E-Paper

ইতিহাস আবেগ নয়

ভারত এখন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ইতিহাসের সঙ্গে সত্য, অর্ধসত্য, উত্তরসত্য, মিথ, গল্পগাথা সব একাকার হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের সমার্থক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘দেশপ্রেম’ নামক শব্দ।

শ্রীমন্তী রায়

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৩
স্মারক: সেলুলার জেল, আন্দামান।

স্মারক: সেলুলার জেল, আন্দামান।

দু’টি ঘটনার উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করি। আন্দামানের সেলুলার জেলের ফাঁসির ঘরের সামনে এক জন মা ও তাঁর ছ’সাত বছরের ছেলের মধ্যের কথোপকথন— “দেখেছ তো, যারাদুষ্টুমি করত, এখানে তাদের ধরে নিয়ে আসা হত। তুমি দুষ্টুমি করলে তোমাকেও ধরে নিয়ে আসা হবে। আর দুষ্টুমি করবে না তো?” পরে আমার আফসোস হল এটা ভেবে যে, কেন তখনই বাচ্চাটিকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম না শহিদদের কথা। ‘স্বাধীনতা দিবস’ শব্দ তো অচেনা নয় তার কাছে। দ্বিতীয় ঘটনার স্থানও সেলুলার জেলেরই লাইট হাউস। এক মহিলা তাঁর সঙ্গীকে বলছেন, এখন তো আর কাউকে রাখা হয় না। এ বার আর ভুল করিনি— এই জেলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অতি সংক্ষেপে বলার পর সেলুলার জেল সম্পর্কে যে বই কিনতে পাওয়া যায় তা কেনার এবং যে ফলকগুলি খোদাই করা আছে, সেগুলি পড়ার পরামর্শ দিয়ে এসেছিলাম!

দু’টি ঘটনা বৃহত্তর সমাজের ইতিহাস চেতনার যে ছবি তুলে ধরে, সেটি উদ্বেগের। বিশেষত এমন এক সময়ে, যেখানে সিনেমাকেও সঠিক ইতিহাসের মাপকাঠি বলে প্রচার করা হচ্ছে। আমাদের অধিকাংশেরই ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে স্কুলের পাঠ্যবইগুলির মাধ্যমে। কিন্তু, স্কুলে ইতিহাস বরাবরই দুয়োরানির মর্যাদাপ্রাপ্ত বিষয়। ইতিহাস সম্পর্কে তথাকথিত বহু ভাল পড়ুয়া এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা কাজ করে। তাদের কেউ এটা মনে করিয়ে দেয় না যে, আমাদের আত্মপরিচয়ের অন্যতম ভিত্তি আমাদের ইতিহাস। তার উপরে নির্ভর করেই দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ফলে, ‘ইতিহাস’ ভবিষ্যতে বিষয় হিসাবে না পড়লেও প্রাথমিক তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাসের একটা বিশ্লেষণাত্মক ধারণা থাকা জরুরি, যাতে পরবর্তী কালে কেউ ইতিহাসের পরিবর্তন করতে চাইলে তাকে অন্তত প্রশ্ন করার মানসিকতাটা তৈরি হয়।

ভারত এখন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ইতিহাসের সঙ্গে সত্য, অর্ধসত্য, উত্তরসত্য, মিথ, গল্পগাথা সব একাকার হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের সমার্থক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘দেশপ্রেম’ নামক শব্দ। এই ইতিহাসের প্রধান পুঁজি হল ‘আবেগ’, যাকে যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে বোঝার কোনও স্থান নেই। ইতিহাসমাত্রেই সেখানে একমুখী, সেই ইতিহাস মেনে নিলে ‘দেশপ্রেমী’, প্রশ্ন করলেই ‘দেশদ্রোহী’। ফলে প্রকৃত যুক্তিনিষ্ঠ ‘ইতিহাস চর্চা’র গুরুত্ব যে কতখানি, তা উত্তরোত্তর বোঝা যাচ্ছে।

বিষয়টা এমন নয় যে, সেলুলার জেল দেখতে যেতে হলে মুক্তিতীর্থ আন্দামান বা নির্বাসিতের আত্মকথা পড়ে যেতে হবে। কিন্তু যেখানে যাব তার ন্যূনতম পটভূমিকা জানাটা নিজের জন্যই খুব জরুরি, যাতে গোটা সেলুলার জেলের শুধুমাত্র একটা সেলকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কেন— এই প্রশ্ন মনের ভিতর আসে। প্রশ্ন আসে, ফলকগুলোতে পর পর বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম থাকা সত্ত্বেও লাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এ তাঁদের জন্য এত কম সময় বরাদ্দ কেন?

ইতিহাসমাত্রেই ‘স্মৃতি’ এটা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে সব ‘স্মৃতি’ই ইতিহাস হতে পারে না, কারণ স্মৃতি পরিবর্তনশীল। যে কোনও সময়ের উন্নতি কিংবা বিপন্নতার আখ্যান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্মৃতি আকারে সঞ্চিত হতে থাকে। যত দিন এগোয় তত তাতে বিভিন্ন রকমের প্রলেপ পড়তে থাকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সব প্রলেপের মধ্য থেকে মানুষ গড়ে তুলতে থাকে তার পছন্দসাপেক্ষ অতীত। ফলে অতীত নির্মিত হতে থাকে প্রয়োজন অনুযায়ী, পছন্দ অনুযায়ী। অন্য দিকে ইতিহাস পরিবর্তনশীল হলেও তাকে কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ইতিহাসের প্রলেপের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বর্তমানে ‘অতীত’কে গৌরবান্বিত করে তোলার প্রচেষ্টায় একটি গোষ্ঠী এতই তৎপর, ইতিহাস যে আসলে অতীতের ‘সত্য’ তুলে ধরার প্রয়াস, তা তারা ভুলতে বসেছে।

ইতিহাস হল তথ্যের উপর নির্ভর করে তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে যাচাই করে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সচেতন ও সমালোচনামূলক অনুসন্ধান। এ ছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল সেই সময়কালের প্রেক্ষিতও। এই প্রেক্ষিতগুলিই তথ্যকে অর্থবহ করে তোলে। সেলুলার জেলে রাজনৈতিক বন্দিদের লোহার বেড়ি পরিয়ে রাখা হত, কিংবা তাঁদের রোজ নারকেলের ছোবড়ার দড়ি তৈরি করতে হত, এগুলি ইতিহাসের তথ্য। কিন্তু এই লৌহবেড়িকেই বাঙালি রাজবন্দিরা ‘লৌহকপাটের লৌহ অলঙ্কার’ বলে অভিহিত করতেন। অমানুষিক পরিশ্রমের পরও তাঁরা বিভিন্ন বই পড়তেন, পত্রিকা বার করতেন। এমনকি ছেচল্লিশ দিন অনশন ধর্মঘট করে ‘ন্যায্য দাবি’ আদায়ও করেছিলেন। এই প্রেক্ষিত আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, সেই সময়ের বাঙালি বিপ্লবীদের মানসিক দৃঢ়তা কতটা ছিল। কতটা নিজের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসা থাকলে এই মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যবস্থাকে অলঙ্কারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জেনেও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্বপ্ন দেখা যায়। এই বোধ গড়ে উঠলে আর জেলের কুঠুরির মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ছবি তুলতে ইচ্ছা করে না। বরং একটা চাপা কষ্ট অনুভূত হয়।

বর্তমানে ভারতের ইতিহাস কী ভাবে পড়া হবে বা কী ভাবে পড়া উচিত, তা নিয়ে প্রবল আলোচনা শুরু হয়েছে। একটি গোষ্ঠীর বক্তব্য, যে ইতিহাস এত কাল পড়ে আসা হয়েছে তা প্রকৃত ইতিহাস নয়। কিন্তু, তার বদলে যে ইতিহাস প্রচার করা হচ্ছে, তার দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য। একটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, যা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, অপরটি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, যা ভারতীয় সংস্কৃতির নাম করে হিন্দু রক্ষণশীল সংস্কৃতিকেই একমাত্র ভারতীয় বলে স্থাপন করতে চায়। সেখানে ব্রাত্য করে দেওয়া হয় অ-হিন্দু সব কিছু। এই একমুখী ইতিহাস যে চিন্তাধারাকে সঙ্কীর্ণ করে তোলারই একটি প্রয়াস, সেটি দ্রুত উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বলা হয়, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর। কিন্তু তার চেয়েও সর্বনাশা হল ভুল বা খণ্ডিত ইতিহাস। তা শুধু আমার অতীতকে, আত্মপরিচয়কে নতুন চৌকাঠে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় না, আমার গোষ্ঠীকেও এমন এক পরিসরে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় যেখানে সে অন্য গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে প্রবল সন্দেহের চোখে দেখে।

রাজনৈতিক দলগুলির কাছে ‘ইতিহাস’ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মের মনের দখল এমন ভাবে নেওয়া, যাতে তারা সেই মত ছাড়া বাকি মতগুলিকে ব্রাত্য করে রাখে। ফলে নতুন কোনও চিন্তাধারার প্রশ্নও তাদের মনে আসতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই জাতীয় ইতিহাসের ভিত্তি যুক্তিহীনতা, আস্থা, আর আবেগের উপর নির্ভরশীল। তারা জাতীয়তাবাদের সমার্থক হিসাবে ইতিহাসকে গড়ে তুলতে চায়, কিন্তু জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার অন্যতম উপাদান হিসাবেই ইতিহাসের গুরুত্ব, তার সমার্থক হিসাবে নয়। বর্তমানে যে ভাবে পেশাদার ইতিহাসবিদেরা, বিশেষত বামপন্থী ইতিহাসবিদেরা এই গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, তা বৌদ্ধিক পরিসরের মতভেদ না রাজনৈতিক পরিসরের আক্রমণ, তা আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।

ইতিহাসের ক্ষেত্রে কোনও সত্যকেই চিরন্তন বা ধ্রুবক হিসাবে ধরা যায় না, নতুন প্রেক্ষিত, নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হলে ইতিহাসের ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হতে বাধ্য। ফলে অতীতের পুনর্নির্মাণ বিভিন্ন ঘরানার ইতিহাসবিদেরা বিভিন্ন ভাবে করে থাকেন। বামপন্থী ইতিহাস চর্চা ইতিহাস চর্চারই একটি ধারা। হতেই পারে, তাঁদের বিশ্লেষণ কারও মনঃপূত হল না। কিন্তু তার জন্য ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ করা যায় কি? বরং, রাজনৈতিক শক্তির কাজই হল নিজের প্রয়োজনানুযায়ী ইতিহাসকে বিকৃত করে নিজের কাজে লাগানো। কিন্তু ইতিহাস সচেতনতার অভাবে যখন সেগুলোই সমাজে মান্যতা পেতে থাকে, তখন সেই দেশের ভবিষ্যৎ এক প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে।

সচেতন ইতিহাসবোধ ছাড়া শক্তিশালী নাগরিক হওয়া সম্ভব নয়। সঙ্কীর্ণ ইতিহাস দিশাহীন ভবিষ্যতের জন্ম দেয়। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ইতিহাসের সত্যকে অনুধাবন করা, ইতিহাস সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Historian facts

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy