E-Paper

রাষ্ট্রের রোষানলে দগ্ধ

সোনমের স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো প্রশ্ন তুলেছেন, ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে পারে, তবে সোনম কেন পাকিস্তানে গিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত আবহাওয়া পরিবর্তন বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না?

আনন্দ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:১৯

রাষ্ট্রীয় হিংসার বলি হলেন সোনম ওয়াংচুক (ছবি)। লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া, তাকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা-সহ একাধিক দাবিতে সংগঠিত প্রতিবাদ আন্দোলন গত ২৪ সেপ্টেম্বর হিংসাত্মক রূপ নিলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায়। চার জনের মৃত্যু হয়, ৫০ জনেরও বেশি আহত। উপরোক্ত দাবিগুলি-সহ আরও নানা দাবিতে অনশনরত বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক এই খবর পেয়ে অনশন প্রত্যাহার করেন, পাশাপাশি লাদাখবাসীকে হিংসার পথ থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন।

এর অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়, সোনম ওয়াংচুকের প্ররোচনাময় বক্তব্যের কারণে নাকি এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও নাগরিকদের দাবি, সোনমের সঙ্গে দীর্ঘ পনেরো দিন ধরে অনশন চালিয়ে আসা, প্রবীণ দুই ব্যক্তি হঠাৎ অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিল। এর কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যোগাযোগ’-এর অভিযোগ তুলে বলা হয় তিনি ‘জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’, জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (এনএসএ) গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। এই আইন শাস্তিমূলক নয়, বরং প্রতিরোধমূলক আইন বলে পরিচিত, যার জোরে কাউকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটকে রাখা সম্ভব।

সঙ্গত কারণেই সোনমের স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো প্রশ্ন তুলেছেন, ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে পারে, তবে সোনম কেন পাকিস্তানে গিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত আবহাওয়া পরিবর্তন বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না? স্বামীর খবরাখবর ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জানতে না পেরে গীতাঞ্জলি গত ২ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে ‘হেবিয়াস করপাস’ রিট পিটিশন দাখিল করেছেন।

জাতীয় নিরাপত্তা আইন ১৯৮০ সালে চালু হওয়ার আগেও ভারতে একাধিক ‘কালা কানুন’ বিভিন্ন সময়ে কার্যকর ছিল। ১৯৫০-এ ‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট’ ও ১৯৭১-এ ‘মিসা’ আইন দেশ জুড়ে ব্যাপক প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে এই আইন বাতিল করা হয়, এর দু’বছর পরেই আবার কার্যকর হয় জাতীয় নিরাপত্তা আইন, যার মাধ্যমে দেশের আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, জরুরি সরবরাহ প্রভৃতি সুষ্ঠু ভাবে বজায় রাখতে সরকারের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলি বিভিন্ন সময়েই এই সব আইনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। এমনকি আদালতও বহু ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কোনও ব্যক্তিকে আটকে রাখার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে। কেরোসিন তেলের কালোবাজারির অভিযোগে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়া জনৈক ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, এ ঘটনায় এই আইন প্রয়োগের কোনও যৌক্তিকতা নেই। অন্য দিকে, মধ্যপ্রদেশে লাভ জেহাদের মতো ঘটনায়, বা উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা বা গো-হত্যার মামলায় এই আইনটি যথেচ্ছ ভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়েও উত্তরপ্রদেশে বহু মানুষ এই আইনে গ্রেফতার হন।

২০১৭ সালে ‘ভীম আর্মি’-র প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ ‘রাবণ’কে উত্তরপ্রদেশে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ২০১৮ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আজাদকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। ২০২০-তে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাফিল খানকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে এই আইনেই গ্রেফতার করে উত্তরপ্রদেশ সরকার। পরবর্তী সময় এলাহাবাদ হাই কোর্ট তাঁর গ্রেফতারিকে অবৈধ ঘোষণা করে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। ২০২৩-এ শিখ ধর্ম প্রচারক অমৃতপাল সিংহকেও এই আইনে গ্রেফতার করা হয়।

এ ধরনের আইনের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারের গ্রেফতারির নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। অন্যথায় হাই কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত পরামর্শদাতা বোর্ডের উপর আস্থা রাখতে হবে, গ্রেফতারির তিন সপ্তাহের মধ্যে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তাঁরা তাঁদের মত জানাবেন, এবং যথেষ্ট কারণ না থাকলে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে মুক্তি দেবেন। এর পাশাপাশি হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে সংবিধানের ২২৬ বা ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে রিট পিটিশন দায়ের করার অধিকার প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকেরই রয়েছে।

ইউএপিএ, আফস্পা-সহ অধুনালুপ্ত টাডা, মিসা, পোটা-র মতো ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণকারী, যার প্রয়োগে সরকার বা প্রশাসন বহু ক্ষেত্রেই বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করতে চায়। পূর্ণ রাজ্যের দাবির পাশাপাশি লাদাখে হিমালয়ের পরিবেশ রক্ষা, তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থানের দাবিতেও দীর্ঘ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন সোনম ওয়াংচুক। ছ’বছর পেরোনোর পরেও রাজ্য গঠনে এত বিলম্ব কেন, এই প্রশ্ন তুলেছেন। সে জন্যই বোধ হয় অক্টোবরে কেন্দ্রীয় সরকার ও লে অঞ্চলের সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন প্রশাসনিক কমিটির মধ্যে হতে চলা বৈঠকে তাঁর নাম রাখা হয়নি।

সোনম যে কেন্দ্রের রোষানলে পড়বেন, অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই সন্দেহ করেছিলেন। হলও তা-ই: বিনায়ক সেন, স্ট্যান স্বামী, জি এন সাইবাবা, সুধা ভরদ্বাজ, প্রবীর পুরকায়স্থ, এমন আরও নামের তালিকায় জুড়ল তাঁর নাম।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Leh Ladakh Law

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy