Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
মোদী-ম্যাজিক কাজ করবে তো, উদ্বিগ্ন স্বয়ং মোদীই
Opposition Alliance

‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে মাথাব্যথা

২০১৪-য় মোদী যখন প্রথম বার ক্ষমতায় এলেন, তখন বিজেপি ৩১ শতাংশর মতো ভোট পেয়েছিল। ২০১৯-এ তা ৩৭ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে।

Opposition party meet.

একত্র: বিজেপির বিরুদ্ধে নতুন ‘ইন্ডিয়া’ জোট ঘোষণা করছেন বিরোধী নেতারা, বেঙ্গালুরু, ১৮ জুলাই। ছবি: পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৪১
Share: Save:

মুম্বইয়ে সে দিন সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছিল। শরদ পওয়ারের সিলভার ওকস বাংলো থেকে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক সেরে বার হলেন, তখনও বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই পওয়ার ও মমতা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন। বিজেপির বিরুদ্ধে নতুন করে বিরোধী জোটকে চাঙ্গা করতে শরদ পওয়ারকে ইউপিএ জোটের আহ্বায়ক করা উচিত কি না, এই প্রসঙ্গ উঠতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সটান বলে দিলেন, “ইউপিএ আবার কী? ইউপিএ বলে এখন কিছু নেই।”

২০২১-এর ১ ডিসেম্বর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময় মনে করছেন, রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস ঠিক মতো বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছে না। তাই বিকল্প শক্তি খাড়া করা দরকার, যাতে বিজেপির মোকাবিলা করা যায়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ-র অস্তিত্ব সে দিন তিনি পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছিলেন।

রাজনীতিতে সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই পাল্টে যায়। দেড় বছর পরে রাহুল গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বিজেপি-বিরোধী জোটের প্রধান চালিকাশক্তি। দু’জনে মিলে বিরোধী জোটের নামকরণ করেছেন ‘ইন্ডিয়া’— ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’। কংগ্রেসের কেউই বিরোধী জোটের নাম আগের মতো ইউপিএ-ই রাখতে হবে বলে জোরাজুরি করেননি। অথচ কালের নিয়মে এখন নরেন্দ্র মোদীর মুখে ইউপিএ-র নাম শোনা যাচ্ছে। বিরোধী জোটের নাম ইন্ডিয়া রাখা হতেই নরেন্দ্র মোদী তার সঙ্গে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তুলনা টেনে নিশানা করেছিলেন। অভিযোগ তুলেছিলেন, ইউপিএ-র দুর্নীতির পাপ ধুয়ে ফেলতেই নাম বদলানো হয়েছে। এর পরে মোদী এনডিএ সাংসদদের নির্দেশ দিয়েছেন, ইন্ডিয়া নয়, বিরোধী জোটকে ইউপিএ বলেই আক্রমণ করতে হবে।

ন’বছরে নরেন্দ্র মোদী এই প্রথম রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত। এত দিন তিনি রাজনীতিতে নতুন বিষয় তুলে এনেছেন, বিরোধীরা তার জবাব দিয়েছেন। এটাই ছিল দস্তুর। বিরোধী জোটের নাম নিয়ে যে তিনি এত মাথা ঘামাবেন, তা ইন্ডিয়া-র কারিগররাও আশা করেননি। জোটের নাম দেখে আর কে কবে ভোট দিয়েছে? অথচ মোদী বার বার আক্রমণে গিয়ে জোটের নাম আরও বেশি করে লোকমুখে ছড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী জোট যে দিন বেঙ্গালুরুতে বৈঠক করছে, সে দিনই দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী এনডিএ-র বৈঠক করেছেন।

গত লোকসভায় বিজেপি একাই ৩০৩টি আসন জিতে আসার পরে এনডিএ-র কথা তাঁর মনেই ছিল না। প্রয়োজনও পড়েনি। অধুনা এনডিএ-র নতুন শরিক জোগাড় করতে বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা রাজ্য সফরে বেরিয়েছেন। ইন্ডিয়া জোটে ২৬টি বিরোধী দল শামিল হলে, তাদের সংখ্যার জোরে টেক্কা দিতে এনডিএ-র খাতায় ৩৮টি দলের নাম তোলা হয়েছে। বিজেপিকে বাদ দিলে বাকি ৩৭টি দল মিলে যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে ৩০টি আসনও পায়নি। এর মধ্যে ১৬টি দলের লোকসভায় কোনও সাংসদ নেই। ন’টি দল নির্বাচনেই লড়েনি। অথচ তাদের এককাট্টা করে এনডিএ-র সম্মেলনে মোদী বলেছেন, বিরোধীদের জোট আসলে পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা চালিত।

বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট নিয়ে কেন এত মাথা ঘামাচ্ছেন মোদী? তিনি কি উদ্বিগ্ন? আপাত ভাবে চিন্তার কোনও কারণ নেই। ২০১৪-য় মোদী যখন প্রথম বার ক্ষমতায় এলেন, তখন বিজেপি ৩১ শতাংশর মতো ভোট পেয়েছিল। ২০১৯-এ তা ৩৭ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে। বিজেপি যে ৩০৩টি আসন জিতেছে, তার মধ্যে ২২৪টি আসনে বিজেপি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। বিরোধীদের জোটকে নস্যাৎ করে দিতে বিজেপি এখন ৫০ শতাংশের বেশি ভোটে জেতা আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০-র উপরে নিয়ে যেতে চাইছে। তা বাস্তবায়িত হলে বিজেপি একাই লোকসভার দুই-তৃতীয়াংশ আসন জিতে আসতে পারে।

তা হলে নরেন্দ্র মোদী কেন বিরোধী জোট নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? কারণ তিনি জানেন, বিজেপিকে নির্বাচনী বৈতরণি পার করানোর দায়িত্ব কার্যত তাঁর একার কাঁধে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে একটি সমীক্ষা বলেছিল, বিজেপিকে ভোট দেওয়া দশ জনের মধ্যে অন্তত তিন জন নরেন্দ্র মোদীকে দেখে পদ্মফুলে বোতাম টিপেছেন। এনডিএ-র শরিকদের ভোটারদের ধরলে চার ভাগের এক ভাগ ভোট পড়েছে মোদীর নামে। যার অর্থ, এনডিএ-র ২৭.৫ কোটি ভোটের মধ্যে ৮.৫ কোটি ভোটের পিছনে ‘মোদী ম্যাজিক’ কাজ করেছে। অন্য ভাবে দেখলে, এনডিএ যে ইউপিএ জোটের তুলনায় ১১ কোটি ভোট বেশি পেয়েছিল, তার শতকরা ৮০ ভাগ ভোটই ‘মোদী ম্যাজিক’-এর অবদান।

বিরাট কোহলি দুর্দান্ত ফর্মে থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় ক্রিকেট দল তাঁর উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু একা কোহলিই গোটা দলের ভরসা হয়ে উঠলে, তার সঙ্গে একটা বিরাট ঝুঁকিও থেকে যায়— কোহলি ব্যর্থ হলে গোটা দলই মুখ থুবড়ে পড়বে। আর এই চাপ সবার আগে কোহলিকে পেড়ে ফেলতে পারে।

নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক ভাবে এই চাপ কাজ করে। কারণ তিনিই বিজেপির একমাত্র ভরসা। জননেতা হিসাবে ভোট টানার ক্ষেত্রেই হোন বা রাজনৈতিক কৌশল তৈরির নিরিখে। বিজেপির চাণক্য বলে পরিচিত অমিত শাহ তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি মোদীর মাপের জননেতা নন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে অমিত শাহই বিজেপির অঘোষিত সেনাপতি ছিলেন। শাহ বলেছিলেন, বিজেপি ২০০ আসনে জিতে সরকার গড়বে। ফলাফল অন্য কথা বলেছে। বিজেপির জাতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার রাজ্য হিমাচলপ্রদেশে দল হেরেছে। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এল সন্তোষের রাজ্য কর্নাটকেও বিজেপিকে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে।

মোদী-ম্যাজিক যে বিধানসভা নির্বাচনে কাজ করছে না, তা বহু দিন প্রমাণিত। পাঁচ বছর আগে, ২০১৮-র মার্চে, বিজেপি ও তার শরিক দলগুলি দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এলাকায় ক্ষমতায় ছিল। ২১টি রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ ও ৭৬ শতাংশ এলাকা ছিল বিজেপির দখলে। বিজেপি এখন ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৬টি রাজ্যে ক্ষমতায়। কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, বিজেপির ভোট পাঁচ শতাংশ ‘সুইং’ করলেই এনডিএ ও ইন্ডিয়া জোটের আসনসংখ্যা সমান হয়ে যাবে। তার বেশি ভোটবাক্স বদলে বিরোধী জোটের ঝুলিতে এসে পড়লেই খেলা ঘুরে যাবে। এই তত্ত্বে সীতারাম ইয়েচুরির মতো নেতারা সিলমোহর দিয়েছেন।

লোকসভা নির্বাচনে মোদী ম্যাজিক কাজ করবে না, এখনও তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যে কোনও ব্যক্তিরই জনপ্রিয়তা সামান্য হলেও ফিকে হয়। তার মোকাবিলায় বিজেপির ‘মোদীর বদলে কে’ বলে প্রশ্ন করে। বিরোধী জোট সেই ফাঁদে পা দিতে চাইছে না। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোট নির্দিষ্ট কাউকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে না। তাই মোদী ইন্ডিয়া জোটকেই নিশানা করছেন। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যে থেকে বিজেপিকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, শুধু মোদী ম্যাজিকের ভরসায় বসে থাকলে চলবে না। রাজ্যে রাজ্যে সংগঠন মজবুত করতে হবে। নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। আরএসএসের মুখপত্রে তা লেখাও হয়েছে।

হয়তো এই চাপের মুখেই নরেন্দ্র মোদী বলে দিয়েছেন, তিনিই তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। বিজেপি বা এনডিএ ২০২৪-এ তৃতীয় বার সরকার গড়বে বললে তা আলাদা করে নজরে পড়ত না। কিন্তু ২০২৪-এর পরে তাঁর তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে দাবি করে মোদী বলেছেন, “আমার তৃতীয় কার্যকালে আপনারা নিজেদের স্বপ্ন চোখের সামনে পূরণ হতে দেখবেন।” বাহাত্তর বছরের নরেন্দ্র মোদীর এই দাবি নিয়ে ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে বিশেষ কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে বিজেপিতে প্রধানমন্ত্রী পদে অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথের মতো মোদীর সম্ভাব্য উত্তরসূরিরা কী ভাবছেন, সেটাই আসল কৌতূহলের বিষয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE