জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার...।” কুড়ি বছর আগে আচমকা যে ভয় বাংলাদেশের গলা চেপে ধরেছিল, তা থেকে যেন বেরিয়েই আসা যাচ্ছে না। আজও সেই আতঙ্ক, ভয় আমাদের তাড়া করে; অজানা শঙ্কায় তড়িঘড়ি শেষ হয় পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা নামার আগে ঘরে ঢোকার নির্দেশনার পিছনে যত না নিরাপত্তার তাগিদ, তারও বেশি কাজ করে আতঙ্ক। ১৪০৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ, ইংরেজি বছরের হিসেবে ২০০১-এর ১৪ এপ্রিল, বাঙালির সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে, বাঙালিকে ভয় দেখাতে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল ঢাকায়— রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ন’জন সংস্কৃতিকর্মী, এক জন দর্শকও। আহত হন অগণিত মানুষ। তাঁদের অনেকেই আজও বয়ে চলেছেন স্প্লিন্টারের ক্ষত।
শুধু সে দিনের আহতরাই নন, এই আঘাত আজও বয়ে চলেছেন প্রত্যেক বাঙালি। বাঙালি জাতির সর্বজনীন উৎসবের গায়েই এ যেন লেপে দিয়েছে কালিমা। তার পর থেকে গত বিশ বছরে রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে, আনুষ্ঠানিক ভাবেই বর্ষবরণের জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ। এসেছেন এ বারও। কিন্তু সে দিনের আতঙ্ক এখনও মোছেনি। সে জন্যেই আজও হামলার আশঙ্কায় সন্ধের আগেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশ থাকে।
নিজস্ব বর্ষপঞ্জি আছে, এমন সব জাতির সব মানুষই বছরের প্রথম দিনটিকে স্বাগত জানাতে নিজভূমে উৎসব করে থাকেন। আমাদের সৌভাগ্য— জাতি হিসেবে গর্বেরও— আমাদের নিজস্ব পঞ্জিকা আছে। বর্ষবরণ উৎসব আছে। বৈশাখী উৎসবের আজ যে রং, শুরুতে তা ছিল না। কালে কালে এর পরতে পরতে যোগ হয় নানা পর্ব। উৎসবকে তা দিয়েছে নতুন মাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ। এরও আগে যোগ হয় ‘ছায়ানট’-এর সঙ্গীতানুষ্ঠান। পান্তা-ইলিশ যুগলবন্দি ছাড়া আজ বর্ষবরণ ভাবাই যায় না। পয়লা বৈশাখে সূর্যোদয়ের পর রমনার বটমূলে গানে গানে শুরু হয় বর্ষবরণ। ‘ছায়ানট’-এর এই সঙ্গীতানুষ্ঠানও বাঙালির বর্ষবরণের ঐতিহ্য।
বাংলাদেশের মানুষ যখন পাকিস্তানিদের শাসন ও শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিলেন, বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার পথ রুদ্ধ করার নানা অপচেষ্টা চলছিল যখন, তখনই জেগে উঠতে থাকে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা, অসাম্প্রদায়িক ভাবনা। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা স্বাজাত্যবোধ আমাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ১৯৭১-এ এসে সেই স্বপ্ন সত্যি হয়। যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছি, তারই চূড়ান্ত পরিণতি একাত্তর। ১৯৭১-ই বাঙালিকে অসাম্প্রদায়িকতার পথে ধাবিত করে। বাঙালি ভুলে যায় হিন্দু-মুসলমান বিরোধ। তখন আমাদের পরিচয় কেবল মানুষ, শুধুই বাঙালি। সে দিন বিপদাপন্ন হিন্দু অথবা মুসলিম একে অন্যকে আশ্রয় ও সান্ত্বনা দিতে দ্বিধা করেননি। ধর্মীয় পরিচয় হয়ে পড়েছিল গৌণ, বাঙালিয়ানাই হয়ে উঠেছিল জাতিসত্তার অভিজ্ঞান।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্যও ছিল প্রকৃত অর্থে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে রাজনীতির জটিল-কুটিল পাকচক্রে অসাম্প্রদায়িকতার সেই সুতো ছিঁড়তে শুরু করে। রাজনীতিতে ক্রমেই বাড়তে থাকে ধর্মের ব্যবহার। হুমকির মুখে পড়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চেতনা। তারই সুযোগ নেয় ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী। আঘাত হানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিভূ পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। সর্বজনীন উৎসবের গায়ে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ছাপ মারার চেষ্টা করে।
করোনার অতিমারি পিছনে ফেলে আসার পর, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে, জাতপাত ও ধর্মের বিভেদ ভুলতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার গুরুত্ব অনেক। আর এ ক্ষেত্রেই বাঙালির জাতিগত ঐতিহ্যের বিপুল সম্ভাবনার শক্তি। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, পয়লা বৈশাখের মতো সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক ও নিজস্ব একটি উৎসব বাঙালির রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে পয়লা বৈশাখের মতো উৎসবের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা যত বাড়বে, আমাদের মুক্ত মানুষ হয়ে ওঠার পথও তত মসৃণ হবে। মুক্ত মানুষই পারে দেশকে ভালবাসতে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। মুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগাতে, নববর্ষের এই উৎসবকে সর্বজনীন করতে মনে করাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কয়েক কোটি মানুষ এখনও আমাদের মধ্যে আছেন। তাঁদের স্মৃতিচারণ, স্মৃতিকথা সংগ্রহের মাধ্যমে যেমন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সেই
দিনগুলো ফিরে দেখা সম্ভব, তেমনই এই স্মৃতিতে ভর করেই আমরা নির্মাণ করতে পারি অসাম্প্রদায়িকতার নতুন দিন। পয়লা বৈশাখের উৎসব বাঙালির সেই স্মৃতি-ফেরানো, অসাম্প্রদায়িক চেতনারই নান্দীমুখ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy