Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Heat Wave

তাপপ্রবাহের উৎসসন্ধানে

পৃথিবী জুড়েই উষ্ণায়নের যে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল, সেটাই হাতে-গরম টের পাচ্ছে দেশের মানুষ। গত কয়েক বছর ধরেই দেশের মেগাসিটিগুলিতে উত্তাপের বহর বাড়ছিল হুহু করে।

summer.

দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি, তখন তেতে ওঠা নির্মাণ কাঠামোর উষ্ণতা তার দেড় থেকে দু’গুণ বেশি। ফাইল চিত্র।

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৭
Share: Save:

গায়ে আঁটা গরম জামা, পুড়ে পিঠ হচ্ছে ঝামা/ রাজা বলে ‘বৃষ্টি নামা— নইলে কিচ্ছু মিলছে না।’— শুধু আবোল তাবোল-এর সেই রাজা নয়, এখন কোচবিহার থেকে কলকাতায় রাজা থেকে প্রজা সকলেরই এক বাক্যি। তীব্র তাপপ্রবাহে রাজ্যের ইস্কুল কলেজ থেকে শুরু করে সরকারি অফিসে তালা ঝোলানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। পৃথিবী জুড়েই উষ্ণায়নের যে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল, সেটাই হাতে-গরম টের পাচ্ছে দেশের মানুষ। গত কয়েক বছর ধরেই দেশের মেগাসিটিগুলিতে উত্তাপের বহর বাড়ছিল হুহু করে। ঘরবন্দি হয়ে থাকার সুযোগ পড়ুয়া থেকে শুরু করে কিছু ভাগ্যবান শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী অথবা সরকারি চাকুরের জুটলেও বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মী কিংবা দিন-আনি-দিন-খাই ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের তা মিলবে না। ফলে এমন তাপের দহন রুখতে দেশের কিংবা রাজ্যের সরকারের দৃষ্টি দিতে হবে এই তাপের উৎস সন্ধানে।

ইতিমধ্যে স্বীকৃত যে জলবায়ুর এই বিষম গতি বাড়ছে বিকৃত এবং দ্রুত নগরায়ণের ফলে উষ্ণায়নের হাত ধরে। এখন দেশের ৩% জায়গা জুড়ে থাকা শহর-শহরতলি এলাকায় থাকে দেশের ৩৫% মানুষ, যারা তৈরি করছে দেশের ৬৩% সম্পদ। ভৌগোলিক মাপের নিরিখে নগরায়ণের বিপদের উৎসস্থল মাত্র শহুরে তিন শতাংশ এলাকায় হলেও পরিবেশ দূষিত হয়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে শহরের সীমা ছাড়িয়ে জেলা-গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র। কলকাতাও এমন বিষম উন্নয়নের দৃষ্টান্ত। যত মানুষ কলকাতামুখো হয়েছে, তত চাপ বেড়েছে তার পরিবেশের উপর। অল্প জায়গায় অনেক মানুষের মাথা গোঁজার লক্ষ্যে নির্মাণ বেড়েছে হুহু করে। গত কুড়ি বছরে কলকাতা এলাকায় নির্মাণ ক্ষেত্রের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। দশ বছরে শহরের সবুজ অংশের পরিমাণ কমেছে ৩০%। দেশে সবুজায়নের পরিমাণ কমার ক্ষেত্রে আমদাবাদ প্রথম, ৪৮%। আর এ রাজ্য সেই তালিকায় দ্বিতীয়। সবুজায়নের লক্ষ্যে আশু গাছ লাগানোর সরকারি কর্মসূচি নেওয়া হলেও তদারকির অভাবে কাজ এগোচ্ছে না। ‘অন্যান্য’ কর্মসূচি তো আছেই, যার জন্য যশোর রোডের মতো জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণে শয়ে শয়ে শতাব্দীপ্রাচীন গাছ কেটে ফেলা হয়।

সবুজ ধ্বংস করে কিংবা জলা-জমি বুজিয়ে নির্মাণও চলছে তরতরিয়ে। বহুতলের উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে বাড়ির দেওয়ালের মোট ক্ষেত্রফল বাড়ছে শহর জুড়ে। ফলে উত্তপ্ত সেই দেওয়াল জুড়ে বাড়ছে তাপের প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ। এখন চুনসুরকির দেওয়াল কিংবা খড়খড়ি দেওয়া জানলার দিন শেষ। এখন কংক্রিট, স্টিল, কাচ, অ্যালুমিনিয়ামের রাজত্ব। ফলে নতুন নির্মাণের ধাক্কায় নতুন প্রযুক্তির প্রভাবে তাপের ঘনঘটা বেড়ে চলছে শহর জুড়ে। বাড়ছে বাড়ির ঘনত্ব, পিচ ঢাকা রাস্তার পরিমাণ, কংক্রিট আর ইস্পাতে তৈরি উড়ালপুল। পিচের কালো রাস্তা কিংবা সাদা সিমেন্ট কংক্রিট কাঠামো, এরা আমাদের বায়ুমণ্ডলের তাপ শুষে নিয়ে নিজেরা আরও বেশি তেতে ওঠে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি, তখন তেতে ওঠা নির্মাণ কাঠামোর উষ্ণতা তার দেড় থেকে দু’গুণ বেশি। সেই তেতে থাকা নির্মাণ কাঠামোয় জমে থাকা তাপ বেরিয়ে স্বাভাবিক হতে লাগে দীর্ঘ সময়। তাই কেবল দিনের বেলায় সূর্যের তেজে দহন নয়, দহনজ্বালা বজায় থাকে রাতেও। এমন বিষম নির্মাণ কাঠামোর বৃদ্ধির জন্য আটকে যাচ্ছে শহর জুড়ে বায়ু চলাচলের স্বাভাবিক গতিপথ। অবরুদ্ধ হচ্ছে উত্তুরে কিংবা দখিনা বাতাস। উচ্চবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের ঘরে ঢুকে পড়েছে এসির বাক্স। ঘর সাময়িক ঠান্ডা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই মেশিনের গরম হাওয়ার ঝাপ্টা আছড়ে পড়ছে ঘরের বাইরে, শহর জুড়েই। শহরগুলো এখন তাপরুদ্ধ দ্বীপের মতো।

কলকাতায় যানবাহনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ অনেক কম, তাই এই শহরে ‘যান-ঘনত্ব’ অত্যন্ত বেশি। যানবাহনের ধীরগতির কারণে যানদূষণ ভয়াবহ। আর এই যানদূষণে তৈরি হওয়া মিহি দানার দূষণ (পিএম-২.৫) এবং মোটা দানার দূষণ (পিএম-১০) বিষাক্ত তাপ বয়ে নিয়ে বেড়ায় শহর জুড়ে। শহর-লাগোয়া শিল্পের জন্য ঘটছে বায়ুদূষণ, যাতে বায়ুমণ্ডলে তাপের সুরক্ষা কবচ হিসাবে থাকা ওজ়োন-স্তর ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সূর্যের আলোয় থাকা ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি রক্ষাকবচ ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছে উত্তপ্ত করছে মাঠঘাট, গাড়ি-বাড়ি সব কিছুই।

সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের রাজধানী দিল্লিতে তাপপ্রবাহের সংখ্যা কলকাতা, চেন্নাই এবং মুম্বইয়ের তুলনায় যথাক্রমে ২৬%, ৩১% এবং ৬৩% বেশি, কিন্তু হিট-স্ট্রোকে মৃত্যুর পরিমাণ চেন্নাইতে বেশি। সমুদ্রঘেঁষা চেন্নাইয়ের তাপ আর আর্দ্রতার প্রাণঘাতী মিশেলে ‘হিট স্ট্রেস’ সবচেয়ে বিপজ্জনক। কলকাতাও সেই বিপদের খাঁড়া মাথায় নিয়ে চলেছে। এত কাল ছিল এই গাঙ্গেয় বঙ্গে গ্রীষ্মকালে আর্দ্রতার বিপদ। এ বার তাতে যোগ হচ্ছে তাপপ্রবাহের বিপদ। নগরায়ণের নিয়ন্ত্রণ না এলে এই বিপদ এড়ানো অসম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Heat Wave India Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE