E-Paper

আপেল যখন মস্ত সুযোগ

আমেরিকার মতো ধনী দেশের অর্ধেক স্মার্টফোন-বাজার ছেয়ে রেখেছে আইফোন। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশ ভারতে চিত্রটি অন্য রকম।

সুমিত মিত্র

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২৩ ০৫:৪৬
iPhone.

সূচনা: মুম্বইয়ে ভারতের প্রথম অ্যাপল রিটেল স্টোর উদ্বোধনে সংস্থার সিইও টিম কুক। ১৮ এপ্রিল, ২০২৩। রয়টার্স

বাইবেলের বাণী অনুসারে সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই বৃক্ষশাখায় দোদুল্যমান লাল টুকটুকে আপেল হল প্রলোভনের চরম প্রতীক। ব্যাপারটি বিশেষ পাল্টায়নি আজও। শুধু গাছের আপেলটি হয়ে গেছে এমন একটি স্মার্টফোন, যার মোবাইল ফোনের জগতে ব্রাহ্মণত্ব অনস্বীকার্য। পর্দায় শুধু আঙুল প্রয়োগ করে সক্রিয় করা যায়, এ-হেন স্মার্টফোনের বাজারের ৭০ শতাংশ কিন্তু গুগল কোম্পানির দখলে, তার ফোন ব্যবহারবিধি (অপারেটিং সিস্টেম) অ্যান্ড্রয়েড-এর মাধ্যমে। সেই ব্যবহারবিধি নির্ভর করেই চলছে সাধারণ মানুষের হাতের ফোন, যা বাজার আলোকিত করে রেখেছে অসংখ্য নামে। কিন্তু ২৮ শতাংশ স্মার্টফোনের আলাদা ব্যবহারবিধি এবং তার নির্মাতা একটিই কোম্পানি— অ্যাপল, নিবাস যার ক্যালিফোর্নিয়া। তার ‘আইফোনের’ স্বাতন্ত্র্য শুধু দামেই নয়, ব্যবহারিক স্বাচ্ছন্দ্যে, নিরাপত্তায়, এবং তার ব্যবহারবিধি আইফোন অপারেটিং সিস্টেম নির্মাণগত নৈপুণ্যে, যা ধনী দেশেও নবতম মডেল আইফোনকে করে রেখেছে কাঙ্ক্ষণীয় সামগ্রী, হোক তার মূল্য দেড় হাজার ডলারেরও বেশি।

আমেরিকার মতো ধনী দেশের অর্ধেক স্মার্টফোন-বাজার ছেয়ে রেখেছে আইফোন। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশ ভারতে চিত্রটি অন্য রকম। ব্যবহারবিধির অনুপাতে অ্যান্ড্রয়েড অধিকার করেছে প্রায় ৯৩ শতাংশ হাতের তালু। মাত্র তিন-চার শতাংশ ভাগ্যবানের পকেটে আইফোন। তা অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয় মোটেও। সম্প্রতি একটি গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের অর্জিত সম্পদের ৪০.৫ শতাংশ হস্তগত করেছে মাত্র এক শতাংশ মানুষ। যে-হেতু এই বৈষম্য অন্তত দৃষ্টিগোচর ভবিষ্যতে কমার লক্ষণ নেই, ভারত তাই কোনওমতেই রাতারাতি আইফোনের পয়লা নম্বর বাজার হয়ে উঠতে পারে না; বড়জোর হতে পারে সম্ভাবনাময় বাজার। তার জন্যই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার টিম কুকের সাম্প্রতিক ভারত সফর।

ভারত কবে হয়ে উঠবে আইফোনের মস্ত বাজার, তা বলা শক্ত। তবে অনুমান চলতে পারে যে, কুকের ভারত আগমনের অন্য যে বিষয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে তা হল চিন-আমেরিকা সম্পর্কের অবনতি। এই সম্পর্কহানির এক বড় কারণ, বাণিজ্য। ১৯৯৯ সালে যখন আমেরিকা ও চিনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য-চুক্তি সই হয় তখন ওয়াশিংটনের আশা ছিল লক্ষ্মীর কৃপায় চিনে জন্ম নেবে এক সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যার জন্যই নাকি সে-দেশে একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হবে, গণতন্ত্র আসবে। সে গুড়ে দেখা গেল— বালি। বরং চিনকে এক বার দেশের বাজারে ঢুকতে দিতেই আমেরিকার মেধাসম্পত্তির চুরি পরিণত হল রাহাজানিতে। চিন রফতানিতে তৎপর কিন্তু আমদানিতে কঞ্জুস, সুতরাং হুহু করে বাড়তে শুরু করল আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি, উৎপাদন শিল্পে কর্মরত মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ভিতর থেকে ফোকলা হয়ে গেল। তার রাজনৈতিক ফল— দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিশ্বজোড়া উত্থান।

আমেরিকা এখন চিনের সঙ্গে তার বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করছে নানা উপায়ে, যদিও তাতে সাফল্য এখনও বিন্দুবৎ। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর আমলেই দেখা গেল, যে বছর চিনা আমদানি কমেছে বলে আমেরিকার সরকার বড়াই করছে সেই বছরেই অন্যান্য দেশ থেকে তারা যা আমদানি করেছে তার অধিকাংশই চিনা রফতানি। অর্থাৎ, পিছনের দরজা দিয়ে চিনা আমদানি অব্যাহত।

অ্যাপলের বৈশিষ্ট্য হল দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী কোম্পানি (গত বছরের বিক্রি ৪০০ বিলিয়ন ডলার), কিন্তু চিনের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। ২০১০ সালে আইফোনের শৈশবলগ্নেই চিনের আইফোন সরবরাহকারী সংস্থা ফক্সকনের শেনজেন শহরে কর্মীর মোট সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ। আমেরিকার বাণিজ্য-সংক্রান্ত পত্রিকা ফোর্বস-এর মতে মোট উৎপাদনের নিরিখে অ্যাপল কোম্পানির যে কোনও সামগ্রীতে— হোক তা আইফোন, আইপ্যাড ট্যাবলেট, ম্যাক ল্যাপটপ বা গানের অফুরন্ত ভান্ডার আইপড— চিনের অবদান ‘অন্তত ৯৫ শতাংশ’। পত্রিকাটির মতে, এই গোলমেলে তথ্যটি লুকিয়ে রাখতেই অ্যাপল তার বাৎসরিক প্রতিবেদনে ভিয়েতনাম, জাপান, ভারত প্রভৃতি দেশের নাম ‘সরবরাহকারী দেশ’ বলে শুনিয়ে রাখে।

ব্রিটেন ও পশ্চিমি দেশের ওজনদার পত্রিকার মত হল, চিন ‘অ্যাপল’কে দেয় দু’টি মহামূল্যবান উপহার। এক, আইফোনের ভিতরে তার ডিসপ্লে, মেমরি, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন অথবা প্রসেসর ইত্যাদি যন্ত্রাংশ, এবং তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশের নাড়িনক্ষত্র জানে, এমন অসংখ্য দক্ষ ঠিকাকর্মী। তা ছাড়া যে দেশে পার্টির কথাই শেষ কথা সেখানে অ্যাপলের মতো আদরের মক্কেলের শ্রমের মজুরি নিয়ে গন্ডগোল তো প্রশ্নের অতীত।

কিন্তু আমেরিকান কংগ্রেস ও বাণিজ্য দফতরের রক্তচক্ষুকে কোনও আমেরিকান প্রতিষ্ঠান কি অগ্রাহ্য করতে পারে, হোক না সে পৃথিবীর চোখের মণি অ্যাপল? শোনা যাচ্ছে বেঙ্গালুরুতে আইফোনের কিছু অংশ সমবেত করার যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে, কয়েক বছর যাবৎ তাকেই বড় করার পরিকল্পনা নিয়েছেন অ্যাপলের কর্তারা। উদ্দেশ্য, ২০২৭ সালের মধ্যে বেঙ্গালুরুতে সম্পন্ন করা আইফোনের ‘ফাইনাল টেস্ট’ ও ‘অ্যাসেম্বলি’র কাজটুকু, যা হলেই বাক্সে ছাপ পড়বে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’। এই শেষ পর্বের জন্য প্রয়োজন নেই অসংখ্য দক্ষ প্রযুক্তিবিদের। তবে প্রয়োজন— গুণমান পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞ ঝানু ম্যানেজারের, যা অ্যাপলের ঝুলিতে প্রায় সকলেই চিনা। ভিয়েতনামে আইফোন প্যাকেটজাত করার শেষ কাজটুকু সারে চিন থেকে আনা কোম্পানি। ভারত ও চিনের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তা হয়তো সম্ভব হবে না। সেই ধরনের অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ ও ম্যানেজার অবশ্যই ভারতে তৈরি হতে পারে। তবে তার জন্য প্রয়োজন সময় ও সুযোগ। ভারতে শিক্ষিত প্রযুক্তিবিদেরা আমেরিকায় নাম কিনেছেন, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হয়েছে সিলিকন ভ্যালির বেতন-কাঠামো। অ্যাপল কিন্তু তার ভারতীয় কারখানায় যা বেতন ও সুবিধা দেবে তা ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, ক্যালিফোর্নিয়ার নয়।

অ্যাপলের সম্ভারের এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তারা হালকা ও স্বল্প আয়তন হলেও তাদের মধ্যে ঠাসা হয়েছে অসংখ্য দেশ থেকে সংগৃহীত নানান পদার্থ দিয়ে তৈরি জিনিস। তাদের বেশ কিছু হল ‘কনফ্লিক্ট মিনারাল’। সোনা-সহ এই কয়েকটি খনিজের জন্য আফ্রিকার কঙ্গো রিপাবলিকে এত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে যে তার সরবরাহ সহজ নয়। তা ছাড়া রয়েছে সেই সতেরোটি ‘রেয়ার আর্থ’ উপাদান, যা অ্যাপল কোথা থেকে সংগ্রহ করে তা রহস্যাবৃত হলেও ‘তৃতীয় পার্টি’ হওয়ার সুবাদে চিনই আইফোন ইত্যাদির ৮০-৮৫ শতাংশ উপাদানের সূত্র।

মার্চ মাসেই টিম কুক চিনে গিয়েছিলেন। সেখানে ভূয়সী প্রশংসা করেন চিনের উদ্ভাবনী ক্ষমতার, বলেন চিনের সঙ্গে অ্যাপলের ‘সিমবায়োটিক’ (পরস্পরজীবী) সম্পর্ক ‘আমরা উভয়েই উপভোগ করেছি’। তার দুই সপ্তাহের মধ্যে ভারতে এসে কুক সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তাঁর শাসনাধীন ভারতও একটি উচ্চাসন লাভ করতে চলেছে পৃথিবীর উজ্জ্বলতম টেক কোম্পানির মানচিত্রে। দুঃখের বিষয়, হাতের তালুতে বহনযোগ্য ওই ক্ষুদ্র অথচ মেধাবী যন্ত্রটি যে-সব ক্ষুদ্রতর যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি তার নির্মাণ ও গঠনের জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন, এবং যে মূল্যে, তা একমাত্র চিনেই আছে। কৃত্রিম মেধার প্রসার হলে কী হবে বলা শক্ত। তবে প্রযুক্তি এবং অর্থনীতির দৌড়ে চিন কিন্তু আমেরিকাকে বোকা বানিয়ে এত দূর এগিয়ে গেছে যে, শুধু জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব।

চিনের সঙ্গে ভারতের যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দূরত্ব তৈরি হয়ে রয়েছে তা কমার চেয়ে বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। মোদীর ভারতে উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে মিশে রয়েছে এক তীব্র বিজ্ঞান-বিরোধী মানসিকতা, যে কারণে রাজনীতি প্রভাবিত জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিলের চমকপ্রদ প্রস্তাব হল স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে বিদায় করা ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব। সম্প্রতি চিনের থেকে ভারতের জনসংখ্যা এগিয়ে যাওয়া সম্পর্কে চিন সরকার একটি তির্যক মন্তব্য করেছে যা হল, কোনও দেশের শক্তি প্রতিফলিত হয় তার জনসংখ্যায় নয়, বরং মানুষের কর্মদক্ষতায়। সেই সত্যটি জেনেশুনেই নিশ্চয় অ্যাপল-প্রধানের ভারতে আবির্ভাব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

iphone India usa

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy