্ষণীয়, সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপই কিন্তু আইনমাফিক করা হয়েছে। এবং ঘটনাচক্রে প্রতিটি আইনই ঔপনিবেশিক আমলের আইন, কিংবা তার আদলে তৈরি নতুন আইন। এখানেই সংশয়। রাষ্ট্রের চরিত্র কি তা হলে স্বাধীন দেশে পাল্টানোর কথা ছিল না?

আরও লক্ষণীয়, অধিকাংশ আইন কয়েক দশকের পুরনো। অর্থাৎ আজকে ভারতের নাগরিকরা যে আতঙ্কিত হচ্ছেন, ভারত ক্রমশ নজরদারি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, তার শিকড় কিন্তু প্রোথিত ছিল কংগ্রেসের শাসনকালেই। তবে কিনা, আজকের সময়ে সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে যে নতুন যোগাযোগ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তার জন্য, এবং তার মাধ্যমে নাগরিকের উপর রাষ্ট্রের এই নজরদারির প্রক্রিয়া আরও অনেক গুণ শক্তিশালী হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফ থেকে একটি বিজ্ঞাপনে কোনও ব্যক্তি সমাজমাধ্যমে কী লিখছেন, তা সরকারবিরোধী কি না, তা নজরে রাখার জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত হয়েছে। এক জন নাগরিককে তাঁরই সহনাগরিকের উপর নজর রাখার জন্যেই এই ব্যবস্থা অবশ্যই এ দেশে নতুন। আজকের কেন্দ্রীয় শাসক দলের সংখ্যাগুরু প্রতিনিধিরা যে সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষজন কী পরছেন, কী খাচ্ছেন, কী লিখছেন, কী বলছেন, সে দিকে নজর রাখছেন, তার শিকড়ও কিন্তু বেশ গভীরে, এবং সেটাও হচ্ছে সরাসরি রাষ্ট্রের মদতেই।

২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার বিজেপি সরকার আসার পর দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অমিত শাহ ইউএপিএ অর্থাৎ আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্টকে আরও কড়া করে তোলার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, বন্দুক এখন সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় না, বন্দুকের নল এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস নয়। বরং যাঁরা এই ধারণাগুলোকে তৈরি করেন এবং ছড়ান, তাঁরাই আসল সন্ত্রাসবাদী, তাই তাঁদের যদি চিহ্নিত করার চেষ্টা এই ইউএপিএ-র সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে আনা হয়, তা হলেনিশ্চিত দেশের সংসদের সদস্যরা বিরোধিতা করবেন না।

উল্লেখ্য যে, কোনও সাংসদ তেমন ভাবে এর বিরোধিতা করেননি। গুজরাত নির্বাচনের প্রাক্কালেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এই মুহূর্তে ভারতকে বন্দুকধারী নকশালপন্থা এবং কলমধারী নকশালপন্থা, দুটোকেই পরাস্ত করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনে ৫জি প্রযুক্তি, মুখ দেখে চেনা, ড্রোন প্রযুক্তিরও সাহায্য নিতে হবে। যে সময়ে উনি এটা বলছেন, তার মধ্যেই দেশের নানা রাজ্যে এই কাজ শুরু করে দিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মানুষের মুখের ছবি নেওয়া হচ্ছে, তাঁর পূর্বতন কোনও অপরাধের তথ্য থাকলে, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।

কে জানে, এর পর হয়তো আসবে ডিএনএ বিল, ব্যক্তি মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ করা হবে। প্রতিটি ব্যক্তি মানুষকে ধরে নেওয়া হবে, তিনি এক জন সম্ভাব্য অপরাধী। আজকে সাংসদদের বলা হচ্ছে, তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য এবং বায়োমেট্রিক্স জমা করতে। তবে আগে বেশ কিছু রাজ্যে যখন এই ‘মুখের ছবি’ তুলে রাখার প্রক্রিয়া চলছিল— সেগুলোওতো এই একই নজরদারিরই অঙ্গ। বিনা দোষে নাগরিকের উপর এতখানি নজর রাখার প্রয়োজনটা কী? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। শাসক এখন নাগরিকের সার্বিক নজরদার— এটাই স্বাভাবিক বলে স্বীকৃত।

আরও একটা কথা। শাসকপক্ষ যে কাজ করছে, তাকে থামানোর ক্ষমতা সব সময় হয়তো বিরোধীদের থাকে না। কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা, নাগরিক পরিসরে সেই সব বিতর্ক ছড়িয়ে দেওয়া: এগুলো কিন্তু গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনীতিকদেরই কাজ। কত জন বিরোধী নেতানেত্রী সে কথা মনে রাখেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE