Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Society

দেশটাই আজ ১০১ নম্বর ঘর

যে ভয়ের কথা বিলকিসের স্বামী বলেিছলেন, সেই একই ভয়ের কথা বলেছেন গুজরাতের রাধিকাপুর গ্রামের বাসিন্দারা। এই গ্রামেই ফিরেছে ওই এগারো জন।

অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও মানুষ ভিটে ছেড়ে আসে!

অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও মানুষ ভিটে ছেড়ে আসে!

অংশুমান কর
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৫১
Share: Save:

১৯৩৪ সনে ফ্যাসিজ়ম নামে ছোট্ট একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ বইটিতে ফ্যাসিজ়মের চরিত্র নিয়ে যেমন বিশ্লেষণ ছিল, তেমনই ছিল ইটালিতে মুসোলিনির রাজত্বে কাটানো দিনগুলি নিয়ে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা। সে রকমই একটি ছোট্ট রচনা ‘লেখক ফলগেরের সঙ্গে কথোপকথন’। শ্রীমতী ল’র বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন ছিল সৌম্যেন্দ্রনাথের। চায়ের আড্ডাতেই ইটালির বিখ্যাত লেখক ফলগেরের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। ফ্যাসিস্ট ইটালির প্রশংসায় ফলগেরে পঞ্চমুখ। সারা বিশ্বের জাতীয়তাবাদী সমস্ত দলের পাশে থাকে ফ্যাসিস্ট ইটালি, আড্ডায় এমনটাই মত দিয়েছিলেন তিনি। সৌম্যেন্দ্রনাথ যখন স্মরণ করিয়ে দেন যে, তা হলে তো ট্রিপোলির জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনেরও পাশে থাকার কথা ইটালির, তখন দৃশ্যতই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন ফলগেরে। ক্রুদ্ধ না হয়ে তাঁর উপায়ও ছিল না। কারণ, ট্রিপোলি লিবিয়ার রাজধানী আর লিবিয়া তখন ইটালির কলোনি। ক্রুদ্ধ ফলগেরের সঙ্গে সৌম্যেন্দ্রনাথের কথোপকথন আর এগোয়নি। শ্রীমতী ল’র মায়ের মুখ দেখে সৌম্যেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, তাঁদের এই তর্ক তাঁকে বিব্রত করেছে। তিনি বলেছিলেন, “আপনার মতের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু তবুও আপনার মত বলবার সময়ে সাবধান হওয়ার যে যথেষ্ট প্রয়োজন আছে, সেটা ভুলবেন না।” স্পষ্টতই গৃহকর্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এমন ভয়ের রাজত্বে তাঁরা বাস করেন, মুক্তচিন্তা যদি বা করা যায়, তার মুক্ত প্রকাশ অসম্ভব। আজকের ভারতেও ভয়ের বাতাবরণ নির্মাণের কাজটি গতি পেয়েছে।

যেমন, বিলকিস বানোর ধর্ষকরা মুক্তি পাওয়ার পরে ভয় পেতে শুরু করেছেন অনেকেই। ‘ভয়’-এর কথা প্রথম বলেছিলেন বিলকিসের স্বামী ইয়াকুব রসুল। বলেছিলেন, বিলকিসের ধর্ষকদের এক জনও যদি এমনকি প্যারোলেও মুক্তি পেতেন, তা হলেও তাঁরা ভয় পেতেন, এগারো জন মুক্তি পাওয়ায় তাঁরা আতঙ্কে আছেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এগারো জন ধর্ষক ও খুনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে ফুল-মালার সংবর্ধনা জুটলে বিলকিস ও তাঁর স্বামীর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বওয়া স্বাভাবিক।

