Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
শিল্পীর অবস্থান বা সমাজ-প্রত্যাশিত ব্যবহার: সবেতেই আলাদা
Artist

ছকভাঙা মেয়ের দাপট

শেষের দিক থেকে শুরু করা যাক। ঝিনুকের ঠাম্মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও সুচিত্রা শেষ জীবনে থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার একটি বহুতল বাড়িতে।

ভূমিকা: দহন ছায়াছবির শুটিং-এ ইন্দ্রাণী হালদার, সুচিত্রা মিত্র (মাঝে) ও পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ, ১৯৯৬।

ভূমিকা: দহন ছায়াছবির শুটিং-এ ইন্দ্রাণী হালদার, সুচিত্রা মিত্র (মাঝে) ও পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ, ১৯৯৬।

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৮
Share: Save:

মনে আছে ঝিনুকের ঠাম্মাকে? সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন ছবিতে এক অন্য রকম ঠাম্মাকে দেখা গিয়েছিল, যিনি বৃদ্ধাশ্রমে বই-গান-গাছপালা নিয়ে নিজের মতো করে বাঁচেন এবং নাতনিকে সাহস দেন সামাজিক চাপের কাছে নত না হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। ঠাম্মার ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছিলেন, সেই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের জন্ম শতবর্ষ উদ্‌যাপন শুরু হয়েছে। বহু লেখালিখি ও নানা স্মরণ-অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত জগৎকে তিনি কত ভাবে ঋদ্ধ করেছেন, অল্প বয়সে গণনাট্য আন্দোলনের কর্মী হিসাবে রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি কী ভাবে মাঠে-ময়দানে মানুষের মধ্যে নিয়ে গেছেন— সেই সব দিক নিয়ে জরুরি চর্চা হচ্ছে।

একটি সিনেমায় সুচিত্রা মিত্রর ভূমিকার উল্লেখ দিয়ে শুরু করলাম বলে, তাঁর কম বয়সে করা কিছু নাটক ও পরের দিকে তিন-চারটে ছায়াছবিতে অভিনয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, একেবারেই তা নয়। বরং বলতে চাই, মৃণাল সেনের পদাতিক (১৯৭৩) ও ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন (১৯৯৭)— সে দু’টিতেই মনে হয়েছে সুচিত্রা মিত্র তাঁর জীবনের কথা বলছেন— আজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করেও যে জীবনে বেশ কিছু স্টিরিয়োটাইপ ভাঙতে ভাঙতে তিনি গিয়েছেন অথবা গড়েছেন এক অন্য রকম আত্মপরিচয়। সেই অন্য রকম বাঁচা নিয়ে কথাবার্তা কম হলেও, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের পাশাপাশি মেয়েদের সসম্মানে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তাঁর ছক ভাঙার তাৎপর্য কিছুমাত্র কম নয়।

শেষের দিক থেকে শুরু করা যাক। ঝিনুকের ঠাম্মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও সুচিত্রা শেষ জীবনে থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার একটি বহুতল বাড়িতে। ওঁর এক প্রতিবেশী তথা আমার সহপাঠীর কাছে শুনেছিলাম, সেখানকার কলেজ-পড়ুয়ারা আশির দশকে এক বার ৩১ ডিসেম্বর একটি ‘নিউ ইয়ার পার্টি’র আয়োজন করে এবং সেখানে বাইরের বন্ধু-বান্ধবদেরও আমন্ত্রণ জানায়। এ ভাবে ছেলেমেয়েদের একত্রে বর্ষশেষ উদ্‌যাপন নিয়ে ৩৬-৩৭ বছর আগে ওই আবাসনের অনেকে আপত্তি জানালেও, সুচিত্রা মিত্র সে সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে নিজে অপূর্ব একটি পদ রান্না করে সেই পার্টিতে পাঠান, এবং সবাই কেমন নাচ-গান-আনন্দ করছে, এক বার উঁকি দিয়ে দেখেও যান।

এই ঘটনার ৪৫-৪৬ বছর আগে যদি আমরা ফিরে যাই তা হলে দেখা যাবে যে, অনাদি দস্তিদারের কাছে গানের তালিম নিতে থাকা ষোড়শী সুচিত্রাকে তাঁর বাবা সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে পাঠাতে একদম রাজি ছিলেন না। সুচিত্রার বোনঝি বিজয়া গোস্বামীর কাছে জেনেছি যে সৌরীন্দ্রমোহন মনে করতেন, শান্তিনিকেতনে গেলে মেয়েরা অবাধ মেলামেশার সুযোগ পায়, বেলেল্লাপনা শেখে! তাঁর দুই দিদি সুজাতা ও সুপ্রিয়া বাবা-মা’কে রাজি করানোয় অগ্রণী ভূমিকা না নিলে হয়তো সুচিত্রার ১৯৪১-এ শান্তিনিকেতনে চার বছরের জন্য যাওয়াই হত না। দিদিরা তত দিনে গণনাট্য আন্দোলন ও বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানা কিছু পড়ছেন, বাবার অমতে নানা জায়গায় যেতে শুরু করেছেন, বাড়িতে খানিকটা অন্য হাওয়া বইয়ে দিচ্ছেন।

সুচিত্রা মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন সঙ্গীতভবনে পড়ার জন্য, কিন্তু খরচ লাগত সাতাশ টাকা। তখন যুদ্ধের সময়। বড়দি এআরপি-তে চাকরি করে এবং কলেজছাত্রী মেজদি টিউশনি করে নিজেদের রোজগার থেকে ছোট বোনকে ওই অতিরিক্ত সাত টাকা পাঠাতেন প্রতি মাসে। দিদিদের এই সংহতি, ছাত্রাবস্থায় শান্তিনিকেতনের স্বাদ পাওয়া এবং প্রায় একই সময়ে গণআন্দোলনে যুক্ত হওয়া সুচিত্রাকে একটা অন্য রকম জীবনের সন্ধান দিয়েছিল নিশ্চিত— যে জীবনে নারী-পুরুষ একত্রে শালবীথি দিয়ে পূর্ণিমা রাতে গান গাইতে গাইতে হাঁটা যায়, আবার দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা-পীড়িত মানুষদের জন্য কলকাতার রাজপথে গান গেয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করা যায়।

তার পরের ৫০-৬০ বছরে সুচিত্রা মিত্র শুধু যে গান গেয়ে এবং গান শিখিয়ে বহু মানুষের মন জয় করেছেন, তা-ই নয়। তরুণী শিল্পী গানকে সম্বল করে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসার চালিয়েছেন, ছেলেকে বড় করেছেন, কন্যাসমা ভাইঝিকেও। আজকের ভাষায় যাকে বলা যায় ‘সিঙ্গল পেরেন্টিং’, তা তিনি করেছেন আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে, যদিও তাঁর বাবা-মা-দাদা-বৌদি এ কাজে পাশে ছিলেন এবং তিনি নিজে স্বনির্ভর হয়ে আত্মসম্মানের সঙ্গে নিজের মতো জীবন গড়ে নিচ্ছিলেন।

দাম্পত্য সম্পর্কে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অসম্মান ও অত্যাচার সহ্য করে বিয়ে টিকিয়ে না রেখে, সমাজের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ব্যতিক্রমী বললেও প্রায় কিছুই বলা হয় না। আজও বহু উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে পারিবারিক ও সামাজিক চাপের কাছে মাথা নুইয়ে বিয়ের মধ্যে অনেক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মেনে নিতে বাধ্য হন। রাশ টানা হয় তাঁদের বিজ্ঞান, খেলাধুলা বা সঙ্গীতচর্চায়!

লিখতে লিখতে মনে পড়ছে আর এক সঙ্গীতসাধক, রবীন্দ্রস্নেহধন্যা সাহানা দেবীর কথা। সুচিত্রার মায়ের প্রজন্মের মানুষ, গত বছর তাঁর জন্মের ১২৫ বছর পেরিয়ে গেল। গ্লানিময় দাম্পত্য জীবন ছেড়ে পাঁচ বছরের মাথায় বেরিয়ে এসেছিলেন তিনিও। সেটা বিশ শতকের কুড়ির দশক। মধ্যবিত্ত পরিবারের এক বিবাহবিচ্ছিন্নার পক্ষে একা বেঁচে থাকা ও সঙ্গীতচর্চা চালিয়ে যাওয়া নিশ্চয় তখন আরও বহু গুণ কঠিন ছিল। সাহানা কিছু দিন পরিব্রাজকের জীবন কাটিয়ে ১৯২৮ সালে থিতু হয়েছিলেন পণ্ডিচেরি অধুনা পুদুচেরির অরবিন্দ আশ্রমে। সেখানে তাঁর গান ও সেই সঙ্গে নাচ— যা কিনা ছোট থেকেই তাঁর খুব প্রিয়— বহাল ছিল বেশ কিছু বছর।

সুচিত্রা পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে যখন গণনাট্য আন্দোলন ও শান্তি আন্দোলনে সক্রিয়, সেই সময় থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে শুরু করেন। শ্বশুরবাড়িতে ‘গীতাঞ্জলি’ নামে গানের স্কুল চালাতেন, বিবাহবিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ভেঙে যেতে বাধ্য হয়েছিল সেটাও। তার পর দ্বিজেন চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ‘রবিতীর্থ’ স্কুলকে কয়েক দশক ধরে যৌথ ভাবে লালন করেন সুচিত্রা-দ্বিজেন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে গড়ে তোলেন সেখানকার রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগ।

এখানে বলা দরকার, গবেষকরা সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেখিয়েছেন যে, গণনাট্য আন্দোলনের বেশ কিছু গুণী কর্মী বিয়ের পর সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের চাপ অথবা পার্টিগত কারণে পরবর্তী কালে নিজেদের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাতে পারেননি। সুচিত্রা পেরেছিলেন— নিজের মতো করে বাঁচার জন্য যে সাহস লাগে, তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল ভাবে। সেই সঙ্গে মিলেছিল গভীর রবীন্দ্র-বীক্ষণ ও রাজনীতি-সচেতনতা।

চুল ছেঁটে ফেলে, হাতকাটা ব্লাউজ় পরে, কপালে টিপ না দিয়ে, দৃপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে, সাজসজ্জায় একটা সম্পূর্ণ অনাড়ম্বর ‘ওয়ার্কিং উয়োম্যান’ লুক এনেও যে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া যায়, জীবিকা ও খ্যাতি দুটোই অর্জন করা যায়, মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নেওয়া যায়, সেটা বোধ হয় আমরা সুচিত্রা মিত্র-র কাছেই প্রথম জেনেছি। তাঁর সেই নিজস্ব স্টাইলে তিনি অনায়াসে ঘুরে বেড়িয়েছেন ঘরে-বাইরে, নানা পরিসরে। এক জন নারী ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর অবস্থান থেকে সমাজ-প্রত্যাশিত সাজসজ্জা, চালচলন, গান গাওয়ার ধরন, গান নির্বাচন— এই সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র। উত্তরের দিকের জানলা তাঁর খোলাই ছিল। তাই হয়তো অচলায়তনের গানগুলো ফিরে ফিরে গাইতেন মুক্ত জীবনবোধের প্রতীক এই শিল্পী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Cinema Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE