Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ডবল ইঞ্জিনের রূপকথা
Narendra Modi

গুজরাতে শিল্পায়ন-পর্ব বা হরিয়ানার বেকারত্ব-চূড়া তবে হল কী করে

২০১৪-য় প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রথমেই তাই যোজনা কমিশন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২১ ০৫:৩৯
Share: Save:

ইন্ডিয়া, অর্থাৎ ভারত, রাজ্যসমূহের সঙ্ঘ হইবে’। দেশের সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্য। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূলমন্ত্র। দেশের রাজধানীতে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্যগুলিতে নিজস্ব সরকার। সংবিধান প্রণেতারা কোথাও বলেননি, কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার চলতে হবে।
এখন যদি কেন্দ্রে ও সব রাজ্যে একই দলের সরকার চলে, তা হলে কেমন হয়? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রীর কথা মতো চলবেন। রাজ্য সরকার যখন যা দাবি করবে, কেন্দ্র এক কথায় মিটিয়ে দেবে। কেন্দ্র দাবি না মেটালেও মুখ্যমন্ত্রীরা রা কাড়বেন না। কোথাও কোনও বিরোধ থাকবে না, ঝগড়াঝাঁটি থাকবে না। যদি কোনও রাজ্য ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করে? কেন্দ্রীয় সরকার দোষ ধরবে না। কেন্দ্রের সরকার গাফিলতি করলেও সব রাজ্য মুখ বুজে থাকবে। নিজেদের দলেরই সরকার কিনা!


নিখুঁত সুখী সংসারের ছবি!


প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইদানী‌ং এমনই এক সুখী সংসারের কথা বলছেন। ‘ডবল ইঞ্জিন’-এর সরকার। কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায়, রাজ্যেও সে দল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হয়ে প্রচারে অধুনা এটাই তাঁর মূলমন্ত্র। তাঁর দাবি, সোনার বাংলার জন্য কেন্দ্রের মতো রাজ্যেও বিজেপির সরকার চাই।
যে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাই চান, তাঁর দল ভোটে জিতুক। বিজেপির কান্ডারি হিসেবে মোদী তেমনটাই চাইবেন। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য তাঁর সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই ডবল ইঞ্জিনের সরকারের তত্ত্বটি সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।


কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার এই প্রচার নতুন নয়। কেন্দ্রে যখন মনমোহন সরকার ছিল, তখনও সনিয়া-রাহুল গাঁধীরা বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে বলতেন, রাজ্যেও কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মানুষ লাভবান হবে। বাংলায় বামফ্রন্ট সরকার ৩৪ বছরে নিয়মিত কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলত। ভাবটা ছিল, কেন্দ্রে বামফ্রন্ট সরকার এলেই বঙ্গের ছবি পাল্টে যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তিনি বঞ্চনার নালিশের সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রকল্প না মানার নীতি নিয়েছেন। মোদী সরকার ‘আয়ুষ্মান ভারত’ চালু করতে বললে, তিনি নারাজ। তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প চালু করেছেন। মোদী সরকার কৃষকদের সরাসরি টাকা পাঠাতে চাইলে, তাঁর দাবি, রাজ্যকে টাকা দেওয়া হোক। রাজ্য নিজের মতো বিলি করবে।


প্রধানমন্ত্রী মোদী ঠিক এই দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলছেন। অভিযোগ করছেন, যেখানে ডবল ইঞ্জিনের সরকার নেই, সেখানে গরিবের উপকারের নীতি ধাক্কা খাচ্ছে। অথবা ধীর গতিতে চলছে। অতএব, রাজ্যের উচিত কেন্দ্রের কথামতো চলা।


অথচ, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই নরেন্দ্র মোদীই কিন্তু রাজ্যকে যথাসম্ভব আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলতেন। দিল্লিতে এসে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি প্রকল্পের বিরুদ্ধে সওয়াল করতেন। যুক্তি দিতেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্প চলে কেন্দ্রের কর্মসূচি অনুযায়ী। ধরে নেওয়া হয়, দিল্লি থেকে তৈরি প্রকল্প দেশের সর্বত্র সব অভাব মেটাবে। কোন রাজ্যের কোথায় অগ্রাধিকার, ভাবা হয় না। এই একই কারণে যোজনা কমিশনেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।


২০১৪-য় প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রথমেই তাই যোজনা কমিশন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নীতি স্পষ্ট ছিল। ভারত রাজ্যসমূহের সঙ্ঘ হতে পারে। তা বলে রাজ্যগুলি স্রেফ কেন্দ্রের উপাঙ্গ হয়ে থাকতে চায় না। রাজ্যগুলি কেন্দ্রের কথামতো চলবে না। নীতি আয়োগ গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাই ‘সহযোগিতামূলক কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক’-এর কথা বলেছিলেন। রাজ্যগুলির মধ্যে উন্নয়নের দৌড়ে সুস্থ প্রতিযোগিতার কথা বলেছিলেন।


তার পরে সাত বছর কেটে গিয়েছে। দীর্ঘ সময়। প্রধানমন্ত্রী এখন সংঘাত এড়িয়ে সহযোগিতার বদলে কেন্দ্রে ও রাজ্যে এক সরকারের সমাধান বাতলাচ্ছেন। যিনি রাজ্যগুলির মধ্যে উন্নয়নের সুস্থ প্রতিযোগিতার কথা বলেছিলেন, তিনিই এখন বিজেপি শাসিত রাজ্যে গিয়ে বলছেন, এখানে ডবল ইঞ্জিনের সরকার চলছে বলে উন্নয়ন হয়েছে। যে রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন নেই, সেখানে উন্নয়নও হয়নি।


এমনিতেই মোদী জমানার সাত বছরে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কেন্দ্রের দিকেই আরও ঝুঁকে পড়ছে। জিএসটি চালুর পরে রাজ্যের হাতে কর বসানোর ক্ষমতা খুব সামান্য। কেন্দ্রের করের ভাগ, অনুদানের উপরে রাজ্যের নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বিরোধী নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে আরও কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করেছেন। এবং তাতে একটা অদ্ভুত মিল। উজ্জ্বলা, পিএম কিসান, স্বচ্ছ ভারত, আয়ুষ্মান ভারত— সবই প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সরাসরি ভোটারদের, থুড়ি, দেশের নাগরিকদের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্প। সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্যের আওতা সুস্পষ্ট ভাগ করে দেওয়া রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের আওতায় থাকা ক্ষেত্রে কেন্দ্র এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি টাকা ঢালছে। কারণ, তাতে রাজ্যের মানুষের মন জয় করা সহজ। তাই রাজ্যের ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে কুক্ষিগত করে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। এমনকি হালফিলে বিতর্কিত কৃষি আইনও আদতে রাজ্যের অধিকারে নাক গলানো বলে অভিযোগ।


কেন এই নাক গলানো?


যুক্তিগুলোর মধ্যেও অদ্ভুত মিল। কখনও ‘এক রাষ্ট্র, এক কর’, ‘এক রাষ্ট্র, এক বাজার’, কখনও আবার ‘এক রাষ্ট্র, এক রেশন কার্ড’। এবং ‘এক রাষ্ট্র, এক ভোট’। কেন্দ্রের সরকার এখন চায়, লোকসভার সঙ্গে সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট হোক। সে ক্ষেত্রে লোকসভায় তাঁরা জিতলে সিংহভাগ রাজ্যেও তাঁরাই জিতবেন বলেই বিজেপি নেতৃত্ব আশা করতেই পারেন। পরিসংখ্যানও সে কথাই বলে। আইডিএফসি ইনস্টিটিউটের ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৯ ও ২০১৪-র লোকসভা ভোটের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট হলে ভোটারদের একই দলকে দু’জায়গাতেই ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ। সমীক্ষা বলছে, ১৯৮৯ থেকে ৩১ বার কোনও না কোনও রাজ্যে লোকসভা ভোটের সঙ্গেই বিধানসভা ভোট হয়েছে। ২৪টি ক্ষেত্রে কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দল জিতেছে।
অর্থাৎ, ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’ ও ‘এক রাষ্ট্র, এক ভোট’-এর মূল সুর একটাই। কেন্দ্রে ও সব রাজ্যে একই দলের সরকার।
২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও গত তিন বছরে রাজ্যওয়াড়ি বিধানসভা ভোটে বিজেপির ফল মোটেই আহামরি কিছু নয়। ২০১৭-র পর থেকেই বিজেপি একার জোরে তেমন কোনও বড় রাজ্যে মসৃণ ভাবে ভোটে জেতেনি। অনেক রাজ্যে অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সরকার গড়েছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠে, বিজেপি হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গের ভোটে জিততে এমন মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কেন? বিধানসভা ভোটের ফলে এই খরাও তার বড় কারণ। পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিলে আসন্ন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে এক অসম বাদে বিজেপি আর কোথাও নিজের জোরে জেতার অবস্থায় নেই। আর সেই কারণেই ডবল ইঞ্জিন সরকারের স্বপ্ন বিলি।


প্রশ্ন হল, ডবল ইঞ্জিনের সরকারে কি সত্যিই রাজ্যের লাভ হয়?


গত সাত বছর ধরে গুজরাতে কেন্দ্রের মতোই বিজেপি সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে গুজরাতের বিশেষ উন্নতি হয়নি। শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতা, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা বা স্টান্টিং, কম ওজন, সদ্যোজাত বা পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুমৃত্যুর হারে গুজরাত অনেক রাজ্যের তুলনাতেও পিছিয়ে। স্কুলের ড্রপআউট কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও গুজরাতের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ভাল ফল করেছে। আর গুজরাতকে যদি নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন শিল্পায়নে এগিয়ে দিয়ে থাকেন, তাতে ডবল ইঞ্জিনের দরকার পড়েনি।


ফেব্রুয়ারি মাসে বেকারত্বের হারে হরিয়ানা দেশের মধ্যে শীর্ষে ছিল। সেখানেও তো সাত বছর ধরে ডবল ইঞ্জিনের সরকারই চলছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE