Advertisement
E-Paper

আত্মহত্যা প্রতিরোধের পথ?

২০১৪-২০২১ সালের মধ্যে শুধু পুরুষ দিনমজুরদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ১৭০ শতাংশ, মহিলা দিনমজুরদের মধ্যে ১৩৭ শতাংশ, ছাত্রদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ, ছাত্রীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ।

অশোক সরকার

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:০৪
Share
Save

মানুষ আত্মহত্যা করে কেন, এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। মানসিক-স্বাস্থ্য কর্মীরা বলেন যে মনের এক বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষ ভাবে, এই জীবনের থেকে মুক্তিতেই বেশি স্বস্তি। তাই ওই পথ বেছে নেয়। কথাটা ঠিক, তবে যখন দেখি যে দিনমজুরেরাই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তখন প্রশ্ন জাগে, তবে কি আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও আত্মহত্যার জন্য দায়ী? নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশি মানুষকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়, এই তথ্যও একই প্রশ্ন জাগায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-২০২১ সালের মধ্যে শুধু পুরুষ দিনমজুরদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ১৭০ শতাংশ, মহিলা দিনমজুরদের মধ্যে ১৩৭ শতাংশ, ছাত্রদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ, ছাত্রীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ, আর নিয়মিত বেতনভুক পুরুষদের মধ্যে বেড়েছে ৭০ শতাংশ। জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধের কৌশলও (ন্যাশনাল সুইসাইড প্রিভেনশন স্ট্র্যাটেজি, ২০২০) এই আর্থ-সামাজিক কারণগুলির স্বীকৃতি রয়েছে।

সম্প্রতি কলকাতায় আয়োজিত এক জাতীয় স্তরের আলোচনাসভায় এই কথাগুলি ফের উঠে এল। দলিত আন্দোলন, নারী আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা জানালেন, কী ভাবে সামাজিক হিংসা, আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা, এবং চরম মানবিক অমর্যাদা মানুষকে আত্মঘাতী হওয়ার পথে ঠেলে দিচ্ছে। চাষিদের আত্মহত্যার আলোচনাতেও তাই দেখা গিয়েছে— ঋণগ্রস্ত হলেই চাষিরা আত্মঘাতী হন, এমন নয়। কিন্তু প্রচুর বকেয়া ঋণ জমে যাওয়ার জন্য যখন আবার ঋণ নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়, দোকানদার ধারে জিনিস দেওয়া বন্ধ করে দেয়, আত্মীয়স্বজন খোঁটা দেয়, মহাজনের লোক ভয় দেখায়, ব্যাঙ্কের লোক এসে বাড়ি-জমির কাগজ চায়, তখন আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া গতি থাকে না।

অথচ আত্মহত্যা নিবারণ সংক্রান্ত চর্চার অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে মানসিক-স্বাস্থ্য নিয়ে কথাবার্তা, যার মূলে রয়েছে ব্যক্তি মানুষের মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা। এই চর্চার বিজ্ঞান ও অভ্যাস-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ যথেষ্ট পরিচিত, এবং মান্যতাও পেয়েছে। এর উপযোগিতা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কিন্তু তার সীমাবদ্ধতার কথাও বলতে হয়। যদি প্রকৃত আয় ধারাবাহিক ভাবে নিম্নগামী হয়, যদি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে, যদি জাতি-ধর্মগত হিংসা, যৌন হিংসা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠে, যদি গড়পড়তা ছাত্র ভবিষ্যতে একটা ভাল জীবনের আশা দেখতে না পায়, যদি সামান্য কিছু রোগভোগ মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়, তা হলে শ্রেষ্ঠ মানসিক-স্বাস্থ্য কর্মসূচিও খুব বেশি কাজে দেবে না। সামাজিক কারণগুলোকে মান্যতা দিলে মানসিক-স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা কমে না। বরং ব্যক্তিকে মানসিক-স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র আর কী করতে পারে তা ভাবা দরকার।

সেই খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায়, নগদ সহায়তার কথা উঠছে। এমনিতে নগদ সহায়তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বিশেষত যখন রাজনৈতিক দলগুলি নগদ সহায়তাকেই রাষ্ট্র বা রাজ্যে ক্ষমতায় পৌঁছনোর মূল হাতিয়ার করেছে, তখন বিতর্কের অবকাশ থাকবেই। গত ত্রিশ বছরের রাষ্ট্রনীতি সমাজের সবচেয়ে উপরের বর্গের অগ্রগতির পথ যতটা প্রশস্ত করেছে বাকি সব বর্গের পথ ততটাই সঙ্কুচিত করেছে। সবচেয়ে উপরের বর্গের জন্য আছে মহাসড়ক, এয়ারপোর্ট, শপিং মল, প্রাইভেট স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়, কর্পোরেট হাসপাতাল, এমনকি বন্দে ভারতের মতো ট্রেন। আর বাকি জনসমষ্টির জন্য রয়েছে কেবল নগদ সহায়তা, এমনটাই অভিযোগ। অভিযোগ ফেলনা নয়, কিন্তু সেই জনসমষ্টির নিজের দৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে, ওইটুকুই বা কম কি? একাধিক সমীক্ষাতে মহিলারা বলছেন যে নগদ সহায়তার ১০০০-১৫০০ টাকা তাঁদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি গবেষণা এ-ও দেখাচ্ছে যে জননী সুরক্ষা যোজনার টাকা যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক অবসাদের ঘটনা অনেক কম। তাই অন্য ভাবে চিন্তা করতেই হয়।

একই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ব্রাজ়িল, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া থেকে। ব্রাজ়িলের গবেষণা বলছে, যাঁরা নগদ সহায়তা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা তুলনায় অনেক কম। ইন্দোনেশিয়া বা কেনিয়ার গবেষণা বলছে যে, নগদ সহায়তা মানসিক অবসাদের সম্ভাবনা বেশ কিছুটা কমায়। নগদ সহায়তার বিরুদ্ধে নানা যুক্তি-প্রমাণ অস্বীকার না করেও বলা যায়, আর্থ-সামাজিক ভাবে দুর্বল, অসুরক্ষিত পরিবারগুলির কাছে সামান্য কিছু নগদ সহায়তা যদি আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, মানসিক অবসাদ কমায়, তবে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির মধ্যে মানসিক-স্বাস্থ্য কর্মসূচির পাশে তাকেও স্থান দিতে হবে।

যদি গরিবি কমাতে খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়, কাজের সহায়তার প্রয়োজন হয়, তবে মানসিক স্বস্তি বাড়াতে নগদ সহায়তাই বা দেওয়া হবে না কেন? তবে একটা সাবধানবাণীরও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সমাজ জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা, শিক্ষা-ভিত্তিক ভেদাভেদ, অমর্যাদা ও তজ্জনিত হিংসায় বহু কাল ধরে জর্জরিত। তারই প্রকাশ ঘটে আর্থ-সামাজিক ভাবে দুর্বল, অসুরক্ষিত মানুষের মানসিক-স্বাস্থ্যে। তা-ই শুধুমাত্র নগদ সহায়তা দিয়ে সবটা সুরাহা হবে, এমন কখনওই বলা চলে না; কেবল মানসিক-স্বাস্থ্য কর্মসূচিও যথেষ্ট নয়, তার জন্য চাই সামাজিক মর্যাদার আন্দোলন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Suicide National Crime Records Bureau

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}