E-Paper

শরণার্থী দিবসের প্রহসন

রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর)-এর সংজ্ঞা অনুসারে, বাস্তুচ্যুত মানুষ চারটি গোত্রে পড়তে পারেন।

অনিন্দিতা ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫ ০৮:৩৭
জীবনযাপন: ইজ়রায়েলি হানায় ধ্বস্ত বাস-অঞ্চল ঘুরে দেখছেন আশ্রয়হারা মানুষ, জাবালিয়া উদ্বাস্তু শিবির, গাজ়া, ৩০ মে।

জীবনযাপন: ইজ়রায়েলি হানায় ধ্বস্ত বাস-অঞ্চল ঘুরে দেখছেন আশ্রয়হারা মানুষ, জাবালিয়া উদ্বাস্তু শিবির, গাজ়া, ৩০ মে। ছবি রয়টার্স।

গত শুক্রবার ছিল বিশ্ব শরণার্থী দিবস। ২০০১ সাল থেকে, প্রতি বছরের মতো এ বারেও বিশ্ব জুড়ে শরণার্থীদের বাস্তুচ্যুতির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জনমানসে সচেতনতা এবং সহানুভূতি তৈরি করার জন্য, রাষ্ট্রপুঞ্জ বিশ্ব উদ্বাস্তু দিবস উদ্‌যাপনের আয়োজন করে। সংঘাত বা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে, বিভিন্ন দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষদের নাগরিক অধিকার, মানবিক সম্পদ, ইচ্ছাশক্তি, স্বপ্নের উপর আলোকপাত করে, তাঁদের সাহসকে সম্মান জানানোর জন্য এই উদ্‌যাপন করা হয়। বিশ্ব জুড়ে পরিবর্তিত রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তার মধ্যে বাস্তুহারা মানুষদের ন্যূনতম অধিকারের মতো জটিল বিষয়কে মাথায় রেখে এ বারের উদ্‌যাপনের থিম ছিল, ‘সলিডারিটি উইথ রিফিউজিস’ বা শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি। তার সঙ্গে শরণার্থী সপ্তাহ পালনের জন্য থিম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘কমিউনিটি অ্যাজ় আ সুপার-পাওয়ার’ বা একটা পরাশক্তি হিসাবে উদ্বাস্তু সম্প্রদায়। এই শব্দবন্ধের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় হিসেবে শরণার্থীদের দৈনন্দিন জীবনকে মর্যাদা দেওয়া, তাঁদের অস্তিত্বের পুনর্নির্মাণ, সম্মিলিত ভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে তাঁদের ক্ষমতায়নের বার্তা দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর)-এর সংজ্ঞা অনুসারে, বাস্তুচ্যুত মানুষ চারটি গোত্রে পড়তে পারেন। এক, রিফিউজি বা উদ্বাস্তু, যাঁরা সংঘাত, হিংসা বা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে নিরাপদতর আশ্রয়ের সন্ধানে এসেছেন; দুই, ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পার্সনস বা অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ, যাঁরা সংঘাত, হিংসা, নিপীড়ন বা বিপর্যয়ের কারণে নিজেদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু দেশেই রয়েছেন; তিন, অ্যাসাইলাম সিকার বা রাজনৈতিক শরণার্থী, যাঁরা অন্য দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চান; এবং চার, স্টেটলেস পিপল বা রাষ্ট্রহীন মানুষ, কোনও দেশই যাঁদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না। ২০২৫ সালের এপ্রিল অবধি বিশ্বব্যাপী মোট ১২.২১ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩.৬৮ কোটি উদ্বাস্তু ছাড়াও, এক বিরাট সংখ্যক অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ ও আশ্রয়প্রার্থী আছেন।

গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হয়ে চলেছে বিধ্বংসী যুদ্ধ— যার ফলে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু তকমা পাচ্ছেন। এই যেমন, পশ্চিম এশিয়া। ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল নামক রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পর থেকে প্রায় গোটা আরব ভূখণ্ড উদ্বাস্তু শব্দের সঙ্গে চিরকালীন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। এ বারের সংঘাত শুরুর অনেক আগে থেকে জর্ডন, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজ়া, সিরিয়া ও লেবাননে মোট ৫৮টি নিবন্ধিত সরকারি প্যালেস্টাইনি শরণার্থী শিবির ছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, হামাসের নৃশংস আক্রমণের পাল্টা হিসাবে ইজ়রায়েল যে বিধ্বংসী অভিযান শুরু করে, তাতে অবিরাম বোমাবর্ষণ, জোর করে স্থানান্তরকরণের ফলে গাজ়ার ২১ লক্ষ জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা প্রায় ১০ বা ততোধিক বার অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গাজ়া-য় এখন কার্যত কোনও নিরাপদ পথ বা আশ্রয় নেই, কারণ ইজ়রায়েল যুদ্ধ আইনত সুরক্ষিত জায়গাগুলোকেও ধ্বংস করেছে।

১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের দু’বছর আগে, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের প্যালেস্টাইনি শরণার্থীদের ত্রাণ কর্ম সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-র অধীনে প্যালেস্টাইনি শরণার্থীরা সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার। সমস্যার বিষয় হল, প্যালেস্টাইনিদের জন্য অনুচ্ছেদ ১ডি (যা অন্যথায় ‘বহির্ভূত ধারা’ নামে পরিচিত) থাকার জন্য ইউএনএইচসিআর-এর মতো সংস্থাগুলি থেকে এরা সহায়তা পায় না। গাজ়ার ২১ লক্ষের বেশি জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ লক্ষ প্যালেস্টাইনি ইউএনআরডব্লিউএ-র পরিষেবার উপর সরাসরি নির্ভরশীল, যাদের ৯০% শরণার্থী আবাসন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। ২০২৪ সালের অক্টোবরে, ইজ়রায়েল আইন পাশ করে ইউএনআরডব্লিউএ-কে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে, সঙ্গে অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেম-সহ ইজ়রায়েলের ভূমিতে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। তার পর থেকে প্যালেস্টাইনে তারা কেবল আংশিক ভাবে কাজ করতে পারছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। ফলে প্যালেস্টাইনি শরণার্থীরা ন্যূনতম খাদ্য, জল, আশ্রয় এবং ওষুধ খুঁজে পাওয়ার জন্য নিদারুণ লড়াই করছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইজ়রায়েলের নো-এক্সিট পলিসি, যা গাজ়া এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মধ্যে যাতায়াতকেও নিষিদ্ধ করেছে। সীমান্ত দিয়ে খাদ্য, জল, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। ত্রাণ বিতরণের ট্রাকগুলোকে দিনের পর দিন গাজ়ায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি, যেখানে একটা ট্রাকে ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ লোকের জীবন রক্ষার সহায়তা দেওয়ার সামগ্রী ছিল।

গাজ়ার বাস্তুচ্যুত মানুষ তাঁদের জীবনধারণের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের উপর একান্ত নির্ভরশীল। ৮২% মানুষ প্রতি দিন এক লিটার পানীয় জলও পাচ্ছেন না। দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি গুরুতর। এই পরিস্থিতিতে, অন্যান্য সহায়তা বন্ধ করে আমেরিকা আর ইজ়রায়েল তৈরি করেছে বিকল্প গাজ়া হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন। প্যালেস্টাইনি শরণার্থীদের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান ফিলিপ লাজ়ারিনির মতে— “এই সহায়তা বিতরণ আসলে মৃত্যুফাঁদের শামিল।” সাহায্য-কেন্দ্রগুলি খোলার পর থেকে ইজ়রায়েলি বাহিনী নাকি শরণার্থীদের উপরে একাধিক ক্ষেত্রে গুলি চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আমেরিকাকে পাশে রেখে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছেন।

ইউরোপের দিকে তাকালেও শরণার্থী সঙ্কটের ছবি একই রকম বৃহৎ ও ভয়ঙ্কর। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ চতুর্থ বছরে পা দিয়েছে। রাশিয়ান ফেডারেশনের আক্রমণের ফলে প্রায় ৬৯ লক্ষ ইউক্রেনীয় নাগরিক শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। ইউক্রেনীয় শরণার্থী সঙ্কটের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হল অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজ়েশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর প্রকাশিত ইউক্রেন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট রিপোর্ট (জানুয়ারি ২০২৫) অনুসারে, অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির সংখ্যা সেখানে প্রায় ৩৭ লক্ষ। যুদ্ধ-পূর্ব ইউক্রেনের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গারি, মলডোভার মতো দেশে এঁরা আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট হামলার ফলে ইউক্রেনে ব্যাপক মৃত্যু, ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, জ্বালানি পরিকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। দেশ জুড়ে ২৫ লক্ষের বেশি বাড়ি, মোট আবাসনের ১৩ শতাংশ, ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বস্ত। মনে করা হচ্ছে, ২০২৫ সালে ইউক্রেনের আনুমানিক ১.২৭ লক্ষ মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারণের জন্য সহায়তার প্রয়োজন হবে। অথচ, ইউরোপে এসে কিন্তু ইউক্রেনীয়রা প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা পেশাদার, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত। ফলে শ্রমবাজারের জন্য তাঁরা সম্পদ-স্বরূপ।

সুদান থেকে ইউক্রেন, হেইতি থেকে মায়ানমার, ভেনেজ়ুয়েলা, ইরিথ্রিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তানের মতো জায়গায়— এবং অবশ্যই প্যালেস্টাইনে— রেকর্ড সংখ্যক মানুষ জীবন রক্ষার জন্য রোজ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এক দিকে তাঁদের সংখ্যা বাড়ছে, অন্য দিকে তাঁদের জন্য সাহায্য-সহায়তার পরিমাণ কমছে। উদ্বাস্তু, অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ, আশ্রয়প্রার্থী এবং রাষ্ট্রহীন জনসম্প্রদায়ের সংজ্ঞা আস্তে আস্তে গুলিয়ে যাচ্ছে। এ বছরও বিশ্বে নানা স্থানে উদ্বাস্তু দিবস পালিত হল নিশ্চয়ই। কিন্তু, এই প্রহসন শেষ করে কবে সত্যিই শরণার্থীদের কথা শোনা হবে? কবে তাঁদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Refugees

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy