ভি কে কৃষ্ণ মেননের বিশ্বরেকর্ড-এর কথা ভাবছিলাম— সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং বিশ্বমঞ্চে ভারতের এই ব্যর্থতার দুর্দিনে। মূলত ইংল্যান্ডে রাজনীতি করা বামপন্থী কৃষ্ণ মেনন ছিলেন জওহরলাল নেহরুর বন্ধু। ১৯৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ব্রিটেনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ও পরে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন ভি কে কৃষ্ণ মেনন। ১৯৫৭ সালে জানুয়ারিতে তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জে আট ঘণ্টা কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভাষণ দেন। আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জে দীর্ঘ ভাষণের সেই ভারতীয় রেকর্ড অটুট। কোনও বিষয়ে আদৌ কেন আট ঘণ্টা বলতে হয়, সে আলোচনা ঊহ্যই থাকুক!
কাশ্মীর সমস্যা অহেতুক রাষ্ট্রপুঞ্জে নিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যে কূটনৈতিক অপরিপক্বতা দেখিয়েছিলেন, ইংরেজি ভাষণ-নির্ভর কূটনীতি তার আর এক ধাপ। পরবর্তী কালে বামপন্থী কৃষ্ণ মেনন হন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৬২-র চিন-ভারত সংঘর্ষে ভারতের পরাজয়ে তাঁর দফতরের হিমালয়-প্রমাণ ব্যর্থতা দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়। সেই কূটনৈতিক ধারাই আজও বয়ে চলেছে।
ভারতের কূটনৈতিক অভিযান চিরকাল অনেকটাই কাগজে-কলমে, তা নির্জোট আন্দোলন (ন্যাম) হোক বা সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্পোরেশন)। ন্যামের এখনও মাঝে সম্মেলন হয় যাতে বিবৃতি ছাড়া কিছু হয় না। সার্কের ভারত ছাড়া বাকি সাতটি দেশের ছয়টি দেশই ঘোষিত ভারতবিরোধী, একমাত্র সঙ্গী ভুটান। সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে ইন্দিরা গান্ধী সাহস দেখিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান বিজয় করে বাংলাদেশ গঠন করতে। তবে ভারতের কূটনৈতিক প্রভাব ও গোয়েন্দা তথ্যের অপ্রতুলতা ধরা পড়ে গেল বার বার, যখন ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব সপরিবার খুন হলেন, জ়ুলফিকার ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হল, ১৯৯৮-এ ভারত আণবিক বোমা বিস্ফোরণের গর্ব করার দুই সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তান একই কাজ করে ফেলে সমকক্ষ পারমাণবিক দেশের মর্যাদা আদায় করল, এবং অতি সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব ঘটল।
গত এক দশকে বিভিন্ন মাপকাঠিতে ভারত অনেক ধাপ এগিয়েছে। আমেরিকা, চিন, জার্মানির পর পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ার অভিমুখে ভারতের অগ্রগতি অবশ্যই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি স্বল্প ব্যয়ে মহাকাশে ভারতের উপস্থিতি, চন্দ্রাভিযান, সবই বিশ্বে প্রশংসিত। ভারতীয় সামরিক বাহিনীও নজর কেড়েছে কারণ চিনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম হল ভারতের সেনাবাহিনী। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও পহেলগাম নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষে কিন্তু ভারতকে সমর্থন জানিয়েছে কেবলমাত্র ইজ়রায়েল, তাইওয়ান এবং আফগানিস্তান। অর্থাৎ সবশেষে দেখা গেল কূটনৈতিক বিশ্বে ভারত একেবারেই একা।
ভারতকে রাজনৈতিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন সাম্প্রতিক কালে প্রতিবেশী দেশগুলিই আর বোধ করছে না। ভারতীয় উপমহাদেশেরই একটি ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক অঙ্গ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন স্থান, লোকেদের নাম, সংস্কৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ভারতীয় সংস্কৃতি। সেখানের তামিল সমস্যায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হলেও ভারত-বিরোধিতা শ্রীলঙ্কার রাজনীতির মূল ধারা ছিল না। চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ভারতই ছিল তাদের বড় সহায়। কিন্তু এ সব সহায়তা শ্রীলঙ্কার মানুষের কাছে নিশ্চয় তেমন কোনও বার্তা পৌঁছে দিতে পারেনি। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংসদীয় নির্বাচনে জয়ী হয়েছে একেবারে ভারতবিরোধী উগ্র বামপন্থী দল। ভারতের সনাতনী রাজনীতির কোনও প্রভাব শ্রীলঙ্কাতে প্রবেশ করেনি।
রাজা ত্রিভুবন নেপালকে স্বাধীন ভারতের সঙ্গে যোগ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্য তা ঘটেনি। আজকের নেপাল সম্পূর্ণ চিননির্ভর। এর দুই দশক পরে নেহরু কন্যা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিকিমকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করে তাকে আর একটি নেপাল হওয়ার সুযোগ দেননি। এ দিকে নেপালের সঙ্গে চিনের কোনও সীমান্ত নেই, নেপালের সম্পূর্ণ উত্তর সীমান্ত জুড়ে রয়েছে তিব্বত। তিব্বতের ধর্ম, ভাষা, লিপি, সংস্কৃতি সবই চিন থেকে ভিন্ন। গত দুই দশক ধরে নেপালে চলেছে একেবারে সরাসরি মাওপন্থীদের দাপট। এখন সেখানে সরকারে মাওবাদী দল, নেপাল এখন চিনপ্রেমী ভারতবিরোধী দেশ।
বাকি রইল— বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা সেনা, সকলের শাসনেই ভারতবিরোধিতা ও সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন সব সময়েই বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। গত দশ বছরে তা নিয়ে নীরব থেকেছে ভারত সরকার। গত বছরের ছাত্র আন্দোলনের নামে ইসলামি বিপ্লব, শেখ হাসিনার পলায়ন, হিন্দু সমাজের উপর ধারাবাহিক নির্যাতন ও ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী প্রচার ও আস্ফালন— সব কিছুতেই ভারত সরকারের নিস্পৃহতা বাংলাদেশে ভারতকে করে তুলেছে করুণার পাত্র। ফলে এক বছর আগেও বাংলাদেশের হিন্দুরা ফোন করে বলতেন, দাদা আমাদের হয়ে কিছু বলুন, তাঁরা এখন আর বলেন না। বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতের উপর ভরসা সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছেন বলে মনে হয়।
দেশের চার দিকেই যখন এই অবস্থা, তখন পহেলগামে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিত্রটি ভাল হওয়ার কোনও কারণ নেই। আসলে কাশ্মীরের পহেলগামে আক্রমণে পাকিস্তানের যোগ আন্তর্জাতিক মহলে আদৌ কোনও গুরুত্ব পায়নি। ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের যোগাযোগ নিয়ে প্রচারে বিপুল অর্থ ব্যয়ে কয়েকটি সাংসদ প্রতিনিধি দল পাঠায়। তবে নিছক সুললিত ভাষণে যে-হেতু চিঁড়ে ভেজে না, এই সময়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রপুঞ্জের তালিবান অ্যাকশন কমিটির সভাপতি এবং নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কমিটির সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছে। এই সময়েই আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তানকে দুই ভাগে আট হাজার ও বারো হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। ২৫ জুন রাশিয়া, চিন, ইরান, পাকিস্তান-সহ বারোটি দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সংগঠন শাংহাই কোঅপারেশন সংগঠনের যুক্ত বক্তব্যে পহেলগাম বিষয়টি না অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভারত তাতে স্বাক্ষর করেনি। ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার চতুর্দেশীয় নিরাপত্তা সংলাপের ২০২৫ সালের ১ জুলাই-এর বিবৃতিতে পহেলগাম ঘটনার নিন্দা থাকলেও পাকিস্তানের নাম করা হয়নি। ভারত-ঘনিষ্ঠ আমেরিকা পাকিস্তান ও ভারতকে একই স্তরে বিবেচনা করতে গিয়ে কাশ্মীর সমস্যা আবারও আন্তর্জাতিক মঞ্চে উঠে আসছে।
লক্ষণীয়, পশ্চিমি ও মধ্য এশিয়ার আব্রাহামীয় সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সনাতনী সংস্কৃতির অমিল একেবারেই মূলাধারে। ভারতের বহুমাত্রিক সনাতনী সংস্কৃতি আব্রাহামিক পশ্চিমি দুনিয়া বোঝে না, স্বীকৃতি দেয় না। ইউরোপের প্রতিটি বড় শহর এবং খোদ নিউ ইয়র্ক মৌলবাদী আক্রমণে রক্তাক্ত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমি দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রপুঞ্জে ২০২৫ সালেও নারী অধিকার কমিটির সভাপতি হতে পারে সৌদি আরব, সন্ত্রাসবাদ দমনে নেতৃত্ব থাকে পাকিস্তানের হাতে। এবং শরিয়ত যে রাষ্ট্রের সংবিধান, সেই ইরান রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মানিত সদস্য হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে একলা চলাই অভ্যাস করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে ভাবতে হবে, ভারতের কূটনীতিতে ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির উদ্ভাস ঘটানো জরুরি কি না। তা হলে হয়তো নেপাল পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের ভারতীয় সংস্কৃতির মানুষরা অন্তত বোধ করবে যে ভারত তাদের সঙ্গে আছে। শুধু নিজের জিডিপির অঙ্ক, রাজপথ, সেতুর দৈর্ঘ্য, কিছু বিদেশি শংসাপত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজলে হবে না। ভারতীয় কূটনীতির প্রয়োজন দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বোধ। এ কোনও দলীয় কার্যক্রম হতে পারে না। এই বোধকে নিয়ে চলার পথ সন্ধান করতে হবে সমগ্র ভারতীয় সমাজকেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)