—প্রতীকী চিত্র।
দেশে আকালের সন্ধান করেছি, মারণবীজ বুনেছি। কলকাতা ছেয়ে গেছে মশকবাহিত রোগে। আমরা ভয়ে কাঁটা হয়ে অপেক্ষা করছি। অতিমারির সময় অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজে প্যানিক করেছি, এ কথা জেনে যে এই আওয়াজ বদলে যেতে পারে শববাহী গাড়ির ভবিতব্যে। অতিমারি প্রশমিত, তবু এখনও চলছে ভয়ের দুনিয়াদারি।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় ডমরুর বন্ধুবর শঙ্কর ঘোষ বলেছিলেন, হাতি আসলে একটি মশার প্রজাতি, মশার যেমন শুঁড় আছে হাতিরও আছে, কেবল হাতি গাছপালা খায়, রক্ত খায় না, কারণ তা হলে পৃথিবীতে আর কোনও প্রাণী অবশিষ্ট থাকত না। হাতির দরকার পড়ছে কই? মশাতেই সেই সঙ্কট এনে দিতে পারছে।
ইতিমধ্যেই ভিয়েতনাম থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছে, রাসায়নিক লাগানো বিশেষ এক ধরনের মশারি, তা বিলি করছে কলকাতা পুরসভা। পতঙ্গ বিশারদরা বলছেন এই মশারি হল এলএলআইএন, লং লাস্টিং ইনসেক্টিসাইডাল নেট। এই মশারির সুতো যখন তৈরি হয়, তখনই নাকি তাতে মিশিয়ে দেওয়া হয় ডেল্টামেথ্রিন নামক এক কীটনাশক। ফলে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি রোগের মশা এসে এই মশারিতে বসলেই তারা মারা পড়ে। ডাক্তাররা কেবল রাতে নয়, দিনের বেলাতেও ঘরের মধ্যে এই মশারি ঝুলিয়ে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন।
ডেঙ্গির ইতিহাস ঘাঁটলে চিত্তাকর্ষক সব তথ্য মেলে। ১২৭৯ বঙ্গাব্দে মহেশচন্দ্র দাস প্রণীত ডেঙ্গু জ্বরের পাঁচালী পুঁথিটি প্রকাশ করেছিলেন আই সি চন্দ্র এ- ব্রাদার, মুদ্রক ছিলেন অধর চন্দ্র চক্রবর্তী, দাম ছিল এক আনা। বইটিতে আছে, “মন্দ কর্ম কল্লে পরে, ডেঙ্গু ধরিবে তাহারে, বলে ভাই একি কাণ্ড জগত জুড়ে হোল, কেহ কেহ ব্ল্যাক ফিবরেতে প্রাণে মলো”। এক সময় ডেঙ্গি এমন বেড়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথদের জোড়াসাঁকো থেকে উঠে যেতে হয়েছিল পানিহাটির বাগানবাড়িতে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ হল সাহেবদের ষড়যন্ত্র, আমাদের দেশের বেশির ভাগ নদের ঢাল যে দিকে, তার উল্টো দিক বরাবর রেল লাইন পাতার ফলেই তৈরি হয়েছে বাঘবন্দি খেলার মতো খোপ, সেই খোপে নিস্তরঙ্গ জলরাশি জমেই এই মশক রোগ। তবে ব্রিটিশ, নেহরু বা সরকারের উপরে কি আর সব দোষ ঢেলে দেওয়া যায়? নাগরিকের কি কেবলই কর্তব্য পাঁচ বচ্ছর অন্তর আঙুলে বেগুনি রশ্মি লাগিয়ে নিজস্বী তোলা? আমরাই তো সব জেনেবুঝে স্মার্ট সিটির কাঁচা নালা সিমেন্ট বাঁধিয়েছি— মাটি আর বালি যে নিজের নিয়মে শুষে নিত নোংরা জল, ভূপৃষ্ঠ ছাঁকনিতে রয়ে যেত আবর্জনা, তার শেষ দেখে ছেড়েছি। এক ধাপায় রক্ষা নেই, শহরে গড়ে উঠছে নোংরার পাহাড়। নবীন ভঙ্গিল পর্বতের মতো বছর বছর স্তূপাকৃতি হচ্ছে প্লাস্টিক, লোহালক্কড়, ডিসপোজ়েবল সিরিঞ্জ, স্যানিটারি প্যাড। এই শহর শালিখ চড়ুই বিবর্জিত, কেবল কতকগুলি ক্লান্ত কাক উড়ে বেড়ায় মধ্য আকাশে। দায় আমাদেরও। মুখ ঢেকে যায় ডাস্টবিনে ।
সবুজ বিপ্লবের পর থেকে যে হেমলক দেওয়া শুরু হল কৃষিক্ষেত্রে তাতে পঙ্গপাল নিকাশ হল ঠিকই, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তপ্রায় হল ব্যাঙ আর গাপ্পি মাছ, যাদের প্রধান খাদ্য ছিল মশার লার্ভা। একটি ডেঙ্গি রোগের মশার প্রাণ গড়ে এক মাস, সেখানে একটি মানুষ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে বেঁচে থাকে ন’শো ষাট মাস, ফলে এই বিপুল সময়ে মশা নিজেকে অভিযোজিত করবে বহু বার, জিন পরিবর্তিত হবে, ফলে কামান দেগে কোন লাভ হবে না ।
এক সময় মহাশহরের দম্ভ হেরেছিল ইঁদুরের কাছে, প্লেগ ছড়িয়ে গিয়েছিল শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ’পরে। ফরাসি সাম্রাজ্যে এমন অবস্থা হয়েছিল যে তারা ইঁদুরের মাথার দাম ধার্য করেছিল, আর অন্য দিকে নেটিভ কালো মানুষেরা ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরত। ইঁদুরে মানুষে মিলে সে বার মুক্তি সংগ্রামে পরাস্ত করেছিল ফরাসিদের আলজিরিয়ার মাটিতে। আর এই দেশে ব্যাটন গেল মশাদের হাতে। দীর্ঘস্থায়ী অসুখের জমানা পত্তন হল গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলিকাতায়। নির্ঘুম নিশ্চুপ নগরী কেবল জেগে রইল জলপট্টি হাতে।
এর শেষ কোথায়? বুলেট ট্রেনের গতিময় দুনিয়াকে ‘থেমে থাক’ বলে প্রায় দু’বছর থমকে দিয়েছিল এক মারণ ভাইরাস। তবে কি এ বার এই ভাইরাস ব্যাক্টিরিয়া আর এআই দিয়েই নতুন সাম্রাজ্য গড়া হবে? আমরা সক্কলে থেমে যাব রাজার দরবারে গান শুনে, কেবল নয়ন মেলে দেখব নির্জন সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে বেরিয়েছে লাল কাঁকড়ার দল? হরিণেরা চলে এসেছে রাজপথে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy