E-Paper

শান্তির খোঁজে অশান্তি বৃদ্ধি

হামলা শেষ হতে সাত তাড়াতাড়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন, ইরানের পরমাণু শক্তির শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া গিয়েছে।

সৌরজিৎ দাস

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৫ ০৫:৫৪

ইরানের পরমাণু এবং সামরিক কেন্দ্রগুলির উপর গত জুনে টানা বেশ কিছু দিন ইজ়রায়েল-এর তীব্র বিমানহামলা চলল, তার পর ২২ জুন হামলায় যোগ দিল আমেরিকা। ইরানের তিনটি প্রধান পরমাণু কেন্দ্র— ইসফাহান, নাতানজ় এবং ফোরডো-র উপর চলল অস্ত্রবর্ষণ। হামলা শেষ হতে সাত তাড়াতাড়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন, ইরানের পরমাণু শক্তির শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া গিয়েছে।

সত্যিই কি তাই? ইরানের পারমাণবিক পরিকাঠামোর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে, সন্দেহ নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেকটা ক্ষতি হলেও অনেকটা অক্ষতই আছে। আইএইএ-এর প্রধান রাফায়েল গ্রসি-র মতে, ভূপৃষ্ঠের অনেক নীচে কংক্রিটের বহু আস্তরণে আবৃত বাঙ্কারে ইরানের পরমাণু কর্মকাণ্ডের অনেকটাই রয়ে গিয়েছে। আর তার ইউরেনিয়াম ভান্ডারের ৬০ শতাংশই অটুট।

তা হলে? তা হলে, ব্যাপার দাঁড়াল, ইরানের ক্ষতি তত হয়নি, কিন্তু ভেঙে দেওয়া গিয়েছে তার আস্থা ও স্বচ্ছতার অভিমুখে আসার অভিপ্রায়। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা-ইজ়রায়েলের এই যৌথ আগ্রাসনের প্রভাবে ইরান তার আগের অবস্থানের থেকে অনেক বেশি কট্টর জায়গায় চলে গেল। তার পারমাণবিক অ-সম্প্রসারণ চুক্তি (নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি বা এনপিটি) মেনে চলার সব রকমের বাধ্যবাধকতার অবসান হল। অর্থাৎ বাইরের দিক থেকে দেখলে, রাষ্ট্রপুঞ্জ সমেত বিশ্বের প্রধান দেশগুলি পরমাণুশক্তি নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্য নিয়ে চলছে, এই অভিযানে তাতে দশ পা এগোনো গেলে পঞ্চাশ পা পিছিয়ে আসতে হল।

একই সঙ্গে এই এনপিটি চুক্তি যে কতখানি অসার, তাও উন্মোচিত হয়ে গেল। ১৯৬৮ সালে স্বাক্ষরিত এবং ১৯৭০ সালে কার্যকর এনপিটি-র লক্ষ্য— পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিস্তার আটকানো, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং নিরস্ত্রীকরণে সহযোগিতা বাড়ানো। রাষ্ট্রপুঞ্জের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র তত্ত্বাবধানে চুক্তিটি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারকে সমর্থন করে। এর দশম অনুচ্ছেদে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পদ্ধতিও উল্লিখিত আছে। বলা হয়েছে, যে কোনও দেশ এই চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে, যদি এই চুক্তির কোনও কিছু তাদের স্বার্থকে গুরুতর বিপন্ন করে। ফলে, এখন এনপিটি থেকে বেরিয়ে আসার পূর্ণ কারণ রয়েছে ইরানের কাছে।

এ দিকে, পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল একমাত্র পরমাণুধারী রাষ্ট্র হলেও তারা কিন্তু কখনওই আনুষ্ঠানিক ভাবে তা ঘোষণা করেনি, এমনকি এই চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেনি। অথচ, ১৯৬৮ সাল থেকেই এই চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় রয়েছে ইরান। শুধু তা-ই নয়, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বহুকাল ধরেই আইএইএ নজরদারির মধ্যেও থেকেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইএইএ-র সঙ্গে সহযোগিতা না করার অভিযোগ উঠেছে বার বার। তবে সহযোগিতা না করলেও, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে এমন কোনও তথ্যপ্রমাণ কারও কাছে নেই। আমেরিকার জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের অধিকর্তা তুলসী গ্যাবার্ড গত মার্চেই এই দাবি করেছিলেন। তার ফল তিনি পোয়াচ্ছেন এখন, ট্রাম্পের শত্রুতালিকায় উঠেছে তাঁর নাম।

তা হলে, ইরানের বিরুদ্ধে কেন এই আগ্রাসন? আমেরিকা বহু কাল ধরে ইরানকে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে, যারা নাকি বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। এই জন্যই ২০০২ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ ‘অ্যাক্সিস অব ইভল’-এর অন্যতম দেশ ইরানের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) তৈরি এবং ‘সন্ত্রাসবাদ রফতানি’র অভিযোগ তোলেন। প্রসঙ্গত, আমেরিকার এই অভিযোগ খারিজ করা যায় না। কেননা ইরানের চরমপন্থী শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকা-সহ ইজ়রায়েলের প্রভাব খর্ব করতে হুথি, হিজ়বুল্লা এবং হামাসের মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক।

ইজ়রায়েলের স্বার্থ আবার অন্য। ভুললে চলবে না, পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-এর প্রাধান্যের হেতু তার সামরিক শক্তি বা আমেরিকার সঙ্গে সৌহার্দ ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও বেশি— তার পরমাণু অস্ত্রসম্ভার। ইরান যদি সেই অস্ত্র তৈরি করে ফেলে, তবে ইজ়রায়েল-এর আধিপত্য আর থাকবে না।

ফলে, এ বারের হিসাবটা বোধ হয় ভুলই হল। ১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক চুল্লিতে হামলা চালানোর পরে ইজ়রায়েল দাবি করেছিল যে তারা বাগদাদের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে খর্ব করতে সফল হয়েছে। অথচ, সেই কেন্দ্র ক্রমে আইএইএ-র নজরদারির বাইরে, গোপনে প্রকল্পটিকে ত্বরান্বিত করে। একই ভাবে, এ বারও এই যৌথ হানা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সঙ্কল্পকে আরও দৃঢ় করতে পারে। ইতিমধ্যেই আইএইএ-র সঙ্গে সার্বিক সহযোগিতা স্থগিত রাখা নিয়ে ইরানের পার্লামেন্ট বিল পাশ করেছে।

বলা বাহুল্য, চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলে এনপিটি-র নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য থাকবে না ইরান। তার কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে পারবে না রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিদর্শক-সহ বাকি দুনিয়াও। গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথ সুগম হয়ে যাবে। এ দিকে সৌদি আরব হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে ইরান পরমাণু অস্ত্র অর্জন করলে তারাও তা করবে। প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালে উত্তর কোরিয়া এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে।

এই যৌথ হানা পরমাণু অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলির কাছে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে— আইএইএ-র সঙ্গে সহযোগিতা করেও শেষ পর্যন্ত সুরক্ষা না-ই মিলতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের কাছে নিউক্লিয়ার ডেটারেন্ট বা পারমাণবিক প্রতিরোধক তৈরি করাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা বলে মনে হতে পারে— ঠিক যেমন, উত্তর কোরিয়া যেই তার পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিল, তার পর থেকে সেখানে আর হামলা করেনি আমেরিকা।

ইরান এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে এনপিটি থেকে সরে আসেনি। ইরানি রাষ্ট্রদূতেরাও শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথাই বলেছেন। তবে এও বলেছেন, ভবিষ্যতে কোনও নিষেধাজ্ঞা বদলে দিতে পারে তাঁদের সিদ্ধান্ত। ফলে পরিস্থিতি ঘোরালো। আমেরিকা ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলি ভাবুক, ইরানের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার কথা।

আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হলে তা মেনে চলার দায় একমাত্র ইরানের নয়। এনপিটি-কে টিকিয়ে রাখতে হলে আইনের মাধ্যমে তা করা উচিত, বোমার মাধ্যমে নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump Nuclear Site

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy