এর পরের বড়সড় যুদ্ধটা কি তবে গ্রিনল্যান্ডকে নিয়ে হতে চলেছে? তেল, গ্যাস, নানা মূল্যবান খনিজে ভরা বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটি কিনে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর, ১৯৪৬ সালেই অবশ্য আমেরিকা গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে শীতল যুদ্ধ লাগলে গ্রিনল্যান্ডকে রক্ষাপ্রাচীর হিসেবে ব্যবহার করা। সে আশা তখন পূর্ণ হয়নি, গ্রিনল্যান্ডে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েই তুষ্ট থাকতে হয়েছিল আমেরিকাকে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ফের গ্রিনল্যান্ড কিনতে চেয়েছিলেন, তবে তখন আগ্রহ ছিল জমি দখলের। এখন সেটাই ‘অত্যাবশ্যক’ হয়ে উঠেছে প্রতিরক্ষার জন্য— ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, সাবমেরিন-বিরোধী অপারেশন প্রভৃতির ঘাঁটি হিসেবে। বরফের আস্তরণের নীচে আণবিক শক্তিসম্পন্ন সাবমেরিন লুকিয়ে রাখার সুবিধে রয়েছে, তাই অনেক বছর থেকেই গ্রিনল্যান্ডকে ব্যবহার করছে আমেরিকা। সরাসরি মালিকানা না থাকলেও, গ্রিনল্যান্ডে আমেরিকার উপস্থিতি ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট। তাই ট্রাম্প কেন পুরোপুরি দখলের কথা বলছেন, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই।
ট্রাম্পের দাবি, রাশিয়া আর চিনের সামরিক বাহিনী একযোগে উত্তর মেরু অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। আমেরিকার অধীনে থাকলে গ্রিনল্যান্ড বেশি সুরক্ষিত থাকবে। অষ্টাদশ শতকে ডেনমার্ক নিজের উপনিবেশে পরিণত করেছিল গ্রিনল্যান্ডকে, যদিও ১৯৭৯-তে তাকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই মুহূর্তে কেবল আমেরিকা নয়, গ্রিনল্যান্ডের উপর দখল বাড়াতে আগ্রহ দেখাচ্ছে অনেকগুলি দেশ— রাশিয়া, চিন, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও। ফ্রান্স, জার্মানির মতো ইউরোপের বৃহৎ দেশগুলো চায় না যে গ্রিনল্যান্ড আমেরিকার হাতে চলে আসুক। তাই তারা ডেনমার্কের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া এবং চিন তাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে আরও উন্নত করছে, যেগুলির গতিমুখ আমেরিকার দিকে। ফলে উত্তর মেরু অঞ্চল বিশ্বে সংঘাতের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
অনেকে মনে করছেন, ট্রাম্প রাশিয়া আর চিনকে প্রতিহত করার জন্যে আমেরিকার প্রভাবাধীন এলাকা তৈরি করতে চাইছেন। গ্রিনল্যান্ডকে একটা ব্যবধান অঞ্চল (বাফার জ়োন) হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর মহাসাগরের গুরুত্বও বেড়েছে। গত চার দশকে উষ্ণায়নের জন্য বিশ্বের গড় হারের চাইতে চারগুণ দ্রুত উষ্ণ হয়েছে উত্তর মেরু অঞ্চল। জাহাজযাত্রার নতুন পথ তৈরি হচ্ছে, ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে উত্তর মহাসাগরের দূরত্ব কমছে।
গ্রিনল্যান্ডের বরফ আস্তরণ দ্রুত গলে যাওয়ায় অনেকে যেমন প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন (সমুদ্রের জলস্তর স্ফীতি, ঝঞ্ঝা প্রভৃতি দুর্যোগ), অন্যরা তেমনই দেখছেন আর্থিক সুযোগ। বরফ গলার ফলে নাগাল পাওয়া যাবে বিরল ধাতু ও খনিজের, যার মধ্যে রয়েছে ‘রেয়ার আর্থ’ বলে পরিচিত মৌলগুলি। এই প্রাকৃতিক সম্পদ বৈদ্যুতিক গাড়ি, হাওয়া বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রের অংশ প্রভৃতি নানা কাজে প্রয়োজন। পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে এই কারণেই গ্রিনল্যান্ডের দর বাড়ছে। বর্তমানে ‘রেয়ার আর্থ’ মৌলগুলির সর্ববৃহৎ ভান্ডার রয়েছে চিনের। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির মতে, এগুলির ষাট শতাংশ বাজার চিনের দখলে। চিনের এই একাধিপত্য ভাঙতে মরিয়া পশ্চিমের দেশগুলো। কাজটা সহজ নয়। ২০২১ সালে গ্রিনল্যান্ডের একটি স্থানীয় সরকার অস্ট্রেলিয়ার একটি সংস্থার খননের লাইসেন্স বাতিল করে ইউরেনিয়াম দূষণের ঝুঁকির জন্য। অনেক দেশই ‘রেয়ার আর্থ’ মৌলগুলি খননে অনুমতি দিতে চায় না এই ভয়ে। অথচ, কয়লা-গ্যাসের মতো দূষণকারী জ্বালানি বর্জন করতে হলে এগুলি অপরিহার্য।
স্বায়ত্তশাসিত গ্রিনল্যান্ডের হাতে কিছু শাসনক্ষমতা থাকলেও তা স্বাধীন দেশ নয়। বিদেশ ও প্রতিরক্ষা কোপেনহেগেন থেকেই পরিচালিত হয়। তবে গ্রিনল্যান্ডের বাসিন্দাদের মধ্যে স্বাধীন হওয়ার আবেগ ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। আগে তাঁদের ‘এস্কিমো’ বলা হত, কিন্তু এখন ওই শব্দটি অসম্মানজনক বিবেচিত হয়। এখন তাঁদের পরিচয় ‘ইনুইট’। গ্রিনল্যান্ডের জনসংখ্যা মাত্র সাতান্ন হাজার, প্রায় নব্বই শতাংশ ইনুইট। গ্রিনল্যান্ডের ঔপনিবেশিক অতীতকে তাঁরা খারিজ করতে চান। যাঁরা গ্রিনল্যান্ডকে উপনিবেশে পরিণত করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম নরওয়ের হান্স এগিড-এর মূর্তিতে ২০২১ সালে লাল রং লেপে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। নীচে লিখেছিলেন, ‘উপনিবেশের অন্ত করো’ (ডিকলোনাইজ়)। ফলে এগিড-এর গ্রিনল্যান্ডে পদার্পণের তিনশো বছর পূর্তি উদ্যাপনের পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছিল।
বহুমূল্য খনিজ মাটির নীচ থেকে তুলতে দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে এখন তীব্র বিতর্ক চলছে গ্রিনল্যান্ডে। কিন্তু পশ্চিমের দেশগুলি চিনের আগে দূষণহীন শক্তিতে বিবর্তন সম্পূর্ণ করতে বদ্ধপরিকর। তার জন্য চাই রেয়ার আর্থ-এর জোগান। গ্রিনল্যান্ডের বাসিন্দারা নিজেদের দেশকে ইউরেনিয়াম দূষণ-মুক্ত রাখতে যতই আগ্রহী হন, আন্তর্জাতিক টানাপড়েনের মাঝে তাঁদের সেই ইচ্ছা অগ্রাধিকার পাবে, সে সম্ভাবনা কম।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)