যে ভয়ের কথা বিলকিসের স্বামী বলেিছলেন, সেই একই ভয়ের কথা বলেছেন গুজরাতের রাধিকাপুর গ্রামের বাসিন্দারা। এই গ্রামেই ফিরেছে ওই এগারো জন। ওদের জেলে না পাঠালে গ্রামে থাকার সাহস পাচ্ছেন না— এ কথা জানিয়ে গ্রাম ছেড়ে গিয়েছেন কিছু মানুষ। গুজরাত সরকারের কাছে আবেদনও করেছেন তাঁরা, যাতে ওদের আবার জেলে পাঠানো হয়, একটি চিঠিতে সই করে জমা দিয়েছেন প্রশাসনের কাছে। গ্রামে ফিরতেই বীরের সংবর্ধনা পেয়েছে ওই এগারো জন। উৎসব শুরু হয়েছে, বাজি ফাটানো হয়েছে, লাউডস্পিকারে গান বেজেছে। আনা হয়েছে ডিজে। গ্রাম ছেড়েছেন যাঁরা তাঁদের এক জন বলেছেন, “যত দিন না এই এগারো ধর্ষক ও খুনি আবার জেলে যাচ্ছে এবং আমাদের পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে, তত দিন আমরা গ্রামে ফিরব না। রুটিরুজির উপর এর প্রভাব পড়ছে, কিন্তু আমরা অসহায়।” আতঙ্ক কত হলে অন্নবস্ত্রের অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও মানুষ ভিটে ছেড়ে আসে!

স্বাধীনতার পঁচাত্তর উদ্‌যাপনে, গত কিছু দিন ধরে দেশের শৌর্য কেবল প্রদর্শিতই হয়নি, এমন ভাবে প্রদর্শনের চেষ্টা হয়েছে, যাতে নির্দিষ্ট কিছু নাগরিকের ভয় পাওয়ানো যায়। ‘আমাকে ভয় পাও’ এই বার্তা যে সব সময় হুমকি দিয়ে, গর্জন করেই জানান দিতে হয়, তা তো নয়। করতে হয় এমন সব কাজ, রাখতে হয় এমন সব ইশারা যা অপরকে ভীত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। তাই কখনও দলিত ছাত্রকে ব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষিত পাত্র থেকে জল খাওয়ার ‘অপরাধ’-এ এমন মার মারেন উচ্চবর্ণের শিক্ষক যে ক’দিন পরে মৃত্যু হয় তার। কখনও খুনি ও ধর্ষকদের ফুল-মালা-মিষ্টি-ডিজে সহযোগে যে ভাবে বরণ করে নেওয়া হয়, তাতে মনে হয় পুরুষদের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ এক ধর্ষক। বার্তাটি এখানে ইশারায়। রাষ্ট্রের এই ভয় দেখানোর ইচ্ছেরই প্রকাশ নতুন সংসদ ভবনের অশোকস্তম্ভে, বললে অত্যুক্তি হবে কি? শান্ত, শিল্পিত সিংহ এখন তাই হিংস্র।

জর্জ অরওয়েল-এর বিখ্যাত উপন্যাস নাইনটিন এইট্টি ফোর-এ নায়ক উইনস্টন ‘বিগ ব্রাদার’-এর রাজ্যে ইতিহাস-বিকৃতির চাকরিটি মন দিয়ে করলেও, অন্তর থেকে বিগ ব্রাদারকে ঘৃণা করে। শেষ পর্যন্ত দিনের পর দিন অত্যাচার করেও যখন তাঁর হৃদয়ে বিগ ব্রাদারের জন্য প্রেম সঞ্চারিত করা যায় না, তখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ১০১ নম্বর ঘরে। বলেন, ওই ঘরে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ জিনিস, তবে তা এক-এক জনের জন্য এক-এক রকম। উইনস্টনের জন্য তা হল ইঁদুর। এই ভয়ের কাছে শেষে নতি স্বীকার করে উইনস্টন। শিখে নেয় বিগ ব্রাদারকে ভালবাসতে। প্রয়োগ করেন ব্রহ্মাস্ত্র: ১০১ নম্বর ঘর।

এ দেশের মানুষের সঙ্গেও নানা চেষ্টা হয়েছে, দেশের কর্তাব্যক্তিটিকে ভালবাসতে শেখানোর। কাজ হয়নি। এ বার তাই মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে গোটা দেশটিকেই বানিয়ে তোলা হবে ১০১ নম্বর ঘর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society India Bilkis Bano
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE