Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Swarnakumari Devi

বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে...

সম্প্রতি কিছু লেখা পাঠ করতে গিয়ে শুশ্রূষার প্রলেপ পাওয়া গেল, কিংবা ক্ষত দিয়ে শতমুখে রক্ত ঝরতে লাগল।

Swarnakumari Devi

— ফাইল চিত্র।

তৃষ্ণা বসাক
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪ ০৭:১৩
Share: Save:

এক সম্পাদক ফোন করলেন, “লেখিকাদের নিয়ে সংখ্যা হচ্ছে, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এক জন লেখিকাকে নিয়ে আর এক জন লেখিকাই লিখবেন।” এমন ফোন প্রায়ই আসে। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা কিংবা কোনও অনুষ্ঠান, লেখিকাদের নিয়ে লেখার বা বলার ডাক পড়ে মেয়েদেরই। যেন লেখিকাকে লেখিকা না দেখিলে কে দেখিবে?

এটাই দস্তুর। পুরুষদের এই বিষয়ে লেখানোর কথা মনেই পড়ে না কারও। কখনও কি কোনও পুরুষ লেখকের সাক্ষাৎকারে শুনেছি প্রিয় বইয়ের তালিকায় প্রথম প্রতিশ্রুতি, এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, বা নবাঙ্কুর? এমনকি চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর-এর নামও কি থাকে? কারা ভাল লিখছেন— প্রশ্নের উত্তরে কদাচিৎ আসে কোনও লেখিকার নাম।

সম্প্রতি কিছু লেখা পাঠ করতে গিয়ে শুশ্রূষার প্রলেপ পাওয়া গেল, কিংবা ক্ষত দিয়ে শতমুখে রক্ত ঝরতে লাগল। আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আঞ্চলিক ভাষা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্বর্ণকুমারী দেবী (ছবি), গিরিবালা দেবী ও জ্যোতির্ময়ী দেবীর বিপুল আয়তনের রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিটির সম্পাদক বাণী রায়। ব্যস্ত কবি ও ঔপন্যাসিক, রায়বাড়ি-খ্যাত গিরিবালা দেবীর কন্যাটি প্রভূত পরিশ্রম ও দুঃসাহসের কাজ করেছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর রচনাবলির ভূমিকায় লিখছেন, “স্বর্ণকুমারী দেবীর চরম দুর্ভাগ্য তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজা রূপে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।... এবম্বিধ উক্তি আমাকে বাতুল অথবা নির্বোধ অথবা উদ্ধত ভাষী প্রতিপন্ন করতে পারে।... আমি বলতে চাই যে আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপ্ত, সারা পৃথিবীস্পর্শী প্রতিভাধর অনুজ রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির অন্তরালে এই অসাধারণ লেখিকা সম্পূর্ণ আবৃত হয়ে আছেন, তাঁর যা প্রাপ্য তিনি তা পাননি।... সাহিত্য সৃষ্টির উৎকর্ষে শুধু নয়, সাহিত্য সৃষ্টির বৈচিত্রে তিনি অদ্যাপি অতুলনীয়া।”

“তবে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের দোকানে দিনের পর দিন সন্ধান করে আমাকে তাঁর গ্রন্থাবলী উদ্ধার করতে হল কেন? ...তাঁর অজস্র রচনাসম্ভারের মধ্যে একখানিও সেখানে (বিশ্বভারতীতে) নেই কেন? ...রবীন্দ্রনাথ অজস্র গ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন কতজনকে। কিন্তু একখানিও করেননি অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীকে, যদিও অগ্রজা দীর্ঘ জীবন লাভ করে একই নগরে বাস করেছেন।... অতি বেদনায় গলাবাজি করে আমাকে নারীবর্ষের দোহাই পেড়ে যৎকিঞ্চিৎ সরকারি অনুদান সংগ্রহ করতে হচ্ছে এই সমস্ত বিস্মৃতপ্রায় লেখিকার রচনার পুনরুদ্ধারের জন্য।... কয় জন তাঁর একটিও লেখা পড়েছেন? অমানুষিক পরিশ্রম করে আমি লেখিকামন নামক একটি গল্প সংকলন করেছিলাম স্বর্ণকুমারী ও অন্যান্য বিস্মৃত লেখিকা থেকে বর্তমান পর্যন্ত। স্থিতিশীল প্রকাশক পাইনি, অধুনা বইখানির অবিক্রীত খণ্ডগুলি উদ্ধার করতে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের সাধ্য আমার নেই।”

লেখিকাদের উদ্ধারের দায় কি শুধুমাত্র লেখিকাদেরই? বিষয়টিতে চাঁছাছোলা ভাষায় লিখেছেন বাণী রায়, “...অনেক লেখিকা বলে থাকেন: নারী রচনাকারের সঙ্গে গ্রথিত হতে চাই না আমি, আমি একজন লেখক এই আমার একমাত্র পরিচয় হোক।... পঁচিশ বছর পূর্বে বলেছি...: আচার জ্যাম জেলির মত বোতলের লেবেল এঁটে নারী সাহিত্যকে পৃথকীকরণের প্রয়োজন নেই।... কিন্তু নারীলেখকের লেখা সংরক্ষিত হচ্ছে না কেন?... স্বর্ণকুমারী থেকে অনুরূপা, নিরুপমা, গিরিন্দ্রমোহিনী, মানকুমারী, কামিনী, প্রিয়ম্বদা, শৈলবালা ঘোষজায়া, সীতা দেবী ও অনেক— ...কারুর লেখা কি সংরক্ষণযোগ্য নয়?... গলা তুলে আমাকে অগ্রণী হতে হয় নিশ্চিত লুপ্তির হাত থেকে কতকগুলি নামের ধ্বংস বাঁচাতে? সভাস্থলে আবার আমারই অতীত উক্তি স্মরণ করে যখন বয়ঃকনিষ্ঠা আমাকে খণ্ডন করতে প্রয়াস দেখান তখন নিরুত্তর হাস্য ভিন্ন এবং অমৃতং বাল ভাষিতং বয়ান আওড়ানো ভিন্ন আমার করবার কিছু থাকে না।”

লেখিকাদের রচনা বাঁচাবার উপায় কী— প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, সাহিত্যজগতের নেতা বহু দিন থেকেই পুরুষ। যে কয়েক জন লেখিকা প্রাধান্য পেয়েছেন, তাঁরা স্বীয় কৃতিত্বে তৃপ্ত। কিন্তু সমষ্টিগত ভাবে যে অমরত্ব তাঁরা অর্জন করবেন, একত্রে বিধৃত হলে পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে তাঁদের যে স্বতন্ত্র মূল্যায়ন হবে, ঐক্যে যে উৎকর্ষ, সে কথা তাঁরা ভেবে দেখেন না।

ঐক্যে উৎকর্ষ— কথাটির নীচে আঙুল রেখে বসে থাকি চুপচাপ। নবনীতা দেব সেন বলেছিলেন, বড় হওয়ার পরে বাণী পিসিমাকে বুঝেছি ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ গল্প পড়ার পরে। দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তাঁর উদ্দেশ্য— পালের গরু হতে চাননি। তাঁর সাজপোশাক, ব্যক্তিগত জীবন যত লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তাঁর দুঃসাহসী কলম সেই মনোযোগের ভগ্নাংশও পায়নি। “নারী না হয়ে তিনি যদি পুরুষ হতেন এবং এইরকম সজ্জা করতেন সে তাঁর জনপ্রিয়তার পক্ষেই যেত।... নারী জন্মের মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে।”

জনপ্রিয় ফর্মুলায় লেখার ধার না ধারা, ‘উদ্ধতভাষী’ বাণী রায়, তাঁকেই বা কে সংরক্ষণ করল? কিছু লেখা নতুন ভাবে ছাপা হলেও তাঁর সম্পাদনার কাজগুলি অবহেলিতই রয়েছে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর রচনাবলির উৎসর্গটি দেখলে গায়ে কাঁটা দিতে পারে, “স্নেহভাজন শ্রীমান প্রবোধ কুমার সান্যাল, কল্যাণীয়া শ্রীমতী আশাপূর্ণা দেবী এবং বিশেষ শ্রদ্ধা ও স্নেহের পাত্রী, কবি ও সুলেখিকা অধ্যাপিকা শ্রীমতী কল্যাণী দত্ত ও অধ্যাপিকা শ্রীমতী মহাশ্বেতা দেবীকে সাদর আশীর্বাদ সহ দিলাম।”

সাহিত্যের আক্ষরিক অর্থ যদি হয় ‘সহিতের ভাব’, অন্য একটি অর্থ আড়ালে থাকে— প্রবহমানতা। বাণী রায় কি সেই ভাবেই থেকে গেলেন? হয়তো তাঁর হারিয়ে যাওয়া কাজগুলো কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের ধুলো ঝেড়ে আবিষ্কার করবেন নবীন লেখিকা, তাঁর উল্লিখিত বিস্মৃত লেখিকাদের উপেক্ষিত গ্রন্থগুলিও নতুন করে পড়া হবে, নতুন করে এগিয়ে আসবেন উৎসুক প্রকাশক, কারণ বাণী রায়ের মতো তাঁরাও ‘লেখিকাদের বিস্মৃতির অতল থেকে উদ্ধার করে বিশ্বের দরবারে হাজির করার প্রয়োজন’ টের পাবেন বুকের ভিতর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Writer Women Book Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE