বিশ্বকাপ জয় নিয়ে আপাতত আবেগের সমুদ্রে উথালপাথাল ভাসছে ভারত। সোশ্যাল মিডিয়ায় উপচে পড়ছে হরমনপ্রীত-রিচা-স্মৃতি-জেমিমাদের নিয়ে পোস্ট। শুধু মহিলাদের পোস্ট নয়, পুরুষদেরও— তাঁরা লিখছেন, তোমরাই আমাদের ‘হিরো’, তোমাদের জন্য গর্বিত। তা হলে কি শেষ অবধি আমরা পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ— পৌঁছলাম সেই অভীষ্টে, যেখানে ‘মেয়েরাও ক্রিকেট খেলে’, এই কথাটাকে স্বাভাবিক মনে হয়? মেয়েদের দলের জয়েও একই রকম দেশপ্রেম জেগে ওঠে?
যে ওটিটি-তে খেলা দেখাল, সেখানে দেখলাম, ম্যাচের শেষ অবধি ‘ভিউ’ প্রায় ৩২ কোটি। যত বাজি ফাটল ভারতীয় দল ম্যাচ জেতার পরে, সে সংখ্যাও প্রকৃত অর্থেই অভূতপূর্ব। সবই ঠিক, কিন্তু তার পরও সংশয় হয়, সত্যিই কি একটা জয় দূর করতে পারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভিতরে জমে থাকা বহু যুগের গাঢ় অন্ধকার? সত্যিই কি একটা জয় পাল্টে দিতে পারে মানসিকতা? বাজির আলো-শব্দ, সমাজমাধ্যমের বন্দনা, অথবা ওটিটি-র ভিউয়ারশিপ, কিছুই কিন্তু এই প্রশ্নের অকাট্য উত্তর দিতে পারে না। আশঙ্কা হয়, সেগুলো আপাতত মাথা নুইয়েছে মাত্র, মুছে যায়নি।
দাবা থেকে ক্রিকেট, যে কোনও খেলাই তো মেয়েদের জন্যও হতে পারে; মেয়েরাও যে কোনও খেলাই খেলতে পারে। তবু, পুরুষদের থেকে মেয়েদের খেলাকে আলাদা করে আজও আমাদের ভাবতে হয়। ‘রো-কো’ যা করেন বা করতে পারেন, স্মৃতি-হরমনপ্রীতও যে তাঁদের মাঠে একই কাজ করে দেখান, এই সহজ সত্যটা আমরা হজমই করতে পারি না। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্ব জুড়েই কেন যে এই বৈষম্য, তার উত্তর এক কথায় মেলে না। সমস্যাটার মূলে রয়েছে খেলোয়াড়সুলভ মেয়ে চরিত্রের প্রতি আমাদের অহেতুক বিরাগ। মেয়েমাত্রেই নাকি আমাদের দেশে লক্ষ্মী— কিন্তু ‘লক্ষ্মীশ্রী’ কন্যা হয়েও আমি আজ যদি খেলোয়াড় হতে চাই, যদি বিকেলে মাঠে বা পার্কে খেলতে যেতে চাই, তা হলেই সমাজের চোখে আমি অলক্ষ্মী।
১৮৯৩ সালে লেখা হয় ‘সমাপ্তি’। রবীন্দ্রনাথ-সৃষ্ট মৃন্ময়ীকে ‘নানাবিধ নিষেধ পরামর্শ’ শুনতে হয়েছিল— ‘ক্রীড়াসক্তি, দ্রুত গমন, উচ্চহাস্য, বালক দিগের সহিত আলাপ, ক্ষুধা-অনুসারে ভোজন’ চলবে না। ১৩২ বছর আগের লিস্ট অনুসারে কিশোরী মেয়েদের এই গুণাবলি আজও কিন্তু আমাদের সমাজে ‘বেহায়াপনা’ বলেই চিহ্নিত হয়; আজকের মা-মাসিরাও মেয়েদের চরিত্র এ ভাবেই ‘সংশোধন’ করতে বসেন। আর এ ভাবেই মেয়ে-খেলোয়াড়ের মৃত্যু ঘটে।
অথচ আমরা ভুলে যাই, গত শতকের মাঝামাঝি, এই বাংলার মাঠেঘাটেই কিন্তু ছেলেমেয়ে সবাই মিলে ব্রতচারীর মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন; সবাই এক সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন ‘ভুলে মানের বালাই’। সকাল-বিকেল ‘বালকদিগের সহিত’ তাল মিলিয়েই মেয়েরা ‘দ্রুত গমন’-এ পারদর্শী হত, ক্রীড়াতে তাঁদের এ ভাবেই আসক্তি জন্মাত।
মেয়েদের আমরা এখনও ছেলেদের সঙ্গে একত্রে বড় হতে দিতে ভয় পাই— না-জানি কী হয়! ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় কিন্তু ব্রতচারীর মতো মডেলেই ছোটবেলা থেকে মেয়েদের খেলোয়াড় হিসাবে তৈরি করা হচ্ছে। চার-পাঁচ বছর থেকে দশ-বারো বছর অবধি ছেলেমেয়েদের খেলার মঞ্চ একই, কোনও লিঙ্গভেদ নেই। এক সঙ্গে তারা সুইমিং পুলে পাশাপাশি লেনে সাঁতার কাটে, ক্লাবের মাঠে একই দলে ক্রিকেট খেলে।
বয়ঃসন্ধির আগে অবধি মেয়েরা সমানতালে চলে। তার পর, প্রকৃতির নিয়মেই কিশোর পেশির ক্ষমতা সচরাচর কিশোরীদের হারিয়ে দেয়। সেই পর্যায়ে বিভাজন করা ছাড়া গতি থাকে না। তবে, তত দিনে মেয়েরা ছেলেদের পাশাপাশিই খেলোয়াড় হিসাবে গড়ে ওঠে। বিদেশের টিমগুলোতে অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার অলরাউন্ডার অ্যানাবেল সাদারল্যান্ড। অ্যানাবেল দু’বছরের বড় দাদা উইল সাদারল্যান্ডও অলরাউন্ডার, মেলবোর্নের অধিনায়ক। ছোটবেলায় দু’জনে এক সঙ্গে একই ক্লাবে খেলা শিখেছেন। ইংল্যান্ডের ওয়ারিক কাউন্টির মেয়েদের দলের অধিনায়ক জর্জিয়া ডেভিসও ছোটবেলায় স্কুল, ক্লাবে ছেলেদের সঙ্গেই খেলতেন।
বাড়ির মেয়েদের লক্ষ্মীশ্রী ধরে রাখার তাগিদেই আমরা তাদের খেলতে বাধা দিই। আমরা এখনও ধরেই নিই যে, মেয়ে খেলোয়াড় মানেই তাদের ‘চেহারাটা একটু বন্য প্রকৃতি’র এবং ‘পুরুষদের সে দু’চোখে দেখতে পারে না’। আমাদের সামাজিক ধারণাই হল, এ-হেন ‘বন্য প্রকৃতি’র মেয়ে হিসাবে না জন্মালে কোনও মেয়ের পক্ষে খেলোয়াড় হওয়াই অসম্ভব। সামাজিক এই মানসিকতার উপর বিষফোড়া হিসাবে জুড়ে বসেছে মেয়েদের কামনা-বাসনার প্রতি আমাদের নীতি-পুলিশগিরি।
রবিবার রাতে হরমনপ্রীতদের ঐতিহাসিক জয়ে কি পাল্টে যাবে এই সত্যগুলি? যদি পাল্টায়, যদি এর পর থেকে চোখে পড়ে যে, ক্রিকেট কিট পিঠে বাবার বাইকের পিছনে বসে আছে কোনও বালিকা; অথবা পাড়ার ফুটবল মাঠে ছেলেদের সঙ্গেই দাপিয়ে খেলছে কিশোরীরা, এবং সেই ছেলেরাও এই ঘটনাকে স্বাভাবিক হিসাবেই দেখছে— মেয়েদের শরীরকে আক্রমণের কেন্দ্র করছে না, বা মেয়ে বলে তাদের ছাড়ও দিচ্ছে না— সে দিন সত্যিই মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করব যে, ভারত জিতেছে। বহু শতাব্দীর পুরুষতন্ত্রের নিগড় ভাঙার যুদ্ধে জিতেছে ভারত। জেমিমা-স্মৃতি-রিচা-শেফালিদের অশ্রুসিক্ত হাসিমুখগুলো ভারতের সেই জয়ের প্রতীক হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)