E-Paper

জলবায়ু সুরক্ষায় আদালত

ভারত এক বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এখানে বেশি। তীব্র তাপপ্রবাহ, বিধ্বংসী বন্যা এখন বাস্তব। আদালতের চাপে সরকার হয়তো আরও কঠোর আইন করতে বাধ্য হবে।

সৌম্য সরকার

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৯

জলবায়ু সংক্রান্ত মামলা এখন আরও গুরুত্ব পাবে আদালতে, সে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালে মাত্র ন’বছর বয়সের একটি মেয়ে, ঋদ্ধিমা পান্ডে, জাতীয় পরিবেশ আদালতে একটি আবেদন করে। বলে, জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলির শর্ত মানার বিষয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা তার মতো শিশুদের নিরাপদে বাঁচার মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। পরিবেশ আদালত তার আবেদন নাকচ করে দিয়ে বলে, পরিবেশ সুরক্ষা আইনেই (১৯৮৬) প্যারিস চুক্তির (২০১৫) উপাদান রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু ভিন্ন মত দিয়েছে। ২০২৫ সালের গোড়ায় শীর্ষ আদালত নির্দেশ দেয়, জলবায়ু নীতি রূপায়ণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলোর সমন্বয়ের উপর আদালতের নজর রাখার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিষ্ক্রিয়তা আজ শুধু প্রশাসনের শিথিলতা বলে গণ্য হচ্ছে না, সংবিধানের লঙ্ঘন বলে দেখা হচ্ছে।

ভারতে পরিবেশ মামলার চার দশক অতিক্রান্ত। এই পরিবর্তন সেই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। গঙ্গার সুরক্ষা থেকে শুরু করে বায়ুদূষণ ও শিল্পজাত বর্জ্য নিঃসরণের বিরুদ্ধে লড়াই— জনস্বার্থ মামলাগুলো পরিবেশ সুরক্ষাকে শুধু সরকারের ইচ্ছার বিষয় না রেখে আইনের দায়িত্ব করে তুলেছে। গত বছর ‘এম কে রঞ্জিতসিন বনাম ভারত সরকার’ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় এই বিবর্তনকে স্পষ্ট করে দিয়েছিল। আদালত ঘোষণা করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষের জীবনের অধিকার, ও সাম্যের অধিকারের অংশ।

গত জুলাই মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’-এর একটি মতামত এই অবস্থানকে আরও জোরদার করেছে। এই আন্তর্জাতিক আদালত মত প্রকাশ করেছে, যে দেশগুলি বেশি কার্বন নিঃসরণ করে, জলবায়ুর সুরক্ষায় তাদের সরকারি এবং বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে যথাযথ ব্যবস্থা করতেই হবে। আন্তর্জাতিক আদালতের এই সিদ্ধান্ত, আর এ দেশে সুপ্রিম কোর্টের মতামত— এ দু’টি মিলিত ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে আইনি শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। এর পরে ভারতে জলবায়ু সংক্রান্ত মামলা বাড়বে, এমন সম্ভাবনাই বেশি। আন্তর্জাতিক আদালতের মতামত পাওয়ার পরে বিচারকরা সম্ভবত আবেদনকারীদের পক্ষেই বেশি রায় দেবেন। ভারতীয় আদালতগুলি এখন সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারে। তাতে সরকারি কর্মকর্তারা জলবায়ু নীতি রূপায়ণে যথেচ্ছাচারের সুযোগ পাবেন কম। অকারণে দেরি করলে, যথেষ্ট কাজ না করলে আইনের চাপের মুখে পড়তে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যাঁরা বিশেষ ভাবে ভোগ করছেন— শহরের দূষণে আক্রান্ত বাসিন্দা, অরণ্য ধ্বংসের ফলে বিপন্ন গ্রামবাসী, ক্ষয়িষ্ণু উপকূলের অধিবাসী— তাঁদের প্রতিকার পাওয়ার আশা হয়তো আর একটু জোরদার হবে। কারণ, আদালত এখন পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে প্রশাসনিক রীতিনীতি বিষয়েও নির্দেশ দিতে পারে। বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে সহযোগিতার নির্দেশ দিতে পারে, বা কোনও শিল্প প্রকল্প অনুমোদনের সময়ে জলবায়ুর উপর তার প্রভাবের মূল্যায়নের সমীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে পারে।

ভারত এক বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এখানে বেশি। তীব্র তাপপ্রবাহ, বিধ্বংসী বন্যা এখন বাস্তব। আদালতের চাপে সরকার হয়তো আরও কঠোর আইন করতে বাধ্য হবে। সেটা জলবায়ু সুরক্ষায় আরও পূর্ণাঙ্গ কোনও আইন হতে পারে, অথবা দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোরতর বিধি, কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা। কিন্তু এই সব পরিবর্তনের ফলে সরকার কি সেই সব সংস্থাকে রুখতে পারবে, যারা দীর্ঘমেয়াদি লাভ, সুস্থায়ী উন্নয়নের চেয়ে তাৎক্ষণিক লাভকে বেশি প্রাধান্য দেয়? আদালতের হস্তক্ষেপ শক্তিশালী হলেও তাকে কাজ করতে হয় গণতান্ত্রিক বৈধতার সীমানার মধ্যে। আদালত চালিকাশক্তি হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন নির্ভর করে আইনি সংস্কার, নেতৃত্বের ক্ষমতা, আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের অংশগ্রহণের উপর।

জলবায়ু সুরক্ষার পথে ভারতের সবচেয়ে বড় বাধা অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর পরিবেশ রক্ষার মধ্যে দ্বন্দ্ব। কয়লাখনি থেকে শুরু করে ইস্পাত কারখানা পর্যন্ত, ভারতের শিল্প কাঠামো এখনও কার্বন-নিবিড়। অসংখ্য মানুষের জীবিকা এ সব শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এক দিকে পরিবেশ রক্ষার আইনি বাধ্যবাধকতা, অন্য দিকে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির চাপ। এই দ্বন্দ্বের সমাধান হতে পারে ন্যায্য রূপান্তরের নীতিতে। যে সব শিল্প পরিবেশের ক্ষতি করে, সেগুলিকে সবুজ প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করা সহজ নয়। আদালতের রায় এই রূপান্তরের গতি বাড়াতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় দরিদ্র মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তার জন্য দরকার সুচিন্তিত নীতি, সমন্বয়ী উদ্যোগ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর নানা পক্ষের স্বার্থের সংঘাত প্রায়ই সমন্বয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিচার বিভাগের তদারকি সরকারি দফতরগুলিকে এক সঙ্গে কাজ করতে নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু তার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ইচ্ছা আর প্রশাসনিক দক্ষতা। যত দিন না আমরা উন্নয়নের সংজ্ঞা বদলাচ্ছি, যত দিন না পরিবেশ রক্ষা আমাদের অর্থনীতির কেন্দ্রে আসছে, তত দিন আদালতের রায়ও শুধু কাগজেই থেকে যাবে। পরিবর্তন আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Law Climate

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy