ছোট্ট শহরে চার-চারটি সিনেমা হলে হইহই করে চলত সিনেমা। সিনেমা শুরুর আগে রঙিন বিজ্ঞাপন। লেবুর গন্ধ ভরা সাবানের বিজ্ঞাপন দেখালেই হল জুড়ে দীর্ঘশ্বাস— “মেয়েটা এই ঝর্নার জলেই ভেসে গিয়েছে শুটিং করতে গিয়ে।” মেয়েটি কি সত্যিই মারা গিয়েছিল? রহস্যের উত্তর ছাড়াই বলা যায়, সে ছিল আমাদের তরুণ বয়সের মুখচ্ছবি। চিত্রতারকাদের সৌন্দর্য সাবানও ছিল। সাবানের সঙ্গে নারী যৌনতাকে সার্থক ভাবে মেশাতে পেরেছে বিজ্ঞাপন জগৎ। সাবান নিয়ে পুরুষের ফ্যান্টাসি ফুটে ওঠে শামসুর রাহমানের ‘সাবান’ কবিতায়— “সেই ঘ্রাণ তাকে ন্যালক্ষ্যাপা করে/ বারংবার, নিয়ে যায় সময়ের অন্য পারে। কার/ গায়ে একরম ঘ্রাণ ছিলো? গোসলের পর খোলা,/ ঈষৎ ফাঁপানো চুলে যে আসতো নিঃশব্দে দ্বিপ্রহরে,/ তার গায়ে? কখনও-সখনও সোনারুর মতো ঢঙে/ চোখ রাখে সাবানের প্রতি...।”
বাংলা সাহিত্যের নায়িকারাও সাবান মাখে। “নিতাইয়ের মেয়ে তেতলায় বাস করে, চেয়ারে বসে দিবারাত্র নাটক নবেল পড়চে। চাকরানি অষ্টপ্রহর কাছে হাজির। ভিনোলিয়া সাবান ছাড়া মাখে না। বিলেত থেকে তার গন্ধ তেল আসে। মাথার ওপর বন বন করে কলের পাখা চলচে। সন্ধেবেলা দেওয়াল টিপলেই আলো।” (সেকালের সমাজচিত্র, দীনেন্দ্রকুমার রায়)
কত গল্পে গামছা আর সাবানের বাক্স নিয়ে স্নানে বা গা ধুতে যাচ্ছে মেয়েটি। বারোয়ারি কলঘর বা পুকুরঘাটে স্নান, যেখানে সাবান ফেলে এলেই হাপিস। মায়েদের সময়ে অনেক বিবাহিতা নারীর ফুলশয্যার তত্ত্বের সাবান ছিল ননদ জায়ের লোভের সামগ্রী, বলে কিংবা না বলেই নিয়ে নিত তারা।
একাধিক জৈব অ্যাসিডের লবণ হওয়ায় সাবানের নির্দিষ্ট সঙ্কেত নেই। কিন্তু সাবান দিয়ে সঙ্কেত পাঠানো যায়, সাবান দিয়ে মান ভাঙানো যায়। চাকরি করা বাবুরা যখন সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরতেন তখন তাঁদের বাক্সে অবশ্যই থাকত বৌয়ের জন্যে সুগন্ধি সাবান। মেয়েদের বাক্সেও থাকত সাবানের কেস। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাক্স বদল’ গল্পে প্রতুলের সঙ্গে বাক্স বদল হয়ে গিয়েছিল কলেজের ছাত্রী অমিয়ার। অমিয়ার বাক্সে পাউডারের কৌটো, ক্রিমের শিশি, আরও নানা শৌখিন জিনিসের সঙ্গে ছিল সাবানের কেসও।
প্রাথমিক ভাবে মেয়েদের সৌন্দর্যের সঙ্গে সম্বন্ধ ছিল না সাবানের। তা ব্যবহার হত কাপড় ব্যবসায় উল আর সুতোকে ঝকঝকে করে তুলতে। “বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ী ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ী, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়।” (দেশে বিদেশে, সৈয়দ মুজতবা আলী)
ধীরে ধীরে তা গায়ে মাখাতেও ব্যবহৃত হতে লাগল আর হয়ে উঠল মূলত মেয়েদের শৌখিন সামগ্রী। এমন তার আবেদন যে রবীন্দ্রনাথের বাঘেও সাবান মাখতে চায়— “ঢেঁকিশালে পুঁটু ধান ভানে,/ বাঘ এসে দাঁড়ালো সেখানে।/ পাকিয়ে ভীষণ দুই গোঁফ/ বলে, ‘চাই গ্লিসেরিন সোপ!’
ছোটো মেয়ে চোখ দুটো মস্ত ক’রে হাঁ ক’রে শোনে। আমি বলি, ‘আজ এই পর্যন্ত।’ সে অস্থির হয়ে বলে, ‘না, বলো, তার পরে।’ সে নিশ্চিত জানে, সাবানের চেয়ে, যারা সাবান মাখে বাঘের লোভ তাদেরই ’পরে বেশি।” (‘সাহিত্যতত্ত্ব’)
রবীন্দ্রনাথই বিশ্বের প্রথম নিরামিষ সাবানের বিজ্ঞাপন করেন— “এমন কোনো বিদেশি সাবানের কথা আমার জানা নেই যা গোদরেজের চেয়ে ভালো। তাই আমি গোদরেজ ব্যবহার করি।” স্বদেশি ভাবনার পথিক আর্দেশির গোদরেজ ১৯১৯-এ সালে বাজারে আনেন পশুর চর্বি বর্জিত বিশ্বের প্রথম শতভাগ বিশুদ্ধ নিরামিষ সাবান ‘চাবি’। ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ঢেউ, হিন্দু-মুসলিমদের নিষিদ্ধ উপাদানের অনুপস্থিতি— দুইয়ে মিলে সাবান সাড়া ফেলে। এই সাবানের বিজ্ঞাপন করেছিলেন সি রাজাগোপালাচারী, অ্যানি বেসান্ত। তবে রবীন্দ্রনাথের ছবি-সহ বিজ্ঞাপন সাবানটিকে নিত্যব্যবহার্য করে।
সাবানে কিন্তু গ্রাম শহরের ভেদ ছিল, এই বিশ্বায়নের যুগেও আছে। এক-একটা সাবান গ্রামেই বেশি চলে, শহর নামও শোনেনি। এক সময় কাপড় কাচার জন্য ছিল অমর, অক্ষয় বাংলাগোলা সাবান। ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া যেত!
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মড়িঘাটের মেলা’য় আছে গ্রামের মেলার সোহাগী সাবানের কথা, কিনে নিয়ে যেতে না পারলে বৌ-ঝিদের জীবন বৃথা। বিক্রির সময় বলা হত, মাখলে খোস-পাঁচড়া জাতীয় অসুখ সারে। ও পার বাংলার গ্রামে-গঞ্জের কসকো সাবান নিয়ে ছড়া চালু ছিল। “…বড় আপুর বিয়ে/ কী কী দিয়ে/ ‘কসকো’ সাবান দিয়ে…”
সেই ট্র্যাডিশন রেখেই এখন বিয়েতে আলাদা ভাবে তৈরি করানো সাবানের চল বাড়ছে। জীবন বেশি লম্বা না ডেলি সোপ, জানা নেই, তবে স্বপ্নের বুদ্বুদ ভাসিয়ে রেখেছে মেয়েদের সাবান-বাসনা!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)