Advertisement
০৩ মে ২০২৪
দারিদ্র, নেশা, মৌলবাদ থেকে মুক্তির পথ চেয়ে কেটে যায় জীবন
Society

স্বপ্নপূরণ বনাম ইচ্ছাপূরণ

সাফল্যের শরীর জুড়ে যে অনেক ক্ষত, তা যখন একটা সমাজ ভুলতে বসে, তখনই নানান দিক থেকে দেখানোর দাঁতের বদলে খাওয়ার দাঁত বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

Picture of the Vaccination of women was underway in Afghanistan before the Taliban seized power.

অতীত: তালিবানরা আফগানিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার আগে মহিলাদের টিকাকরণ চলছিল। জুলাই ২০২১, কাবুল। গেটি ইমেজেস

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:২৭
Share: Save:

বিশ্বকাপ-জয়ী আর্জেন্টিনার হয়ে ফাইনালে অন্যতম গোলদাতা অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কী প্রবল পরিশ্রম তাঁর বাবা আর মা করতেন, তাঁকে ফুটবলার বানানোর জন্য। বাবার একটি ছোট কারখানা ছিল, উদয়াস্ত খাটতেন সেটাকে চালু রাখতে; মায়ের পরিশ্রম ছিল আরও বেশি। একটা সাইকেলের পিছনে ছেলেকে চাপিয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে মা পৌঁছে যেতেন ফুটবল কোচিং ক্যাম্পে। বাকিটা ইতিহাস। এখন অনায়াসে বলা যায় যে, ডি’মারিয়ার নিজের তো বটেই, ওঁর বাবা-মায়েরও স্বপ্নপূরণ হয়েছে। কিন্তু বারুইপুরের রনি, ব্যারাকপুরের চিন্টু, বরানগরের রাজা যতই নীল-সাদা জার্সি পরে পাড়ার মোড়ে আটচল্লিশ ইঞ্চি টিভি লাগিয়ে খেলা দেখুক, আর কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের পর সারা রাত ধরে শব্দবাজি ফাটিয়ে বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষদের মৃত্যুযন্ত্রণা দিক, আর্জেন্টিনার জয়ে ওদের স্বপ্নপূরণ হতে পারে না। খুব বেশি হলে যা হতে পারে তাকে বলে, ইচ্ছাপূরণ।

কেন ইচ্ছাপূরণ, কেন স্বপ্নপূরণ নয়, সেই প্রশ্নের উত্তর এক কথাতেই দেওয়া যায়— স্বপ্নপূরণের জন্য যতটা সংযোগ দরকার, আর্জেন্টিনা কিংবা তার কোনও খেলোয়াড়ের সঙ্গে রনি, চিন্টু কিংবা রাজার তা নেই।

আমাদের বাস্তববোধ আছে। ছোট থেকে শুনে আসছি, কলকাতা নাকি কচ্ছপের পিঠের মতো— তার ঢাল পূর্ব দিকে, আর সেই কারণেই পূর্ব প্রান্তের জলাজমি, ধানখেত রক্ষা করতেই হবে। নয়তো সমূহ বিপদ। কিন্তু সমষ্টির বিপদ ঠেকাতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবে কে? অতএব আনন্দপুর কিংবা মুকুন্দপুর, বাইপাসের ধারের কাঁচা মাটিতে নিত্যনতুন চব্বিশতলা অ্যাপার্টমেন্ট অথবা আটতলা প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে উঠছে। সেখানে উদয়াস্ত কাজ করছেন কত পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-মেদিনীপুর বা মালদহ-মুর্শিদাবাদের শ্রমিক। সারা দিনের খাটুনির পর চার-পাঁচশো টাকা হাতে পাওয়া যাচ্ছে; তাই নিয়ে তাঁরা ছুটে চলেছেন, লটারির দোকানের দিকে। শুধু কলকাতায় নয়, কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, সর্বত্রই একশো-দেড়শো টাকায় বিশেষ বিশেষ লটারির টিকিট কিনে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন গরিব মানুষ। কখনওসখনও তাঁদের কারও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েও। কিন্তু তার পরও কি ইচ্ছাপূরণ হয়? না কি, ছলে-বলে টাকার সিংহভাগ কেড়ে নেয় স্থানীয় কোনও স্থলদস্যু এবং তার লীলা-সহচররা?

কোথাকার জল কোথায় গড়ায়? মফস্সলেও এখন একটির বদলে পাঁচটি মদের দোকান মাথা তুলেছে। আর দীর্ঘ সর্পিল লাইনে অনন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে পনেরো থেকে পঁচিশের অজস্র ছেলেমেয়ে। চুপ! রাজস্ব আদায় চলছে। কিসের বিনিময়ে? কেউ যদি জানতে চায়, কার ইচ্ছায় এত সহজে মদের নাগাল পাচ্ছে টিনএজাররা?

উত্তর নেই। কিন্তু আরও কঠিন প্রশ্ন আছে। নেশার অলাতচক্রে জড়ালে জীবনের দফারফা হয়ে যাবে, চোদ্দো-ষোলো-আঠারোর প্রাণগুলোকে সেই কথা বোঝানোর দায়িত্ব ছিল শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই। কিন্তু তাঁদের একাংশ এখন সরকারি কৃপায় ‘উৎস’-এ ফেরার সুযোগ পেয়ে দু’হাজার ছাত্রছাত্রীর গ্রামীণ স্কুল ছেড়ে বাড়ির কাছাকাছি (পড়ুন, কলকাতায়) আসতে মরিয়া। দেড়শো জনের ক্লাস ছেড়ে যিনি শহরের ধুঁকতে থাকা সরকারি স্কুলের পাঁচ জনের ক্লাসে এসে ‘আগে কী হয়েছিল’ খোঁজ নেবেন, ছাত্রছাত্রীরা তাঁর থেকে স্বপ্নপূরণ করার কোন লড়াই শিখবে? বরং, ঝড় উঠলে নৌকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাই উস্কে দেবেন না কি তিনি?

সাফল্যের শরীর জুড়ে যে অনেক ক্ষত, তা যখন একটা সমাজ ভুলতে বসে, তখনই নানান দিক থেকে দেখানোর দাঁতের বদলে খাওয়ার দাঁত বেরিয়ে আসতে শুরু করে। পূর্ব থেকে পশ্চিম অথবা উত্তর থেকে দক্ষিণ— দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যতগুলো আঞ্চলিক দল আজ শক্তিশালী, সেগুলির প্রায় প্রত্যেকটির প্রতিষ্ঠাতা বা প্রতিষ্ঠাত্রী অনেক লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে উঠে এসেছেন। চরম প্রতিদ্বন্দ্বীরাও তাঁদের ‘লড়াকু’ হিসেবে জানেন এবং মানেন। কিন্তু আঞ্চলিকের পাশাপাশি পারিবারিক এই দলগুলোর পরবর্তী মুখ হিসেবে যাঁরা উঠে এলেন, তাঁরা কোনও দিন দেওয়ালে পোস্টার সেঁটেছেন, বুথে বসেছেন? কখনও ভিড় বাসে চেপেছেন? যে যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে পুলিশের লাঠি খেতে খেতে কোনও কর্মী নেতা হয়ে ওঠেন, তাঁরা কি তার বিন্দুবিসর্গ জানেন? উপরে উঠতে থাকা নাগরদোলার চেয়ারে ভাগ্য তাঁদের বসিয়ে দিয়েছে। বলেনি যে, ওই একই নাগরদোলা নীচেও নামে।

স্বপ্ন যখন দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে তখন খেয়াল হয়, কোন ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে, কোন পথে এগিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা প্রবীণ লেখক নবীন এক লেখকের সঙ্গে মিলে বিশ্বের ক্ষমতাশালী দেশগুলির কিছু রাজনীতিক তথা শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছে চিঠির পর চিঠি দিয়ে গিয়েছেন আগের বছর। সেই সব চিঠির বিষয় ছিল এই যে, তালিবান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের মেয়েদের কোভিড-প্রতিরোধী ইনজেকশন পাওয়ার আর কোনও উপায় নেই, কারণ পুরুষ কম্পাউন্ডারের হাতে নারী ইনজেকশন পাবে (হোক সে জীবনদায়ী), তালিবানি রাষ্ট্রে এমনটা ভাবাও গর্হিত। ওই দুই লেখক তাই আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষমতা-কাঠামোর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, যাতে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মেয়ের সঙ্গে ঘটে চলা এই বীভৎস অন্যায়ের প্রতিকারে পাশ্চাত্য সচেষ্ট হয়। আফগানিস্তানে থাকা আত্মীয়দের প্রাণনাশের ভয়ে বর্তমানে সমাজমাধ্যমে কোনও পোস্ট না-করা নবীন লেখকের থেকে জানা গেল যে, তাঁদের চিঠির কোনও উত্তর অবধি আসেনি হোয়াইট হাউস বা ডাউনিং স্ট্রিট থেকে। কয়েক জন শিল্পী-সাহিত্যিক ব্যক্তিগত স্তরে দুঃখপ্রকাশ করার পাশাপাশি নিজেদের অপারগতার কথাও জানাতে ভোলেননি।

সেই লেখক বলছিলেন যে, ট্রাম্পকে হারিয়ে জো বাইডেন যে দিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন, আর কমলা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট, আফগানিস্তানের মেয়েদের হৃদয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক মেয়ের মতোই নেচে উঠেছিল। তারা ভাবছিল যে, তাদের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। কিন্তু কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় থাকাকালীনই আমেরিকা সৈন্য তুলে নিল আফগানিস্তান থেকে; তালিবান ক্ষমতা দখলের পরে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েই ক্ষান্ত হল না, অসুস্থ হলে পরিষেবা পাওয়ার অধিকারটুকুও কেড়ে নিল, যে-হেতু চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত মানুষরাও ‘পুরুষ’ হিসেবেই চিহ্নিত।

ইরানে মেয়েদের প্রতিবাদ নিয়ে, প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যু নিয়ে, পাশ্চাত্যের মিডিয়া তোলপাড় হবে, ঝড় উঠবে ভারত কিংবা ভিয়েতনামে কোনও ঘটনা ঘটলে— কিন্তু আফগানিস্তানের এই সাংঘাতিক বর্বরতা দেখেও দেখা হবে না, কারণ ওই অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে গেলে আফগানিস্তানে সেনা পাঠাতে হবে পাশ্চাত্যকে। মানবিকতার কারণে ডলার খরচ করা একটি বাতিল ধারণা এখন। পাশ্চাত্যের প্রেস কিংবা প্রেসিডেন্ট সবাই ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’-এর মন্ত্রে বিশ্বাসী এখন। অতএব কয়েক মাস আগেই স্বপ্নপূরণের আনন্দ পাওয়া মেয়েগুলোর সামান্য বেঁচে থাকার ইচ্ছাপূরণ না হলেও ইংল্যান্ড-আমেরিকা-ফ্রান্সের থেকে পাথুরে নীরবতা ভিন্ন আর কিছুই মিলবে না।

কমিউনিস্ট শাসকদের তাড়িয়ে যারা মুক্তির স্বাদ পেতে চেয়েছিল তাদের আজ এই হাল। আর কমিউনিস্ট শাসন চেয়ে যারা জীবন বাজি রেখেছিল? মনে পড়ে যায় মিলান কুন্দেরার দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং উপন্যাসের কথা। প্রাগের একটি প্রাসাদের বারান্দা থেকে লাখো মানুষের উদ্দেশে যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন গটওয়াল্ড, তখন বরফ পড়ছে দেখে নেতার মাথায় নিজের ফার-টুপি পরিয়ে দিয়েছিলেন গটওয়াল্ডের সহযোদ্ধা ক্লেমেনটিস। পার্টির প্রচার-বিভাগ সেই ছবির লক্ষ-লক্ষ কপি করে ছড়িয়ে দিয়েছিল। বছর চারেক পরে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ক্লেমেনটিসকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তার পর পরই ওই ছবি থেকে ক্লেমেনটিস, কোনও কারিকুরিতে উবে যান একেবারে। থেকে যায় কেবল গটওয়াল্ডের মাথায় ওঁর সেই টুপি।

চেনাচেনাই লাগে। লাগবে না কেন? আমরাও তো ক্ষমতার স্বপ্নপূরণের অংশীদার হতে চেয়ে আত্ম-অবলুপ্তির ইচ্ছাপূরণ করতে থাকি অহরহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Afghanistan Iran
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE