Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Indian Economy

বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিলির নীতি ফিরিয়ে নিল কেন্দ্র, কতটা ক্ষতি হবে দেশের অর্থনীতির?

বন্ধ হয়ে গেল বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিলির পরিষেবা। ঠিক কতখানি প্রভাব পড়বে গরিব মানুষের জীবন যাপনে?

অসংগঠিত ক্ষেত্রের ২৭ কোটি সাত লক্ষ শ্রমিকের ৯৪ শতাংশ, যাঁরা সরকারের ই-শ্রম পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করেছেন, তাঁদের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নীচে।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের ২৭ কোটি সাত লক্ষ শ্রমিকের ৯৪ শতাংশ, যাঁরা সরকারের ই-শ্রম পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করেছেন, তাঁদের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নীচে। —প্রতীকী চিত্র।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৩০
Share: Save:

অতিমারিকালীন পরিস্থিতিতে বিশেষ কর্মসূচি হিসাবে গৃহীত বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের সিদ্ধান্তটি ফিরিয়ে নেবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র সরকার। গণবণ্টন ব্যবস্থা (পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম বা পিডিএস)-র ছত্রছায়ায় এই বিনামূল্যে বণ্টনের বিষয়টিকে রাখা হয়েছিল এক আপৎকালীন কর্মসূচি হিসাবেই।

এখনও পর্যন্ত পিডিএস অনুসারে প্রতি কিলোগ্রাম চালের দাম ৩ টাকা, গমের দাম ২ টাকা এবং পশুখাদ্য বা ওই জাতীয় কাজে ব্যবহার্য দানাশস্যের দাম ১ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই কর্মসূচিতে ভর্তুকির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৯০ শতাংশ। এখন এই শস্যগুলিকে বিনাপয়সায় বিলি করা হলে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে, তার বেশি কিছু নয়। গণবণ্টনের আবরণটিকে সরিয়ে যদি বিষয়টিকে দেখা যায় বোঝা যাবে যে, খুব ভাসা ভাসা হিসাবেও এই কর্মসূচিতে সামগ্রিক ভাবে বণ্টিত খাদ্যশস্যের মোট পরিমাণের ৫০ শতাংশকেই ৯০ শতাংশ ভর্তুকি বা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে এ বার থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সামগ্রিক খরচের এক বিপুল অংশ বেঁচে যাবে। যে সব রাজ্য বিনাপয়সায় খাদ্যশস্য দেয়, তাদেরও খরচ কমবে কারণ, কেন্দ্রই এই টাকার পুরোটা মিটিয়ে দিচ্ছে।

সরকারি আয়-ব্যয়ের খতিয়ান থেকে যদি বিষয়টিকে দেখা যায় তা হলে এই পদক্ষেপকে ঘিরে কেউ বিতণ্ডা শুরু করতে পারেন না। খাদ্য, সার এবং পেট্রোলিয়াম— এই তিনটি ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি-র ২.৫ শতাংশ হয়ে দাঁড়ায়। এক দশক আগেও পরিসংখ্যানটি এমনই ছিল। এর একটি কারণ এই যে, পেট্রোলিয়ামে ভর্তুকি (যা এক সময়ে সামগ্রিক ভর্তুকির এক তৃতীয়াংশ ছিল) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরে জিডিপি-র নিরিখে খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি কমানো হবে বলেই সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বার সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ কমবে কি না, তা নির্ভর করছে ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির উপর। উপর উপর যে হিসাব করা যায়, তা থেকে এটাই মনে হয় যে, সামগ্রিক অর্থেই ভর্তুকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমবে।

এখন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত সমস্যা রাজকোষ সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশের সঙ্গে যতখানি জড়িত, তার থেকে অনেক বেশি জড়িত কী ভাবে দু’টি বাস্তব সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হচ্ছে, তার সঙ্গে। এর মধ্যে একটি সমস্যা কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। এবং দ্বিতীয়টি ভারতের শ্রমজীবী মানুষের আয়স্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রথমে যদি কৃষি সংক্রান্ত বিষয়টিকে দেখা যায়, বোঝা যাবে যে, বেশির ভাগ কৃষকই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি-যুক্ত সার, বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় জল এবং বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন। বিশ্বের সব থেকে কম হারে কৃষি-মজুরি প্রদানের সুবিধাও ভোগ করেন তাঁরা। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফসলের ক্ষেত্রে (শুধু মাত্র খাদ্যশস্য নয়, যার মধ্যে আখের মতো ফসলও রয়েছে) কৃষকেরা নির্ধারিত ক্রেতা এবং দামও পেয়ে থাকেন। এর ফলে নিশ্চিত ভাবেই কৃষিজীবিকায় অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা কমে আসে। কিন্তু এর উল্টো দিকে দেখা যায়, কৃষিতে দামি বা দুষ্প্রাপ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব কম পরিমাণ ইনসেন্টিভই পাওয়া গিয়েছে। বহু ফসলের ক্ষেত্রেই উৎপাদনশীলতার মান আন্তর্জাতিক নিরিখের থেকে অনেকটাই নীচে। গড়পড়তা হিসেবে ভর্তুকি কিন্তু একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের কার্যক্ষমতার হ্রাস ঘটায়। দেশের মোট কর্মনিযুক্তির অর্ধাংশ যে ক্ষেত্রে রয়েছে, সেখানে পারিশ্রমিকের হারকে খুবই নিচুস্তরে রাখতে বাধ্য করে।

আয়স্তরের দিকে তাকালে দেখা যায়, অসংগঠিত ক্ষেত্রের ২৭ কোটি সাত লক্ষ শ্রমিকের ৯৪ শতাংশ, যাঁরা সরকারের ই-শ্রম পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করেছেন, তাঁদের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নীচে। মেরেকেটে ১.৫ শতাংশ মানুষের আয় ১৫ হাজার টাকার উপরে। পরিপ্রেক্ষিত বিচার করতে বসলে দেখা যায়, অসংঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দেশের শ্রমজীবী জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ বলে ধরা হয়। এই জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, যেখানে বিভিন্ন সমীক্ষা জানায় যে, আয়স্তরের এক চতুর্থাংশই আসছে কৃষি-বহির্ভূত ক্ষেত্রগুলি থেকে। প্রকৃতপক্ষে গত ৫ বছরে মুদ্রা-স্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে কৃষিক্ষেত্র থেকে আয়ের পরিমাণ লক্ষণীয় ভাবে কমে গিয়েছে।

আয়স্তর আসলে স্বঘোষিত কিছু পরিসংখ্যান, যাকে ৪ দশক জুড়ে বৃদ্ধি-পাওয়া মাথাপিছু আয়ের ৫ গুণ বেড়ে যাওয়া সংখ্যার সঙ্গে মেলানো যায় না। অতিরিক্ত আয়ের সবটাই চূড়ান্ত স্তরে যে পৌঁছতে পারেনি, তা দারিদ্র্যসীমার পতনমুখী লেখচিত্র থেকে বোঝা যায়। এর বাইরে আবার ভোক্তার প্রবণতা এবং দীর্ঘস্থায়ী ভোগ্যপণ্য কেনার প্রবণতা থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ বিষয়টির এক বিপরীত ছবি তুলে ধরে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রসরমান চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে।

এই সব পরিসংখ্যান থেকে যে পরিস্থিতির ছবি উঠে আসে, তা যদি সত্যি এতখানি খারাপ হয়ে থাকে, তা হলে বিনাপয়সায় খাদ্যশস্য বিলি কি তার সমাধান হতে পারে? সাম্প্রতিক গণবণ্টন ব্যবস্থায় বেশির ভাগ শ্রমিকেরই পরিবারের জন্য মাসকাবারি খাদ্যশস্য কিনতে তাঁদের এক দিনের মজুরির থেকে বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ে। এমন অবস্থায় বিনামূল্যে শস্য বিলির বিষয়টি খুব সামান্যই ইতর-বিশেষ ঘটায়। সত্যি বলতে, এই ব্যবস্থা এক প্রতিযোগিতামূলক গণমুখীন চক্রকে তৈরি করে, যেখানে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সহ বিবিধ সুবিধা দানে প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির অবমূল্যায়নের ঝুঁকি তৈরির চাইতেও বেশি কিছু সমস্যার সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়।

এই পরিস্থিতিতে বিকল্পের সন্ধান বৃহত্তর অর্থনৈতিক নীতির খোঁজে বদলে যাবে। কমিয়ে রাখা কৃষি-মজুরির হার কিন্তু তার সঙ্গে কৃষি-বহির্ভূত অর্থনীতির পারিশ্রমিকের ফারাককে কমিয়ে আনবে না, অন্তত যতক্ষণ না পর্যন্ত শিল্পোৎপাদন ও পরিষেবা-ক্ষেত্রগুলি থেকে আরও বেশি পরিমাণ আয়ের বিষয়টি নির্মিত হচ্ছে এবং মানুষের কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরতা কমছে। তত দিন পর্যন্ত গরিব মানুষের আয়ের ক্ষেত্রে সহায়তা দানের প্রয়োজনীয়তা ফুরোবে না। এবং কর্মনিযুক্তির নিশ্চয়তা দানের মতো কিছু স্ব-নির্বাচিত প্রকল্পের প্রয়োজনও থেকে যাবে। সেই সঙ্গে থেকে যাবে গণস্বাস্থ্য পরিষেবা, স্কুলশিক্ষা এবং জীবিকামুখী প্রশিক্ষণের মতো বিষয়গুলির প্রয়োজনীয়তাও। ভর্তুকি আর বিনাপয়সায় পাইয়ে দেওয়ার নীতি আসলে প্রকৃত সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে রাখার কৌশল, তার বেশি কিছু নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Economy subsidy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE