Advertisement
০৮ মে ২০২৪
Society

ওই আসে অমারাত্রি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য দেখে যাননি, সেই বিশ্বযুদ্ধের পরিণাম কতখানি ভয়ঙ্কর হয়ে পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছিল!

—প্রতীকী ছবি।

অলকেশ দত্ত রায়
শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৩ ০৫:০৭
Share: Save:

আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে আশি বছর বয়সি এক যুগপুরুষ তাঁর একটি যুগান্তকারী রচনায় মানুষেরই হাতে তৈরি এই সভ্যতার এক চরম সঙ্কটের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। সেই দিনের পটভূমিকায় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মাদনায় “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য দেখে যাননি, সেই বিশ্বযুদ্ধের পরিণাম কতখানি ভয়ঙ্কর হয়ে পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছিল!

আজ, মানুষের গড়া সেই সভ্যতা আবার এক বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের মুখে। তবে আজকের সঙ্কট শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের জীবদ্দশায় দেখা সবচেয়ে বড় আতঙ্ক করোনাভাইরাসের অতিমারিকেও অনেকটাই পেরিয়ে এসেছি, তবে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে কয়েক লক্ষ জীবন।

কিন্তু, নতুন সঙ্কটের সঙ্গে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কত লক্ষ মানুষ টিকবেন, জানা নেই। ভয়ের কথা, এর সমাধানও অনেকটাই অজানা। গত শতকে স্বৈরতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নির্মম নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটিয়ে মানুষ ভেবেছিল এ বার সময় পাল্টাতে শুরু করেছে। বিশ শতকের শেষ দিকে বহু নেতারা নিয়ো-লিবারাল অর্থনীতির ধুয়ো তুলে জনতাকে বুঝিয়েছিলেন, সত্যিই সময় পাল্টাচ্ছে। মনে হয়েছিল, আর্থিক-সামাজিক মাপকাঠিতে উন্নত দেশগুলোয়, সরকার গণতন্ত্রকে সম্মান করবে। কিন্তু গত দু’দশকে সেই পুরনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনপ্রক্রিয়া যেন আবার নতুন চেহারায় ফিরে এসেছে। এই নতুন রাজনৈতিক একনায়ক গোষ্ঠীকে মদত দিচ্ছে অগাধ ক্ষমতাসম্পন্ন কতিপয় ধনকুবের। তাঁরা হয়তো জনতার ১%, অথচ কোনও না কোনও ভাবে বাকি ৯৯% মানুষেরই চালক ও নিয়ন্তা। এই নিদারুণ মেরুকরণই আজকের সভ্যতার সঙ্কটের অন্যতম কারণ। বহু দেশেই একনায়ক ও অতিধনীদের মধ্যে এই সমীকরণ রয়েছে। এই সমীকরণকে না বুঝলে, তার সমাধান না করলে, আজ আমেরিকা, কাল ‌ভারত, পরশু ইংল্যান্ড, তরশু ব্রাজ়িল— আস্তে আস্তে সব দেশই সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাবে। আজকের গোলমালটা কেবল বাম-ডান-লাল-নীল-ওল্ড-নিয়ো মতবাদ নিয়ে ভাবলে চলবে না। কারণ এতে জড়িয়ে আছে এত দিনের গোটা সমাজ ও অর্থনৈতিক সুপারমার্কেট।

অদ্ভুত শোনালেও এই নতুন সঙ্কটের অন্যতম কারণ হল, শেষ কয়েক দশকে সভ্যতার তুমুল ও চটজলদি প্রসার হয়েছে। কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে। সুফলও পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এই উন্নতির ইঁদুর-দৌড়ে ‘সুপার অ্যাড্রিনালিন’ ক্ষরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অর্থনৈতিক আর সামাজিক শ্রেণিবিভাজন তীব্রতর হয়েছে। ধনসম্পদ আর ক্ষমতার মেরুকরণ হয়ে গিয়েছে। তার প্রভাবে অভিশাপ এসেছে আমজনতার জীবনে। ফলে, তাঁরা অন্নসংস্থানে এতটাই ব্যস্ত যে বুঝতেই পারছেন না যাঁদের ভোট দিচ্ছেন, তাঁরা দুর্নীতিতে লিপ্ত। এই বোঝা, না-বোঝা’র সুযোগে, মানুষের দুর্বলতম জায়গাগুলোয় ঘা দিয়ে ‘প্রোপাগান্ডা’ তৈরি করে জীবনযুদ্ধে তিতিবিরক্ত মানুষকে আরও উস্কে দেওয়া হচ্ছে। মানুষকে তার কষ্টের মূল কারণটা বোঝার সুযোগ না দিয়ে, তার কানের কাছে রোজ চেঁচানো হচ্ছে যে— এই শস্যশ্যামলা দেশ তোমার; অন্য দেশ থেকে আসা, অন্য ধর্ম বা বর্ণের ‘অপর’ মানুষগুলির জন্য নিজের দেশে তুমি অত্যাচারিত! এতে মানুষের মনে ভরে যাচ্ছে বিদ্বেষের বিষ! নিজের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য সে দায়ী করছে অন্য সেই লোকটাকে, যার গায়ের রং তার চেয়ে আলাদা, ধর্মের নিশান ও ভাষা অন্য। হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান-ইহুদি, সাদা-কালো, মেক্সিকান-আমেরিকান— সবাইকে এ ভাবেই নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির অন্যতম কৌশলই হল জনমানসে অন্যায়ের ‘অনুমোদন’ তৈরি করা ও ‘প্রোপাগান্ডা’র বিকিকিনি। অনুমোদন তৈরিতে বড় ভূমিকা নিচ্ছে অনলাইন ও অফলাইন সংবাদমাধ্যম।

এই দূষিত আর্থ-সামাজিক রাজনীতির পাশাপাশি মানুষকে ভোগাচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। মেরুর বরফ গলছে, কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, বেড়ে চলেছে ভূমিকম্প, ঝড়, সুনামি, দাবানল, চরম হচ্ছে গ্রীষ্ম ও শীত। আগামী বছরগুলোয় প্রকৃতির বলি হবে অসংখ্য মানুষ। তবে তার চেয়েও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হবে। তারা কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, কোথায় নতুন কাজ পাবে— নেতারা তা নিয়ে ভাবেন না। বরং এই জটিল পরিস্থিতির সুযোগে প্রোপাগান্ডার জিগির চালু রেখে আসল সমস্যাগুলো ধামাচাপা দেন। মানুষের ভাবনাচিন্তার মুখ ঘুরিয়ে ভীতি-ঘৃণা-বিদ্বেষের আবহাওয়া সৃষ্টি করেন।

আর একটি হেতু আমাদের খুঁজতে হবে— আজকের বিজ্ঞানের মধ্যে। বিজ্ঞান আজকের সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স। বিজ্ঞানের নয়া হাতিয়ার ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই শ্রেণিবিভাজনকে আরও কোটি গুণ বাড়িয়ে দেবে। অল্প কিছু মানুষ প্রযুক্তির প্রগতির জোরে সুফল লুটে নেবে; কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই কর্মহীন হয়ে যাবে। সমাজবিদ ইউভাল নোয়া হারারি-র বক্তব্য অনুযায়ী এক দিকে তৈরি হবে অর্থনীতির চূড়ায় বসা সুপার হিউম্যান, অন্য দিকে পড়ে থাকবে বাকি সব মানুষ। আবার সেই এক ও নিরানব্বই শতাংশের কাহিনি।

এই ভয়ঙ্কর সঙ্কটকে ঠেকিয়ে রাখার উপায়? নিজের শহর, নিজের রাজ্য, নিজের দেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ‘থিঙ্ক গ্লোবাল, অ্যাক্ট লোকাল’, যে পরিবর্তনের কান্ডারি হবে পরবর্তী প্রজন্ম— ছাত্রসমাজ, যুবসম্প্রদায়। অতিমারির সময় সাদা-কালো দ্বন্দ্বে যে ভাবে গর্জে উঠেছিল নবীন আমেরিকা, ভারতের ছাত্রসমাজ এনআরসি-র বিরুদ্ধে একতার ডাক দিয়েছিল ক্যাম্পাসে পথেঘাটে, যে ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে জনমত তৈরি করেন গ্রেটা থুনবার্গ— সে ভাবেই প্রতিটি প্রান্তের ভবিষ্য-নাগরিকদেরই এগিয়ে এসে এই অমানিশার মেঘ সরিয়ে দিতে হবে। জলবায়ু চুক্তি মেনে বিকল্প জ্বালানির খোঁজ করতে হবে। স্বাস্থ্যনীতির সামাজিক প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে, বন্ধ করতে হবে ‘ওয়াল স্ট্রিট’-নির্ভর অর্থনীতির অপপ্রয়োগ। বিজ্ঞানীদেরও মানবিকতা ও নৈতিকতা চর্চা করতে হবে। না হলে ধুরন্ধর রাজনীতিবিদেরা দখল নেবে পৃথিবীর। ক্ষমতায় ফিরবে কট্টরপন্থী শাসকেরা, ফিরিয়ে আনবে দেশভাগের রক্তমাখা ইতিহাস।

আস্থা থাকুক রবীন্দ্রনাথের দূরদৃষ্টিতে। তিনি তো বলেছেন, এগিয়ে যেতে হলে ‘সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Humans Civilization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE