Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
মানুষের বিশ্বাস হারালে অর্থ বা বাহুবল দলকে বাঁচাতে পারে না
SSC recruitment scam

ইতিহাস কিন্তু বড় নির্মম

২০২২-এর জুলাই মাসটি স্মরণীয় বা কলঙ্কিত হয়ে থাকবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক ইতিহাসে। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনও থাকবে ইতিহাসে।

প্রতিরোধ: মন্ত্রীর গ্রেফতারের পর শিক্ষক নিয়োগ বিষয়টির সমাধানের দাবিতে মিছিল, কলকাতা, ৩১ জুলাই।

প্রতিরোধ: মন্ত্রীর গ্রেফতারের পর শিক্ষক নিয়োগ বিষয়টির সমাধানের দাবিতে মিছিল, কলকাতা, ৩১ জুলাই। ছবি: পিটিআই

কৌশিক সেন
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২২ ০৫:০৫
Share: Save:

কলকাতা তথ্যকেন্দ্রের দোতলায় একটি সভা হয়েছিল ১৯৯০ সালে। সভার আয়োজক ছিল বামফ্রন্ট। বুদ্ধিজীবীরা একত্র হয়েছিলেন সেই দিন। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সভা ডাকার প্রয়োজনীয়তা ছিল, কারণ সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে পর পর এমন কিছু ঘটনা ঘটছিল, যা বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। জানা যায়, সেই দিন আশ্চর্যজনক ভাবে দু’-এক জন ব্যতিক্রমী মানুষ বাদ দিয়ে, উপস্থিত প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী একযোগে বলতে থাকেন যে, আসলে কোথাও কোনও ক্ষোভ নেই, সমস্যা নেই, সবটাই বামবিরোধী রটনা, পরাজিতের চিৎকার, বুর্জোয়া মানসিকতার বিকার। শোনা যায়, আর সকলের সঙ্গে অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে, প্রবল বিশ্বাসের সঙ্গে উৎপল দত্ত মহাশয়ও একই মত পোষণ করেছিলেন।

কবি শঙ্খ ঘোষও উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। একটি ক্ষুদ্র লেখা পড়েছিলেন তিনি। মন দিয়ে শুনেছিলেন নিশ্চয়ই সবাই, তবে কবির আশঙ্কার কথাগুলোকে স্বভাবতই কেউ গুরুত্ব দেননি।

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯০-এ বামফ্রন্ট আয়োজিত বুদ্ধিজীবী-সমাবেশে পঠিত, শঙ্খ ঘোষের লেখায় ঠিক কী ছিল, তা উৎসাহী পাঠককুল খুব সহজেই খুঁজে পেতে পারেন। শুধু বলতে পারি কবির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছোট্ট লেখাটিতে যা যা সতর্কবাণী ছিল, তার সব কিছুই আলোচিত ও চর্চিত হয়েছিল ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভরাডুবির পর। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগের অভাব, ভুল মানুষজনদের পার্টিতে যুক্ত করা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন। ধ্বংসের সমস্ত ইঙ্গিত ছিল। কিছু মানুষ বুঝেছিলেন। বেশির ভাগ মানুষ বোঝেননি বা বুঝতে চাননি।

আমি নিশ্চিত আজ ওই ছোট্ট লেখাটি পড়লে শাসক দলের নামগুলো একাকার হয়ে যাবে। আপনি ওই লেখাটিতে স্বচ্ছন্দে ‘বামফ্রন্ট সরকার’ নামটি সরিয়ে ‘তৃণমূল সরকার’ বসিয়ে দিতে পারেন। যে ‘বিপজ্জনক শিথিলতা এবং চেতনাহীনতা’র কথা উঠে এসেছিল কবির কথায়, যা থেকে জন্ম হয়েছিল ‘ধারাবাহিক কলঙ্কময়’ ঘটনার, সেগুলো কোনও দুর্ঘটনা বা ষড়যন্ত্র ছিল না, আজও নয়।

যে বিপুল চুরি এবং দুর্নীতির নগ্ন চেহারা প্রকাশ পেল সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে, বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল কংগ্রেস শত চেষ্টা করেও সে অপরাধকে লঘু বা চক্রান্ত বলে দেখাতে পারবে না। এক জন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষে সম্ভব নয় এত বড় একটা দুর্নীতি করা। এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে তাদের নিজেদের সংগঠনেরই অন্দরে।

২০২২-এর জুলাই মাসটি স্মরণীয় বা কলঙ্কিত হয়ে থাকবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক ইতিহাসে। পাঁচশো দিন অতিক্রান্ত করা নবম থেকে দ্বাদশের শিক্ষাপদ-প্রার্থীদের আন্দোলনও থাকবে ইতিহাসে। তাঁদের বঞ্চনা ও লড়াইকে সামনে রেখে গড়ে উঠবে আরও বহু প্রশ্ন এবং আন্দোলন। যাঁরা এই কুৎসিত দুর্নীতির জন্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তাঁরা ছাড়াও ভেবে দেখা প্রয়োজন আরও কত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম আমরা সবাই। এ ফ্ল্যাট-ও ফ্ল্যাট ঘুরে পশ্চিমবঙ্গে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করছে, এবং তাঁদের আধিকারিকদের পেশাদারিত্ব ও নৈপুণ্যের প্রতি সমস্ত রকম অভিনন্দন জ্ঞাপন করেও এ কথা পুনরায় আমাদের স্মরণ করতেই হবে যে, ভারতবর্ষে ভারতীয় জনতা পার্টি ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দল, ইডি-র এই বিপুল ক্ষমতা ও আধিপত্যে স্বস্তিতে নেই। শীর্ষ আদালতের রায় দানে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে দুশ্চিন্তা নিশ্চিত ভাবে বৃদ্ধি পাবে। কারণ সবাই জানেন, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে বিজেপি দেশের বিরোধীদের স্তব্ধ করতে কী ভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম। ঠিক এইখানেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি বিরোধী, উগ্র হিন্দুত্ব বিরোধী আন্দোলনকে অনেকটা পিছিয়ে দিল। সত্যি-মিথ্যের ভিতর যে ধোঁয়াশাটা তৈরি হল, তার আড়ালে বসে দেশের শাসক দল, যারা সংবিধানকে মান্যতা দেয় না, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে যারা প্রকাশ্যে শেষ করে দেওয়ার হুমকি দেয়, বেছে বেছে তালিকা তৈরি করে যারা তাঁদের বাসস্থান ও সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দেয় বুলডোজ়ার দিয়ে, সেই শাসক দলকে পায়ের তলায় শক্ত জমি পেতে সাহায্য করল পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনা।

‘বিজেপিকে একটি ভোটও না’, স্লোগান তুলে গত বিধানসভা নির্বাচনে আমরা বহু মানুষ প্রকাশ্যে কথা বলেছিলাম। তৃণমূল নেতৃত্ব ও তাঁদের কর্মীদের নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রতি সমস্ত রকম শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সমাজের যে অরাজনৈতিক অংশটি ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বগ্রাসী চেহারাটার বিরুদ্ধে তাদের মতো করেই রুখে দাঁড়িয়েছিল, এই দুর্নীতি তাদের প্রতিও এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।

লক্ষ করার বিষয়, তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু তাদের রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসাব কষে সংসদে এবং সংসদের বাইরে ইচ্ছেমতো ঘুঁটি সাজিয়েছে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো পরাজিত বিজেপি প্রার্থীদের সাদরে ফিরিয়ে নিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল কাকে দলে গ্রহণ বা বর্জন করবে, তা সেই দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত, কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। শুধুমাত্র কিছু রাজনৈতিক দলের গদি দখলের লড়াই হিসেবে আমরা অনেকেই এটাকে দেখিনি। দলীয় রাজনৈতিক রঙের বাইরে বেরিয়ে নাগরিক সমাজ সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো একটি মতাদর্শের বিরুদ্ধে যে যার সাধ্যমতো গান বেঁধেছিল, কবিতা লিখেছিল, থিয়েটার করেছিল, শহর-গ্রামে প্রচার করেছিল, সেই অসংখ্য মানুষের বিশ্বাসে গভীর আঘাত করেছে এই দুর্নীতি। শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করে দায় ঝেড়ে ফেলা সম্ভব নয়।

এই দেশে এখন বুকটান করে নাথুরাম গডসের স্তুতি হয়। চলতি বছরের আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে, ভারতবর্ষ রয়েছে শেষ ৩০টি দেশের মধ্যে। মোদী সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার সমস্ত উপায় অবলম্বন করেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নিয়ে যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে তারা নাগরিক সমাজকে অনেক বেশি সন্দেহের চোখে দেখে। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতায় দীর্ণ, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে দিশেহারা, কেউ ক্ষমতার লোভে জ্ঞানশূন্য অথবা এই তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আশা জাগিয়েও এতটাই দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত যে, তারা যদি নিজেদের অভাবনীয় বদল না ঘটায়, তা হলে এরাই যে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বুকটান করে লড়াই করতে পারবে, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন।

সংসদীয় গণতন্ত্রে সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই অভিপ্রায় থাকে, যত দিন সম্ভব গদি আঁকড়ে থাকা। তৃণমূল কংগ্রেস টানা তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী। তাও বিভিন্ন উপনির্বাচনে, বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এবং সম্প্রতি পুরসভা নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে পেশিশক্তির দ্বারা দমিয়ে রাখার প্রয়াস গভীর আশঙ্কা তৈরি করে। অথচ চোখের সামনেই তো উদাহরণ রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, সেই সিপিআই (এম) এবং বামফ্রন্ট এক প্রবল ক্ষমতার চূড়া থেকে কী অতলস্পর্শী শূন্যতায় নেমে এসেছিল। শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে কোনও দিন কোনও রাজনৈতিক দল বেশি দিন তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে না। মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে গেলে, অর্থ বা বাহুবল কোনও কিছুই একটি রাজনৈতিক দলকে বাঁচাতে পারবে না। তৃণমূল কংগ্রেসও কোনও ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাস বড় নির্মম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

SSC recruitment scam TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE