E-Paper

যুদ্ধে বাণিজ্যের ক্ষতি

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উত্তপ্ত হওয়া, এবং অপারেশন সিঁদুরের ফলে ভারতের ক্ষেত্রেও কিছু পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করার ব্যাপারে আগের পদ্ধতি বদলেছে।

শৈবাল কর

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৫ ০৫:১২

বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের তুর্কিনাচন চিন-সহ বহু দেশে এক সঙ্গে ঘোর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে গত তিন মাসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ-পরিস্থিতি। ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ আপাতত স্তিমিত— কিন্তু, দিনকয়েক আগেও যেমন পরিস্থিতি ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল যে, হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই শুরু হয়ে যাবে। রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ অব্যাহত। তাতে অপূরণীয় জীবনহানি হচ্ছেই, কিন্তু শুধু আর্থিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলেও সেই যুদ্ধের ক্ষতির মাত্রা অকল্পনীয়। রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের সম্মিলিত আর্থিক ক্ষতির এককালীন হিসাব তিন ট্রিলিয়ন বা তিন লক্ষ কোটি ডলারের কম নয়। ইজ়রায়েলের নিজস্ব হিসাবে তাদের অর্থনীতি মূল কাজ থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্যে হারিয়েছে চার হাজার কোটি ডলারের সম্পদ।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উত্তপ্ত হওয়া, এবং অপারেশন সিঁদুরের ফলে ভারতের ক্ষেত্রেও কিছু পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করার ব্যাপারে আগের পদ্ধতি বদলেছে। যদিও পুলওয়ামা-কাণ্ডের পর থেকেই ভারত আর পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা করে না, কিন্তু এত দিন ঘুরপথে দুবাই আর কলম্বো হয়ে, কখনও বা সিঙ্গাপুর বন্দর ব্যবহার করে, দু’দেশের পণ্য আদানপ্রদান চলছিল। ভারত থেকে যাওয়া চিনি, সিমেন্ট, বস্ত্র, জৈব রাসায়নিক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ইত্যাদির পরিবর্তে পাকিস্তান থেকে আসত মেওয়া, কাগজ, উল, প্লাস্টিক ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল সূত্র মেনে বলা চলে যে, পাকিস্তানের চেয়ে কম দামে যদি অন্য কোনও দেশ থেকে এই পণ্য আমদানি করা যেত, তা হলে ভারত নিশ্চয়ই পাকিস্তান থেকে এগুলি আমদানি করত না। এখন পাকিস্তান থেকে বেরোনো কোনও জাহাজের পণ্যই আর ভারতে আসবে না বলে নতুন নির্দেশিকা ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে, এত দিন পাকিস্তান থেকে ঘুরপথে যে পণ্য আমদানি করা হত, এখন সেগুলি অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। ফলে, আমদানির খরচ বাড়বে; এবং তার চেয়েও বড় কথা, সে দেশগুলির সঙ্গে নতুন ভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে। এর ফলে, অন্তত স্বল্পমেয়াদে, সাধারণ মানুষকে এই পণ্যগুলির জন্য আগের তুলনায় বেশি দাম দিতে হবে। কিন্তু, এই পণ্যগুলোর উৎপাদনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের ক্ষেত্রে বিবিধ অনিশ্চয়তার ফলাফল কী হবে?

ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে তার প্রভাব বাণিজ্যের উপরে পড়ে। উৎপাদন কমে যাবে, না কি আগের মতো চলতে থাকবে; দেশ কি নতুন বাজার খুঁজবে; কর্মীদের চাকরি বজায় থাকবে কি না; বিনিয়োগ অন্য ব্যবসায় চলে যেতে পারে কি না— এগুলোই হল অনিশ্চয়তার মূল কারণ। একটি দেশের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার দরুন ভুল পূর্বাভাস, নীতির অস্থিরতা এবং বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হাতে অস্ত্র হিসাবে থাকে ফিসক্যাল পলিসি এবং মনিটারি পলিসি, বা রাজস্ব নীতি এবং মুদ্রা নীতি। অপ্রত্যাশিত অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়তে পারে দু’গোত্রের নীতির উপরেই, এবং নীতিগুলির কার্যকারিতাও হ্রাস পেতে পারে। ঋণ এবং আর্থিক সংস্কারের বিষয়েও মূলত বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এর উদাহরণ অস্থির সময়ের মুদ্রা নীতি— যেমন মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা স্থির রাখা— ইত্যাদির ক্ষেত্রে হামেশাই দেখা যায়। একই ভাবে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় যদি পরিস্থিতি বদলাতে থাকে, তা হলে পূর্বাভাসের বারংবার পরিবর্তন দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক কার্যকারিতা হ্রাস করবে। উপরন্তু, লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যে দেশে যত অনিশ্চয়তা বেড়েছে, তারা তত বেশি করে বাণিজ্যের উপরে বিধিনিষেধ চাপিয়েছে।

অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে দামের দিক থেকেও। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধ তার একটি উদাহরণ। আমদানি করা হয়, এমন যে কোনও পণ্যের দামের উপরেই প্রভাব ফেলে আমদানি শুল্ক। বাণিজ্য-শুল্কের হার যদি স্থিতিশীল না হয়, যদি তার ওঠা-নামা আগে থেকে আঁচ না করা যায়, তা হলে পণ্যের দামও অনিশ্চিত হবে। উপভোক্তাদের চাহিদার উপরে সেই অনিশ্চিত দামের কী প্রভাব পড়বে, স্বাভাবিক ভাবেই সেটাও অনিশ্চিত। বিশ্ব বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি অনেক দেশের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বদলে দেয়— ফলে, যে দেশের অর্থনীতি অতিমাত্রায় বৈদেশিক বাণিজ্য-নির্ভর, তাদের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক অস্থিরতা বেড়ে যায়। ইউরোপের অনেক ছোট দেশ— যেগুলি মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করে— তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মোট পরিমাণ (অর্থাৎ, মোট আমদানি ও মোট রফতানির যোগফল) জাতীয় আয়ের দেড় গুণ বা দ্বিগুণ। আন্তর্জাতিক অস্থিরতা বাড়লে তাদের ব্যবসার কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং, উৎপাদনের পরিমাণ এবং দাম, এই দুইয়ের যৌথ অনিশ্চয়তা যে কোনও ব্যবসাকে আকস্মিক বিপদের মুখে ফেলে দেয়। স্বল্পমেয়াদে হলেও, হরমুজ় প্রণালী অবরুদ্ধ করে পারস্য উপসাগরে তেলের পরিবহণ বন্ধ করার যে নীতি ইরান নিয়েছিল— তা ঠিক না ভুল, সে বিচার অন্যত্র— তাতে এই অনিশ্চয়তায় আরও ঘৃতাহুতি পড়েছে, কারণ তেলের জোগানের অভাবে উৎপাদন আর এই ঘাটতির কারণে দাম বাড়া এই পরিস্থিতিতে শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

আন্তর্জাতিক স্তরে কত ধরনের সমস্যা ব্যবসাকে প্রভাবিত করতে পারে, তার তালিকা বেশ বড়। যেমন, লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের আক্রমণ, যা ২০২৩-এর নভেম্বরে শুরু হয়েছিল, তাও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পেরেছিল, কারণ এই অঞ্চল দিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে ৪০% আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘটে। মাত্র কয়েক দিন আগে হরমুজ় প্রণালী নিয়ে যে আশঙ্কার সৃষ্টি হল, তাও কিন্তু নতুন নয়। পশ্চিম এশিয়ায়, বিশেষ করে হরমুজ় প্রণালীতে অনুরূপ সংঘাত ঘটেছে এক বছর আগেও, যা বিশ্বব্যাপী পেট্রলিয়াম আমদানিকারী দেশগুলোর ২১ শতাংশকে প্রভাবিত করেছে, আর তেলের দাম বাড়িয়েছে।

উপভোক্তার কথা বাদ দিলে, উৎপাদকের সম্বন্ধে একটা ধারণা পোষণ করা হয় যে, অনিশ্চয়তা ব্যবসার স্বাভাবিক অঙ্গ। ব্যবসায়ী মাত্রেই জানেন যে, প্রতি দিন এক রকম যাবে না; এবং তাঁরা তার জন্যে প্রস্তুত থাকেন। তবে হঠাৎ যুদ্ধ এবং নীতিজনিত অনিশ্চয়তার প্রস্তুতি কেউ নিতে পারেন না। সেখানেই প্রশ্ন ওঠে যে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা ধাক্কা সহ্য করতে পারে যে কোনও সময়? কোভিড সময়ের অনিশ্চয়তা মানুষ তার আগের ১০০ বছরে দেখেনি। আবার ট্রাম্পের মতো নীতিনির্ধারকও ক্ষণজন্মা। এই রকম অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষতি ঠিক কতটা? ব্যবসার দুনিয়ায় অনিশ্চয়তা থাকবেই। কিন্তু, তারও একটা প্রত্যাশিত গড় হার রয়েছে। নতুন তথ্য বলছে যে, সেই গড় অনিশ্চয়তা থেকে প্রকৃত অনিশ্চয়তার বিচ্যুতি এক শতাংশ-বিন্দু বৃদ্ধি পেলেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে ৪.৫%। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় জ্বালানি এবং শিল্পজাত পণ্য। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, যে দেশ থেকে আমদানির উপরে নির্ভর করে দেশ, সেই দেশে সৃষ্টি হওয়া অনিশ্চয়তার প্রভাবও অনেক বেশি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চিন আর ভারতের ক্ষেত্রে জ্বালানি আমদানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশগুলোর মোট আমদানির ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ পশ্চিম এশিয়া, রাশিয়া আর আমেরিকা থেকে সরবরাহ করা তেল। এই দেশগুলোতেই তো যাবতীয় রাজনৈতিক অশান্তি চলেছে এখন।

তবে, আন্তর্জাতিক পরিসরে রাজনৈতিক অশান্তি বাড়লে যে দেশগুলো প্রাকৃতিক সম্পদশালী নয় তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতি বেশি। তেল, কয়লা, লৌহ আকরিক প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্ভার যাদের রয়েছে, আন্তর্জাতিক অশান্তি তাদের বিশেষ কিছু ক্ষতি আর্থিক ভাবে করতে পারে না। যে দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে সমান্তরাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত এবং তার পরিমাণ বেশ বেশি, তাদের ক্ষেত্রেও এই প্রভাব চট করে ক্ষতিকারক হয় না। তুলনায় যে দেশগুলো একই পণ্যের বিভিন্ন অংশ উৎপাদন করে, অর্থাৎ বিশ্ব জোগান শৃঙ্খলে যুক্ত, তাদের ক্ষতি অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অনেক অসুবিধার কথা প্রায়ই উঠে আসে। তার মধ্যে একটি হল যে, ভারতের উৎপাদন পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের মতো এই জোগান শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, ফলে উচ্চ দক্ষতার উৎপাদন করতে পারে না। এর দরুন অন্য যা ক্ষতিই হোক না কেন, অন্তত একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া চলে যে, ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার হাত থেকে বেঁচে যাবে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। এই টালমাটাল সময়ে তাই বা কি কম প্রাপ্তি?

অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tariff War Trade Deals

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy