Advertisement
২৬ মার্চ ২০২৩
indian politics

স্বচ্ছ ভারত, অস্বচ্ছ পার্টি

রাজনৈতিক দলের আরও কিছু বিশেষত্ব আছে। বিদেশি টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের নানা কড়াকড়ি আছে, যা সরকারি বা অসরকারি, সব সংস্থাকে মানতে হয়।

Representational image of Politics.

ভারতে গণতন্ত্রের দশা নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা অনেক চিন্তা, মতামত প্রকাশ করেন। প্রতীকী ছবি।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:১৮
Share: Save:

বিশালাকার ভারতীয় সংবিধানে ‘রাজনৈতিক দল’ বিষয়ে একটি কথাও নেই, এটা শুনতে একটু আশ্চর্য লাগে না? ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনেও প্রায় চার দশক— ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক দল নিয়ে একটা কথাও ছিল না। আজ ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির অন্দরমহলটা কেমন? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কিছু বিস্ময়কর তথ্য উঠে আসে। ভারতে একমাত্র রাজনৈতিক দলই এমন এক প্রতিষ্ঠান, যার কোনও স্বতন্ত্র অডিট হয় না। রাজনৈতিক দলের অডিট কে করবে, সে সম্পর্কে কোনও আইন বা নির্দেশিকা নেই। অনেক রাজনৈতিক দলের অডিট করেন দলের কর্মীরাই, এবং কোনও দলকেই অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করতে হয় না। এমনকি দলের সদস্যরাও সেই রিপোর্ট দেখতে পান না। দেশের সমস্ত সরকারি-বেসরকারি, লাভদায়ক বা অলাভদায়ক সংস্থার অডিট করে স্বীকৃত অডিট সংস্থা, এবং সেই অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে থাকে। ব্যতিক্রম রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশন কয়েক দশক ধরে সরকারকে বলছে, আইন এনে কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা ‘ক্যাগ’ অনুমোদিত কোনও অডিট সংস্থাকে দিয়ে রাজনৈতিক দলের অডিট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে। কোনও রাজনৈতিক দল তাতে রাজি নয়, তাই ব্যবস্থা সেই তিমিরেই আছে।

Advertisement

রাজনৈতিক দলের আরও কিছু বিশেষত্ব আছে। বিদেশি টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের নানা কড়াকড়ি আছে, যা সরকারি বা অসরকারি, সব সংস্থাকে মানতে হয়। ব্যতিক্রম রাজনৈতিক দল। তারা শুধু যে অন্তহীন বিদেশি টাকা নিতে পারে তা-ই নয়, কোথা থেকে সে টাকা এল, কে দিল, কাউকে জানানোর দরকার হয় না। ভারতে এই পথে আন্তর্জাতিক মাদক, অস্ত্র বা সন্ত্রাস চক্রের টাকা আসছে কি না, জানার উপায় নাগরিকের নেই। এমনকি সত্তর দশক থেকে কত বিদেশি টাকা কোন দলে এসেছে, সে প্রশ্নও কেউ করতে পারেন না।

ভারতে গণতন্ত্রের দশা নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা অনেক চিন্তা, মতামত প্রকাশ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাংগঠনিক গণতন্ত্রের বালাই নেই বললেই চলে। প্রার্থী চয়নের জন্যও দলে নির্বাচন বা মনোনয়নের দরকার নেই। প্রায় সব দলেরই প্রার্থী ঠিক হয় নেতাদের বদান্যতায়, তাই প্রার্থীদের মধ্যে অপরাধে অভিযুক্তদের এত বেশি দেখা যায়। নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনী সংস্কার কমিটিগুলি সুপারিশ করেছে, গুরুতর অপরাধে চার্জশিট হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে, অন্তত তাদের প্রার্থী যেন না করা হয়। এ সব সুপারিশে কোনও সরকার বা রাজনৈতিক দল কান দেয়নি।

সাধারণ মানুষ দলের কাছে তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে তথ্য চাইতে পারেন না। ২০১৩’য় কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন রায় দিয়েছিল যে, দলগুলি তথ্য জানার অধিকারের আইনের আওতায় পড়ে। সেই রায় কোনও রাজনৈতিক দল মানেনি, রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনও করেনি। অবশ্য ২০১৯ সালে সেই তথ্য কমিশনই রায় দিয়েছে, রাজনৈতিক দলের টাকা-সংক্রান্ত তথ্য জনতার জানার অধিকার নেই।

Advertisement

অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই জেলা-ভিত্তিক, শহর-ভিত্তিক কোনও সদস্য তালিকা নেই। ভারতে এক জন ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রায় সব দলের সদস্য হতে পারেন, চাঁদা দিলেই হল। নির্বাচনের সময়ে, বা দলের মধ্যে নির্বাচনের কোনও পর্ব অভিনীত হলে তখন সদস্য গ্রহণ করা হয়, কিন্তু প্রায় কোনও রাজনৈতিক দলই সদস্য রেজিস্টার নিয়মিত ভাবে রক্ষা করে না। রাজনৈতিক দলগুলি চাকরিতে, শিক্ষায়, পঞ্চায়েতে আসন সংরক্ষণ নিয়ে সরব, কিন্তু দলের মধ্যে সংরক্ষণ? সে প্রথা কারও নেই। দরিদ্র, নিম্নবর্ণ, মহিলারা প্রায় সব দলেই প্রান্তিক। লোকসভা, বিধানসভায় জাতভিত্তিক সমতার দাবিতে মুখর দলগুলির মধ্যে ক’টি নিপীড়িত জাতির প্রতিনিধিত্ব আছে খুঁজে দেখা যেতে পারে। নির্বাচিত বিধায়ক, সাংসদরাই বা তাঁদের নিজস্ব মত কতটা প্রকাশ করতে পারেন? উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়, জনকল্যাণ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ সামান্য। তাঁরা শুধুই দলীয় নেতৃত্বের আজ্ঞাবহ। অনির্বাচিত দলীয় নেতাদের থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধির মত যদি আলাদা বলে সামনে আসে, তা হলে বহু ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিকে সাসপেন্ড করে দল।

কথাগুলি গুরুত্বপূর্ণ। এক, আজ যে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ‘পারিবারিক’ বা ‘গুরুবাদী’ সংস্থা হয়ে উঠেছে, তার জন্য দলের গঠনতন্ত্রের এই গলদগুলি দায়ী। দলের অন্দরমহল যদি এত অস্বচ্ছ হয়, তা হলে সদস্যদের চাইতে পরিবার বেশি গুরুত্ব পেতে বাধ্য। দুই, দলের কাজকর্ম অগণতান্ত্রিক হলে দল গণতন্ত্রের আদর্শ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য। তিন, ভারতীয় রাজনীতির যে সর্বাঙ্গীণ ক্ষয়, তার জন্যেও ভারতীয় পার্টিব্যবস্থার এই গলদগুলি দায়ী। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে হারা-জেতায় সীমাবদ্ধ। সদস্যদের কাছে, প্রতিনিধিদের কাছে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করে না। নির্বাচনী সাফল্যের জন্য তারা শক্তিশালী ভক্তসমাজ চায়, শক্তিশালী জনসমাজ নয়।

উন্নয়নবিদ্যা বিভাগ, আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.