E-Paper

সাংবাদিকদের বধ্যভূমি গাজ়া

বার বার অভিযোগ উঠছে, পরিকল্পিত ভাবে একে-একে হত্যা করা হচ্ছে যুদ্ধ কভার করা সাংবাদিকদের। যে কোনও মূল্যে সেনা অভিযানের ভয়াল ছবি ও প্রকৃত তথ্য বাইরে আসা আটকাতে চাইছে ইজ়রায়েল।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৫
An Image Of Israel-Palestine Conflict

—প্রতীকী চিত্র।

হাড়-পাঁজর গুঁড়িয়ে যাওয়ার মতো লাগাতার শব্দ! কর্ণকুহরে প্রবেশের জন্য বুঝি আর কোনও শব্দ অবশিষ্ট নেই! মাথার উপরে ঘুরপাক খাচ্ছে অ্যাপাচে হেলিকপ্টার, মাঝে মাঝেই এফ-১৬ বোমারু বিমান থেকে বোমাবর্ষণ, যুদ্ধজাহাজ থেকে ছুটে আসছে গোলা! চতুর্দিকে ধ্বংসলীলা। গাঢ় অন্ধকার গিলে খাচ্ছে, বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, খাবারই বা কোথায়? এ দিকে আর মিনিট তিনেকের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হবে তাঁদের বাড়ি লক্ষ্য করে। কোথায় যাবেন তাঁরা? ইজ়রায়েলি গ্রাউন্ড ফোর্সের মেশিনগানের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাবেন তাঁরা। ইস্পাতকঠিন স্নায়ু নিয়ে এই গোটা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন যিনি, তিনি সাংবাদিক মহম্মদ ওমর, তিন মাসের শিশুর বাবা।

না, এটা এখনকার ঘটমান ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের কথা নয়। এটা ২০১৪-র জুলাইয়ে গাজ়ায় ইজ়রায়েলের হামলার বিবরণ। সেই যুদ্ধে একটি পরিবারের কথা আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মনে করানো কেন? কারণ, এই দুই সময়কালে মূল চরিত্র কিন্তু সাংবাদিকরাই। ২০১৪-য় ইজ়রায়েলের সেই বড় মাপের তৃতীয় অভিযান, ‘অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ’ নিয়ে তার পরের বছর একটি অসাধারণ বই লিখেছিলেন গাজ়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক মহম্মদ ওমর। নাম শেল-শকড/ডেসপ্যাচেস ফ্রম দ্য ওয়র। আগাগোড়া গাজ়ার বাসিন্দা ওমর কিন্তু পরিবার নিয়ে অন্য কোথাও পালাননি। তিনি থেকে গিয়েছিলেন সেখানেই, তাঁর নিজস্ব ভূখণ্ডের মানুষের গুঁড়িয়ে যাওয়া দেখতে। নিজের ও পরিবারের প্রাণ বাজি রেখেও সাংবাদিকতার ধর্ম থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি ওমর। প্রতি দিন নথিবদ্ধ করেছেন ধ্বংসের রোজনামচা!

একই ভাবে, আজকের এই লাগাতার ইজ়রায়েলি হামলার মধ্যেও সেই কাজটাই করে চলেছেন প্যালেস্টাইনি সাংবাদিকেরা। যেমন, একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের গাজ়া ব্যুরোর প্রধান ওয়ায়েল আল-দাহদু। কিছু দিন আগেই গাজ়ার এক শরণার্থী শিবিরে বোমাবর্ষণে দাহদু-র প্রায় গোটা পরিবারই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। তাঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, নাতি এবং পরিবারের আরও অন্তত আট জন প্রাণ হারিয়েছেন। অন্য বহু মানুষ এই পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পেশাদার জীবন থেকে হয়তো অব্যাহতি পেতে চাইতেন। কিন্তু সাংবাদিক দাহদু খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এ ভাবে তাঁদের কণ্ঠরোধ করা যাবে না। তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে যাবেন।

আর এই কাজ করতে গিয়ে ফের বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন দাহদু। মাত্র কয়েক দিন আগে গাজ়ার দক্ষিণ প্রান্ত, খান ইউনিসের বোমাবিধ্বস্ত একটি স্কুলের হাল সরেজমিন দেখার সময় ফের সেখানে ড্রোন হামলা চালায় ইজ়রায়েল, সাংবাদিকেরা সেখানে আছেন জেনেই চালায়। তাঁর সঙ্গে থাকা চিত্রসাংবাদিক সামের আবু দাকা রক্তাপ্লুত অবস্থায় পড়ে থাকেন। গুরুতর জখম হলেও সেখান থেকে বাইরে বেরোতে সক্ষম হন দাহদু। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দাহদু বলেন, সামের সাহায্য চেয়ে চিৎকার করছিল। অ্যাম্বুল্যান্স সামেরকে তুলতে গেলেও ইজ়রায়েলি সেনা রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় সেটি ফিরে আসতে বাধ্য হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রবল রক্তক্ষরণে মারা যান সামের।

বার বার অভিযোগ উঠছে, পরিকল্পিত ভাবে একে-একে হত্যা করা হচ্ছে যুদ্ধ কভার করা সাংবাদিকদের। যে কোনও মূল্যে সেনা অভিযানের ভয়াল ছবি ও প্রকৃত তথ্য বাইরে আসা আটকাতে চাইছে ইজ়রায়েল। ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজ়ায় মৃত্যু হয়েছে ৬৮ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীর। তাঁদের মধ্যে ৬১ জনই প্যালেস্টাইনি, চার জন ইজ়রায়েলি এবং তিন জন লেবাননের বাসিন্দা। এ ছাড়া, ১৩ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তিন জন এখনও নিখোঁজ এবং ২০ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

বিদ্যুৎ নেই, জলের হাহাকার, খাদ্যে তীব্র ঘাটতি। যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল অত্যন্ত করুণ। সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়া অন্যদের পক্ষে কল্পনা করাও শক্ত যে, এই কঠিন পরিস্থিতিতে খবর ও ছবি সংগ্রহ করা ও পাঠানো কত অসম্ভব কঠিন।

যে কোনও যুদ্ধের ক্ষেত্রেই প্রথম বলি হয় তথ্য ও সত্য। যুগে যুগে সেটাই হয়ে আসছে। একতরফা, বিভ্রান্তিকর, সম্পূর্ণ ভুল তথ্য ও তত্ত্ব চতুর্দিকে সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ‘ওয়র করেসপনডেন্ট’-দের কাজ করাটাও দুঃসাধ্যের। নিজেকে ও নিজের পরিবারকে চরম বিপদের মুখে ফেলেও কর্তব্যে অবিচল গাজ়ার সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তা হলে দায়িত্ব কার? দু’টি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এ ব্যাপারে ইজ়রায়েলি সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে আর্জি জানিয়েছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে কর্তব্যরত সাংবাদিকদের যেন হামলার লক্ষ্যবস্তু না করা হয়। কিন্তু সেনা কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কোনও দায়িত্ব তাঁরা নিতে পারবেন না।

দায়িত্ব নিতে না পারা বা না চাওয়া এক রকম। সাংবাদিকদের ‘টার্গেট’ করে মারা— আলাদা রকম। ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে বার বার গুরুতর অভিযোগ উঠছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের। কিন্তু প্রবল ইহুদিজাতিবাদের দাপটে সে সব অভিযোগে কান দেবে কে?

আয়াত খাদুরা-র কথা মনে পড়ছে। ২৭ বছরের এই তরুণী মূলত পডকাস্ট ও ডিজিটাল মাধ্যমে সাংবাদিকতা করতেন। কয়েক দিন আগে উত্তর গাজ়ার বেট লাহিয়া প্রোজেক্ট অঞ্চলে যখন ফসফরাস বোমা ফেলছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা, ফেলা হচ্ছে ভয়াবহ সাউন্ড বম্ব, আকাশ থেকে ছড়ানো হচ্ছে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ, সে সময়ে পোস্ট করা ভিডিয়োয় আয়াত বলছেন, “এটাই সম্ভবত আমার শেষ ভিডিয়ো।... প্রায় গোটা এলাকা খালি হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকে রাস্তা দিয়ে পাগলের মতো দৌড়চ্ছে। কেউ জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে বা কোথা থেকে আসছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।... পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ানক! হয়তো ঈশ্বর আমাদের দয়া করবেন।”

না, আয়াত ও তাঁর পরিবারকে কেউ দয়া করেননি। ইজ়রায়েলি বোমা গোটা পরিবারকে এক লহমায় অতীত করে দেয়।

সাংবাদিকরা আরও অসংখ্য অসামরিক মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা আরও কয়েক জন মাত্র। অন্যদের সঙ্গে তাঁদের তফাত সামান্যই— তাঁরা সত্য ও তথ্যকে সামনে আনতে চান। চান মিথ্যের ব্যবসা করা প্রতিহিংসাপরায়ণ এই দুনিয়ায় ইতিহাসের প্রকৃত অধ্যায় লিখে যেতে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Israel-Palestine Conflict Israel-Hamas Conflict Journalists Deaths

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy