Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি
Economic Growth

বৃদ্ধির হার বাড়াতে হলে সংস্কারের প্রশ্নগুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে

গত তিন দশকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা মোটামুটি চলেছে। মাঝেমধ্যেই চোখধাঁধানো হারে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে, আবার তার পরই ঝিমিয়ে পড়েছে।

সব্যসাচী কর
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫৮
Share: Save:

বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন ধরনের বাধাবিপত্তি এবং প্রশ্নচিহ্ন নিয়েই ভারতীয় অর্থব্যবস্থা পা দিল নতুন বছরে। তবে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা নিঃসন্দেহে আর্থিক বৃদ্ধির হার সংক্রান্ত— কী ভাবে বৃদ্ধির চড়া এবং সুস্থায়ী হারে পৌঁছনো যায়। এ কথা সত্যি যে, শুধু চড়া হারে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটলেই অর্থব্যবস্থার সব সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে না। কিন্তু, যদি যথেষ্ট আর্থিক বৃদ্ধি ঘটে, তা হলে নীতিনির্ধারকদের পক্ষে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তুলনায় সহজ হবে।

নীতিনির্ধারক ও নীতি-প্রভাবকদের নিয়ে দেশের যে পলিসি ইকোসিস্টেম বা নীতি-বাস্তুতন্ত্র, তাতে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আর্থিক সংস্কারের পর থেকেই আর্থিক বৃদ্ধি সম্বন্ধে একটা নির্দিষ্ট ভাষ্য বা বয়ান প্রচলিত রয়েছে। সেই বয়ানটা কী রকম? খুব সহজ করে বললে, সেই বয়ানে আর্থিক বৃদ্ধির জন্য জরুরি চারটি বিষয়ের কথা বলা হয়ে থাকে— প্রথমত, পণ্যের বাজারে সংস্কার; দ্বিতীয়ত, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন; তৃতীয়ত, উৎপাদনের উপাদানের বাজারে সংস্কার; চতুর্থত, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রণীত নীতিকে ধারণ করে এই চারটি স্তম্ভ।

গত তিন দশকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা মোটামুটি চলেছে। মাঝেমধ্যেই চোখধাঁধানো হারে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে, আবার তার পরই ঝিমিয়ে পড়েছে। এক বার তুমুল বৃদ্ধি, আর তার পরই শ্লথতা, এই চক্রাকার চলনের কারণ হল, যে চারটি স্তম্ভের কথা উপরে বললাম, সেগুলি ঠিক ভাবে কাজ করেনি। ১৯৯০-এর দশকে যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছিল, তার চালিকাশক্তি ছিল পণ্যের বাজারে সংস্কার। একে বলা হয় ‘প্রথম প্রজন্মের সংস্কার’। এই সংস্কারের মূল কথা ছিল ‘লাইসেন্স রাজ’-এর অবসান ঘটানো, এবং আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কের পরিমাণ হ্রাস। এই নীতি সংস্কারের ফলে কিছু কাল দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি ঘটল বটে, কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকেই অর্থব্যবস্থা ফের ঝিমিয়ে পড়তে আরম্ভ করল।

এই কথাটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, শুধু পণ্যের বাজারে সংস্কার করাই দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ বৃদ্ধির হার বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। সড়ক, বন্দর এবং বিমানবন্দরের মতো বাহ্যিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে সংস্কার না হলে তা আর্থিক বৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই পর্যায়ে এসেই বাহ্যিক পরিকাঠামো নির্মাণ— যাকে আমরা ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির প্রচলিত বয়ানের দ্বিতীয় স্তম্ভ বলছি— তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। ক্রমে সরকারি ব্যয়ে বড় মাপের পরিকাঠামো প্রকল্পের কাজ শুরু হতে লাগল।

কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধির বয়ানে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের ভূমিকা সম্বন্ধেও অবস্থান পাল্টাল। পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে বেসরকারি ক্ষেত্রকেও জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা আরম্ভ হল। যদিও এখনও অবধি তাতে খুব একটা সাফল্যে মেলেনি। তার একটা বড় কারণ হল, এই ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কী হবে, আর বেসরকারি সংস্থাগুলির ভূমিকাই বা কী হবে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতার ঘোরতর অভাব রয়েছে। তার ফলে পরিকাঠামো নির্মাণের কাজটি খানিক হলেও ধাক্কা খেয়েছে।

পণ্যের বাজারে সংস্কার, এবং পরিকাঠামো নির্মাণের উপর জোর দেওয়ার কিছু সুফল তবুও মিলেছে। কিন্তু, আর্থিক বৃদ্ধির অন্য দুই স্তম্ভ, অর্থাৎ উপাদানের বাজারে সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সাফল্য আরও ক্ষীণ। উপাদানের বাজার, অর্থাৎ জমি, শ্রম ও পুঁজির বাজারে সংস্কারকে বলা হয়ে থাকে দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার। মাঝেমধ্যে যে এই সংস্কারের চেষ্টা হয়নি, তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই চেষ্টা পথ হারিয়েছে সংস্কারের রাজনীতির চোরাবালিতে। চতুর্থ স্তম্ভ, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রশ্নটি ভারতে এখনও বহুলাংশে একটা দুর্বোধ্য ধাঁধা হয়ে থেকে গিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একাধিক চেষ্টা হয়েছে, যেমন ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্সি কোড, জিএসটি, বা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাঠামো। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে, কিছু সময় পরে সেই সংস্কার-প্রচেষ্টার অন্তরায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নকশাগত বা রাজনৈতিক কোনও বাধা।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে যে, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির আখ্যানে কোথায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে? প্রথম কথা হল, পণ্যের বাজারে সংস্কারের ক্ষেত্রে যা করার ছিল, তা করা হয়ে গিয়েছে। ইংরেজিতে বললে, সেই সংস্কার ছিল লো হ্যাঙ্গিং ফ্রুট— হাতের নাগালে থাকা ফল— ইতিমধ্যেই তা পাড়া হয়ে গিয়েছে। সেই সংস্কার দিয়ে বৃদ্ধির রথ আর এগোবে না। পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা টাকার— কোথা থেকে নিরন্তর টাকার জোগান পাওয়া যাবে। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে বেসরকারি সঞ্চয়ের মধ্যে— কিন্তু, দেশি বা বিদেশি, কোনও লগ্নিকারীই টাকা ঢালতে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। কারণ, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি প্রচুর।

উৎপাদনের উপাদানের বাজারে সংস্কারের প্রশ্নে ভারতের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের ওয়াশিংটন কনসেনসাসের পাতা থেকে এই সংস্কারের গুরুত্বের কথা ভারতের বৃদ্ধির বয়ানে ঢুকে পড়েছে বটে, কিন্তু সেই সংস্কারের সম্ভাব্যতা কতখানি নির্ভর করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নের উপর, সে বিষয়ে ভারতে ধারণার অস্বচ্ছতা রয়েই গিয়েছে। ফলে, যেখানে প্রয়োজন ছিল সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা, সেখানে একের পর এক সরকার চেষ্টা করেছে উপর থেকে সেই সংস্কারের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে। ফলে, প্রতি ক্ষেত্রেই তৃণমূল স্তরে বিপুল রাজনৈতিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে সেই সংস্কারের সিদ্ধান্ত। অতএব, উপাদানের বাজারে সংস্কারের কাজ এগোয়নি।

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে দু’ধরনের বাধা রয়েছে। একটি বাধা রাজনৈতিক, অন্যটি সংস্কারের ডিজ়াইন বা নকশা সংক্রান্ত। একটা ভ্রান্ত ধারণা থেকেই গিয়েছে যে, উন্নত দেশগুলির প্রতিষ্ঠানের ধরন ভারতে হুবহু নকল করা সম্ভব, এবং তা করতে পারলে তাৎক্ষণিক ফল লাভও সম্ভব। দুনিয়ার বহু দেশের অভিজ্ঞতাই কিন্তু উল্টো কথা বলছে— প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার তখনই সফল হয়, যখন তা দেশের সামাজিক রীতিনীতি এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রশ্নটিকে অন্যান্য ‘সংস্কার’-এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ফলে এই কাজটি কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়— দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে সংস্কারের নকশা তৈরি করা যায় না। আরও একটি সমস্যা থেকে যায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই কাজ করে রাজ্য স্তরে, বা স্থানীয় স্তরে। সেখানে সংস্কারগুলি কার্যকর করার দায় যে স্থানীয় প্রশাসনের, দেশের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য তার গুণগত মান যে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আলাদা হতে পারে, ভারতের বৃদ্ধির আখ্যানটি এই বাস্তবকে অস্বীকার করে। কোন রাজ্যের প্রশাসনিক দক্ষতা, কুশলতা এবং ক্ষমতা কতখানি, তা বিবেচনা না করে সর্বত্রই এক ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে চেষ্টা করার ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর রাজ্যগুলিতে সেই প্রয়াস স্বাভাবিক ভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।

বৃদ্ধির ধারাবাহিক কক্ষপথে ফিরতে চাইলে কী করা উচিত, সেই প্রশ্নের উত্তর উপরে বলা দুর্বলতাগুলির মধ্যেই আছে। পরিকাঠামো নির্মাণের প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকির পরিমাণ কমাতে হবে— সব গোত্রের রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়ায় পৌঁছতে হবে আগে। উপাদানের বাজারে সংস্কারের ক্ষেত্রে এই ঐকমত্য নির্মাণের গুরুত্ব আরও প্রকট। মনে রাখা দরকার যে, উপাদানের বাজারে সংস্কার হলে দরিদ্রতর ও বিপন্নতর জনগোষ্ঠীর জীবনে ঝুঁকি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে, সংস্কারের জন্য যে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন, তার গোড়ায় থাকতেই হবে দরিদ্র মানুষের জন্য যথেষ্ট সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা।

এবং প্রয়োজন যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এই ক্ষেত্রে কোন নীতি কতখানি সফল হবে, তা আগে থেকে আঁচ করা কঠিন— যত ক্ষণ না নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে, সাফল্যের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কিন্তু, পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, তার থেকে শিখে, সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এগোনোর নমনীয় নীতি গ্রহণ করলে তা কাজে লাগবে। চারটি স্তম্ভ সমান ভাবে কাজ করলে তবেই ভারত তার কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধির কক্ষপথে পৌঁছতে পারবে, দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হবে।

ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক গ্রোথ, দিল্লি

(এই নিবন্ধটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রণ সংস্করণ থেকে অনলাইন সংস্করণে নেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে নেওয়া হয় মুদ্রণ সংস্করণে ব্যবহৃত ছবিটিও। এক জন পাঠক ওই ছবির প্রসঙ্গ আমাদের গোচরে আনার পর আনন্দবাজার অনলাইন সংস্করণে ওই ছবিটি বদল করে দেওয়া হয়।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economic Growth GDP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE