Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
মৃত্যুহীন প্রাণের দান
mahatma gandhi

এক মহাত্মা নিহত, কিন্তু দেশ জুড়ে তাঁর পথে আরও কত ‘গান্ধী’

আজকের হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিরেকে সারা পৃথিবীই গান্ধীকে তন্ন তন্ন করে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে।

পিতৃপুরুষ: শাহাবুদ্দিন আহমেদের আঁকা ছবিতে মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী

পিতৃপুরুষ: শাহাবুদ্দিন আহমেদের আঁকা ছবিতে মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:১৮
Share: Save:

সত্যবতীকে দিয়েই এই কাহিনি শুরু করা যায়। সে ছিল নন্দীগ্রামের তেরপেথ্যা বাজারের যৌনকর্মী। লবণ আইন ভঙ্গের সত্যাগ্রহের সময় সে নিজে থেকেই আন্দোলনে যেত। পুলিশ যখন স্কুল, কলেজের ছেলেদের লাঠিপেটা করত, তার মায়া হত। কয়েক জন তো চেনাজানা গ্রামের ছেলে। কিন্তু সত্যবতী কী বা করতে পারে! সে তো কংগ্রেস করে না!

দয়া-মায়ার মানবিক অনুভূতিটি কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টির থেকে জোরালো। বারবনিতা সত্যবতী দিন কয়েক বাদে তাই আর একটি কাজ করল। শিবিরে-আসা আহত ছেলেগুলির শুশ্রূষা। দিন কয়েক এ ভাবে চলল, এক দিন সত্যবতী নিজেই চলে গেল লবণ তৈরির সত্যাগ্রহে। পুলিশের লোক গোড়ার দিকে অপমান করত, পরে মারতেও ছাড়েনি। টাকাপুরা গ্রামে লাঠি দিয়ে তার জরায়ুতে মারা হল। বারবনিতার আবার জরায়ু! সত্যবতী কিছু দিন বিছানায় পড়ে থাকল, তার পর আবার যে কে সেই। তাকে দমানো যায় না।

কাঁথি মহকুমার সুখদী গ্রামের পদ্মা দুধওয়ালির ঘটনাটাও ভোলার নয়। বাড়ি বাড়ি দুধ বেচত, খোলাখুলি গ্রামের সত্যাগ্রহ কেন্দ্রে আইন অমান্য করে লবণ জ্বাল দিতে গিয়েছিল। সেখানে এক দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মহকুমা শাসকের নির্দেশে পুলিশ পতাকা টেনে নামাতে যায়। দুধওয়ালির নেতৃত্বে তখন প্রায় একশো মেয়ে পতাকা আড়াল করে দাঁড়ায়। তখন পুলিশ লাঠি দিয়ে তাদের মারতে থাকে, পুলিশ লাঠি দিয়ে তার যোনিপথে এমন মার মারে যে পদ্মা অজ্ঞান হয়ে যায়। কংগ্রেসকর্মীরা তাকে কাঁথিতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কয়েক দিন বাদে সুস্থ হলে পদ্মা আবার আন্দোলনে ফিরে আসে।

১৯৩২ সাল। আরামবাগের বড়ডাঙ্গল গ্রামে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। দ্বারকেশ্বর নদের ধারে সাগরকুটির নামে একটা বাড়িতে কংগ্রেস-অফিস। বাড়ির মালিক রায়পরিবার কংগ্রেস-সমর্থক। পরিবারের কর্ত্রী মৃগবালা রায় ও তাঁর তিন ছেলে হরিনারায়ণ, জয়নারায়ণ ও কৃষ্ণনারায়ণও কংগ্রেস সদস্য। রায় পরিবারের ছোট ছেলে কৃষ্ণনারায়ণের বয়স বড় জোর আঠারো-উনিশ। স্বদেশি করতে গিয়ে আগের বছরই জেল খেটে ফিরেছে। তবু প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অতুল্যচরণ ঘোষ প্রমুখ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখে। সাইক্লোস্টাইল মেশিনে গোপনে ছাপানো প্রচারপত্র বিলি করে।

স্থানীয় দারোগা দেবেন্দ্রবিজয় মল্লিক এক দিন সেই কিশোরকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন। পকেটে সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা একটা চিঠি। সঙ্কেতের মর্মোদ্ধার করতে পারলেন না দারোগা, ফলে আবার পিটুনি। উলঙ্গ অবস্থায় মাথা নিচু করে ঝুলিয়ে রাখা হল তাকে, তার পর গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে ফের মার, “বল, তোদের নেতা প্রফুল্ল সেন কোথায়? সাইক্লোস্টাইল মেশিন কোথায় রেখেছিস?” এ বারেও লাভ হল না। দারোগা সটান চলে গেলেন কৃষ্ণদের বাড়িতে, ডেকে আনা হল তার মাকে। মৃগবালা রায় ছেলের অবস্থা শুনে শিউরে উঠলেন, থানায় আর গেলেন না। তাঁর তখন একটাই প্রশ্ন, কেষ্ট কিছু বলে দেয়নি তো!

পুরুলিয়ার শ্রীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও ধরা যেতে পারে। পেশায় হাই স্কুলের মাস্টারমশাই, ১৯৩০ সালে সেখানকার নোয়াপাড়া গ্রামে মাহাতো, বাউরি, শবর প্রভৃতি জাতের মধ্যে গান্ধী আশ্রম ও স্কুল তৈরি করেন। ভদ্রলোকের মনে শিক্ষার অভিমান ছিল। ভাবতেন, শিক্ষিতরা তো দেশের পরাধীনতা, শোষণ নিয়ে সম্যক অবহিত। অশিক্ষিতরা এ সব বুঝবে কী ভাবে! তবু শ্রীশচন্দ্র কাজ শুরু করলেন। গ্রামের রাজাদের পুকুরপাড়ে মলমূত্র ভর্তি। এক চাঁদনি রাতে তিনি সেগুলি পরিষ্কার করতে লাগলেন। আস্তে আস্তে বাকিদেরও ঔৎসুক্য জাগল। তার পর গ্রামে কলেরা। শ্রীশচন্দ্র ইউনিয়ন বোর্ডের কাছে চিঠি পাঠালেন, ওষুধ এল। গ্রামের লোকরা তখন তাঁকে ‘গান্ধীজির লোক’ বলে ডাকে।

সে ডাকুক। কিন্তু নিম্নবর্গ অধ্যুষিত কলেরা-আক্রান্ত এই গ্রামে আরও স্বেচ্ছাসেবক দরকার। শ্রীশচন্দ্রের কথায়, “আশপাশের গ্রামে শিক্ষিত ছেলেরা আমাকে নিতে আসত, বক্তৃতা করাত, খাওয়াত। কিন্তু স্বেচ্ছাশ্রম দিতে বললে কেউ রাজি হত না।” এক দিন পাশের মাঝিহিড়া গ্রাম থেকে চন্দ্রশেখর মাহাতো, পরীক্ষিৎ মাহাতো এবং আরও কয়েক জন এসে ডাকল, “এখানে গান্ধীজির লোক কে আছেন?” লেখাপড়া না-জানা সেই মাহাতো ছেলেরা শ্রীশচন্দ্রের সঙ্গে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে চায়।

এই ঘটনাগুলি হিতেশরঞ্জন সান্যালের স্বরাজের পথে বই থেকে। প্রয়াত হিতেশবাবুকে বাঙালি মুখ্যত মন্দির-স্থাপত্য ও কীর্তনের সামাজিক ইতিহাসকার হিসাবে জানে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে ঘুরে গণ-আন্দোলন নিয়ে এই স্বল্পখ্যাত বইটি সে সবের চেয়ে আলাদা। মৌখিক ইতিহাসের মাধ্যমে বাংলার গ্রামের বিভিন্ন ঘটনার প্রকাশ। হিতেশবাবুর অকালমৃত্যুর পর উনিশশো নব্বইয়ের দশকে এই বইয়ের ভূমিকায় ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, “হিতেশবাবুর কাজের পরিসর, তথ্যের অভিনবত্ব ও প্রাচুর্য, বিশ্লেষণের মৌলিকতা এই প্রবন্ধগুলিতে অনেকটাই প্রকাশ পেয়েছে।” আশির দশকে সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সেসের ঘরে দেবেশ রায় এবং গৌতম ভদ্রও এই নিবন্ধগুলি রচনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন।

পণ্ডিতদের কথা থাকুক। এই বই পড়তে পড়তে আজ এক জায়গাতেই ধাক্কা লাগে। এ দেশে ক’জন গান্ধী ছিলেন? সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফফর খান থেকে চিপকো আন্দোলনের সুন্দরলাল বহুগুণা, আরামবাগের গান্ধী প্রফুল্ল সেন, সোদপুরের পান্নালাল দাশগুপ্ত অনেক গান্ধী পরিকরদের কথাই আমরা জানি।

গান্ধীর নেতৃত্ব কি এই রকমই ছিল যে, রাজনীতি ও জীবনচর্যায় আরও শয়ে শয়ে গান্ধী উঠে আসবেন এই দেশের বুকে? দু’জন সর্বেসর্বা নেতাই হিংসা, মিথ্যা ও জাতিঘৃণার আগুন ছড়িয়ে দেশ চালাবেন, এ জিনিস গান্ধী কস্মিন্কালেও ভাবেননি।

আর এক ইতিহাসবিদের কথা মনে পড়তেই পারে। সত্তরের দশক। গান্ধীকে নিয়ে বই লিখবেন বলে ট্রেনে চড়ে গুজরাত যাচ্ছেন রণজিৎ গুহ। ভোরবেলায় হঠাৎ দেখেন, রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন শয়ে শয়ে গান্ধী। সেই হেঁটো ধুতি, চোখে গোল চশমা। এখানে সব চাষিই তা হলে তাঁদের সমঝোতা, সংঘাত, যুক্তি-তক্কো-গপ্পো সব কিছু নিয়ে এক এক জন গান্ধী? ভোরের সেই দিব্যদর্শনই তাঁর প্রকল্পকে বদলে দিল। লেখা হল নিম্নবর্গের চেতনা-পরিচিতির এলিমেন্টারি অ্যাসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া। তার পর শাহিদ আমিন থেকে ক্লদ মার্কোভিচ, ডেভিড হার্ডিম্যান, রামচন্দ্র গুহ আরও কত! আজকের হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিরেকে সারা পৃথিবীই গান্ধীকে তন্ন তন্ন করে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে। রণজিৎ গুহ তো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “গান্ধীকে বুঝতে গেলে ভারতকে বুঝতে হবে।”

এই বুঝদারি প্রকল্পে হিতেশরঞ্জন অন্য রকম। তিনি বাংলার গ্রামে জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে গান্ধীর প্রভাব ছানবিন করেন। কাঁথি থানার আমতলিয়া গ্রামে শেখ আব্দুল এখন ভাগচাষি। কংগ্রেসে নাম লিখিয়েছে দেখে এলাকার চকদার ও জোতদারেরা অসন্তুষ্ট হয়ে তার জমি আস্তে আস্তে কেড়ে নিতে থাকে। তবু সেই গরিব ভাগচাষি জাতীয় আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায় না।

মহিষবাথানের হাজি মহম্মদ বাদসাদিকে লেখক প্রশ্ন করেন, আন্দোলন করতে গেলে জেল, জরিমানা, মারধর তো আছে। এত ঝুঁকি নিতে গেলেন কেন? তাঁর উত্তর, “আমার অবস্থা ভাল হলেই তো হবে না। আমার ভাইদের অবস্থাও ভাল হওয়া উচিত ছিল। দু’-এক জনের অবস্থা ভাল হলেই তো আর দেশ থাকবে না, দেশ খাবে কী?”

কাঁথির ফতেপুর গ্রামে আর এক গল্প। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নিজে কর আদায় করতে আসেন, মেয়েরা তাঁকে ঝাঁটা দেখিয়ে দূর করে দেয়। গান্ধীবাদী নেতা বীরেন্দ্রনাথ শাসমল তাঁদের কর দিতে বারণ করেছেন যে! বিচারে সাত দিনের কারাবাস। মুক্তি পাওয়ার আগের রাতে পুলিশ ভ্যান কয়েদিদের রাস্তায় ছেড়ে আসে। সকালে তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হল দশ হাজার লোকের সভায়। কর যারা দেবে না, তাদের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ হল। কিন্তু ক্রোক করা সম্পত্তি আদালতে নিয়ে গিয়ে তুলতে হবে তো! গ্রামের কেউ রাজি হল না, কয়েক দিন পর ক্রোকের নিয়ম ভেস্তে গেল।

কৃষ্ণ ভুঁইয়া নামে এক জনের ক্রোক করা মাল কাঁথি কোর্টে নিলাম হবে। দশ টাকা থেকে হাঁক শুরু হল। কেউ ডাকে না, তখন নিলামদার ডাকল চার টাকা। নামতে নামতে শেষে এক টাকা। তবু কেউ এল না। রামনগর ও কাঁথি থানায় তখন ক্রোক করা মালের পাহাড়। গত্যন্তর না দেখে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নিয়মটাই উঠে গেল।

এই যে অহিংস আন্দোলন থেকে কাতারে কাতারে উঠে আসা চাষিবাসি মানুষ... এঁদের শেষ কথা তো একটাই। ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ বিড়লা হাউসে এক জন মরণশীল মানুষকে খুন করা যায়, কিন্তু গ্রামে গ্রামে কয়েকশো গান্ধীর জন্ম দেওয়া অদম্য চেতনাকে নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mahatma gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE