Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
World Economy

বদলাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র, উথালপাথাল সময়ে ভারত কি দিশারি অন্য দেশগুলির কাছে?

অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে রাজনীতির অভিমুখ। বহু ‘অসম্ভব’ই এখন সম্ভব। এমন অবস্থায় কি ফিরে আসবে ফ্যাসিবাদের মতো শাসন?

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২২ ১০:৩৩
Share: Save:

এমন এক সময় গিয়েছে, যখন প্রধান অর্থনীতির দেশগুলিকেই বিশ্বের আর্থিক প্রগতির চালিকাশক্তি বলে মনে করা হত এবং আমেরিকা, উত্তর ইউরোপের দেশগুলি, জাপান এবং চিনকে অন্য দেশগুলির কাছে অনুসরণযোগ্য বলে বর্ণনা করা হত। কিন্তু গত দেড় দশকে এই সব দেশ বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার উৎসস্থল হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে মূলত আমেরিকার লগ্নি পুঁজি বা ‘ফিন্যান্স ক্যাপিটালিজম’-এর অতি সক্রিয়তার ফল বলেই জানা যায় এবং সেই সঙ্গে কোভিডের উৎপত্তিকেও আমেরিকান এবং চিনা গবেষকদের যৌথ গবেষণারই উপজাত বলে মনে করা হয়। এই সব দেশের অধিকাংশের সরকারই ক্রমবর্ধমান আর্থিক সঙ্কটের সময়ে পলায়নের নীতি গ্রহণ করে। প্রথমেই তারা ব্যাঙ্ক এবং বণিক সংস্থাগুলির সঙ্কটের দায় এড়ায়। পরে উপভোক্তাদের কাছ থেকেও সরে পড়ে। অনিবার্য পতন রুখতে ক্রমান্বয়ে ঋণের বোঝা বাড়িয়ে এবং আর্থিক নীতিকে তার স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখান থেকে ফেরা দুরূহ।

সম্প্রতি ঘটনার গতি আরও অনেক বেশি জটিল আকার নিয়েছে। তার পিছনে কাজ করছে পতিত ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রশক্তির অস্তিত্বজনিত ভয় এবং অনিয়ন্ত্রিত বণিকতন্ত্রের মদতে বছরের পর বছর পুষ্ট হয়ে জেগে ওঠা নতুন ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের উত্থানের ঘটনা। প্রথমটির ক্ষেত্রে ফল গড়িয়েছে যুদ্ধের মাধ্যমে ভৌগোলিক বিস্তারনীতিতে, যা বিশ্বের রাজনীতিতে বহুকাল অদৃশ্য ছিল। সেই সঙ্গে নতুন মাথা তোলা রাষ্ট্রশক্তিও কিন্তু একই কাজে অগ্রসর হয়েছে, যদিও তার বণিকতন্ত্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের অবনতির ফলে আহত হয়েছে এবং এক অ-সাম্যাবস্থায় পরিস্থিতিকে নিয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে আবার ক্রমাগত বেড়ে চলা অসাম্য এই প্রশ্নগুলিকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে যে, বিশ্বায়নের ফলে কার বা কাদের লাভ হল? এবং কোনও অর্থনীতিতে পুঁজি (লভ্যাংশ) এবং শ্রমের (মজুরি) অবদান থেকে ঠিক কারা ন্যায্য অর্থে লাভবান হলেন? প্রায় অনিবার্য ভাবেই বলা যায়, এই মুহূর্তে উদারতন্ত্রের (সমালোচকরা হয়তো ‘নব্য-উদারতন্ত্র’ বলবেন) মধ্যাহ্ন পার হচ্ছে বিশ্ব। যার অনিবার্য ফল হিসেবে ভোটদাতারা জাতীয়তাবাদ, অভিবাসী বিরোধিতা, জনপ্রিয় গণতান্ত্রিকতার কিছু বিকৃত ধারণা এবং খুব সূক্ষ্ম আবরণে ঢাকা জাতিভেদ বা অন্য ভেদনীতির দ্বারা পরিচালিত হতে শুরু করেছেন।

রাজনৈতিক উথালপাথাল সমূহও বিশ্বের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি থেকেই উঠে আসছে। এমনকি, আমেরিকার মতো অতিরিক্ত মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী গণতন্ত্রগুলিতেও এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যতের আভাস দেখা দিয়েছে। গণমত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, দেশের অর্ধাংশ পরের নির্বাচনের ফলাফল মানতে রাজি না-ও হতে পারে। ইউরোপে দক্ষিণপন্থী নব্য ফ্যাসিবাদীরা উত্তরে সুইডেন থেকে দক্ষিণে ইটালি পর্যন্ত ভূখণ্ডে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছেন।

এখন আবার বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষমতাকেন্দ্রগুলিতে অর্থনীতির জট ছাড়ানোর খেলা শুরু হয়েছে, যা থেকে বিশ্বের অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশগুলিতে নতুন ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। সুদের হারের তীব্র চড়াই উতরাই দেশগুলি থেকে পুঁজির প্রবেশ এবং প্রস্থানকে প্রভাবিত করছে। দেশগুলির মুদ্রার মানও সেই তরঙ্গে ওঠানামা করছে। মুক্তবাণিজ্য পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি করে যুদ্ধকে রুখে দিতে পারবে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখা গেল, বিশ্ব বিভিন্ন বৈরী শিবিরে বিভাজিত হয়ে পড়েছে, বিশ্বায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ ব্যবস্থার পরিকাঠামো ভেঙে পড়ছে, তখন বোঝা গেল যে, এই খেলার প্রাথমিক উদ্দেশ্য কখনই দক্ষতা অর্জন ছিল না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল সহ্যশক্তি বাড়িয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখা।

সংগ্রামরত চিন-সহ সব দেশের সরকারই শ্লথ এবং রক্তশূন্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু ঋণের বোঝা এবং মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির পারস্পরিক বিপরীতমুখী দোটানা তাদের বেরোতে দিচ্ছে না। শেষের বিষয়টির পিছনে অংশত কাজ করছে সামরিক যুদ্ধের দোসর অর্থনৈতিক এক যুদ্ধ। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে ব্রিটেন ‘মিনি বাজেট’ নামের মোড়কে এক ‘বাজেট বাস্টার’ (যার দ্বারা কার্যত বাজেট কাটছাঁট করা হয়) হাজির করে এবং এর ফলে মুদ্রার মান পড়ে যায়। বন্ডের বাজারে এক শ্বাসরোধী স্তব্ধতা নেমে আসে। এই পরিস্থিতি অবশ্যই ২০০৮-এর আমেরিকার ‘লেহ্‌ম্যান ব্রাদার্স’ ব্যাঙ্কিং সংস্থার দেউলিয়া হয়ে পড়া থেকে জন্মানো সঙ্কটের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

আমেরিকা, চিন, ইউরোপ— বিশ্বের বাণিজ্যিক, কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র হসেবে বিবেচিত হতে থাকে ঠিকই। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই একযোগে এক চ্যালেঞ্জের সামনে গিয়ে পড়ে। সুতরাং সংবাদ শিরোনাম থেকে উঠে আসা বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত থেকে বেরিয়ে এসে কাঠামোগত ত্রুটিগুলির দিকে তাকাতে হবে। চিনের প্রকৃত সমস্যা হল এই যে, তাকে মধ্য আয়ের ফাঁদের (মিডল ইনকাম ট্র্যাপ) মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যেখানে আন্তর্জাতিক স্তরে নির্দিষ্ট মান বজায় রেখে শ্রমনিবিড় উৎপাদন টিকিয়ে রাখা দুরূহ। চিন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তিগুলিকেও খুঁজে বার করতে পারছে না। যার দ্বারা শ্রমনিবিড় রফতানি এবং সম্পত্তি ব্যবসায় কৃত্রিম ও অন্তঃসারশূন্য উন্নতির মোকাবিলা করতে পারে। এশিয়ায় ক্ষমতার কেন্দ্র বদলের গল্পটি এমনই দাঁড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে চিনের প্রতিবেশি জাপান, কোরিয়া এবং তাইওয়ানের সাফল্যের কাহিনি সেই কেন্দ্র পরিবর্তনের পক্ষেই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

আমেরিকায় তুলনামূলক ভাবে কম জনসংখ্যার স্টেটগুলিতে কি নির্বাচনের গতিছন্দকে পিছিয়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের আগেকার জমানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে? সেই সঙ্গে চেষ্টা চলছে এক স্থায়ী সংখ্যালঘু শাসন কায়েমের? বিভিন্ন জাতির মানুষের বসবাস রয়েছে, এমন রাষ্ট্র কি সেই ষাটের দশকে পড়ে থাকবে এবং এই ‘রাজনৈতিক রাহাজানি’-কে মেনে নেবে? ইউরোপে রাশিয়াকে কি স্থায়ী ভাবে আটকানো সম্ভব হবে? যদি তা সম্ভব হয়, তা হলে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন প্রতিবেশি দেশগুলি কি পশ্চিমের দিকে বিশেষ ভাবে ঝুঁকবে, যাতে ভৌগোলিক ভাবে অন্তত প্রতিরক্ষামূলক সীমান্ত পাওয়া যায়? যদি সত্যিই তেমন কোনও সমাধানসূত্র থাকত, তা হলে কি ইউক্রেন যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হত?

এই সব প্রশ্নের কোনও চটজলদি উত্তর মেলা সম্ভব নয়। কিন্তু এই প্রশ্নগুলির উত্তর হাতের কাছেই পাওয়া যেতে পারে। ভারতের মতো এক মধ্যম মানে পৌঁছনোর জন্য প্রচেষ্টারত শক্তি কী করে ভবিষ্যতের ধাক্কাগুলিকে সামলানোর উদ্যোগ নিতে পারে? বিশেষত যে ধাক্কাগুলি এক সাম্যাবস্থা থেকে বিচ্যুত এবং আমূল পরিবর্তিত বিশ্বের উপজাত? সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে ব্যক্তি এবং সংস্থার ক্ষেত্রেও উত্তর কিন্তু একই থাকবে। তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে— সচেতন থাকতে হবে, আত্মরক্ষার উপায় তৈরি করতে হবে এবং বাইরের দিকে নজর রেখে নিজেদের সামর্থ্য বাড়িয়ে যেতে হবে, সেই সঙ্গে প্রস্তুত রাখতে হবে কৌশলের ক্ষেত্রগুলিকেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

World Economy Neo Fascism Russia-Ukraine War
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE