আবাসনের বাগানে একটা ছোট চৌবাচ্চা আছে। সেখানে জমা জলে কিছু ব্যাঙ-ব্যাঙাচি খেলে বেড়ায়। সে-দিন দেখি বেশ কয়েকটা বাচ্চা তুমুল উৎসাহে জলে পাথর ছুড়ছে আর বিপুল পুলকে হাততালি দিচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখি, তাদের নির্ভুল লক্ষ্যভেদে কয়েকটা ব্যাঙ মরে জলে ভাসছে, আর তাতেই কচিকাঁচাদের বিজয়-উৎসব। আমার দেখাদেখি আরও এক জন আবাসিক কাছে এসে দাঁড়ালেন, প্রাণী-নিধনে শিশুদের উৎসাহ দেখে তাঁর মন্তব্য, এদের বাপ-মা’রা কি কোনও শিক্ষাই দেয়নি! বড় হয়ে এরাই গণপিটুনিতে যোগ দেবে। তার ট্রেনিং চলছে।
সত্যিই কি তা-ই? হিংসার বীজ কি শৈশবেই উপ্ত হয়? শিশুর লালনপালন পদ্ধতির মধ্যেই কি সে-বীজ আত্মগোপন করে থাকে? শৈশবের সহিংস মনোভাব কি উত্তর-জীবনকে বিড়ম্বিত করে? স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজি ও নিউরোলজির অধ্যাপক রবার্ট স্যাপলস্কি বলছেন, পারিবারিক হিংসা, যুদ্ধ কিংবা গণহত্যার স্মৃতি শিশুর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়, তার আবেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। বড় হলে বিষণ্ণতা, হতাশা, উদ্বেগ আর আগ্রাসনের ঝুঁকি বাড়ায়। দেখা গেছে, যৌবনে হিংস্র অপরাধীর সহিংস শৈশব ছিল। স্যাপলস্কি বলছেন, এ ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
একটা সময় ছিল যখন ও দেশে কিংবা এ দেশে অভিজাত পরিবারে শিশুপালন পদ্ধতিতে মায়ের ভূমিকা ছিল নিতান্তই নগণ্য। সারা দিন সারা রাত মায়ে-পোয়ে দেখা নেই। ছেলে আছে দাসদাসীদের জিম্মায়। ১৯০০ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু মনস্তত্ত্ববিদ লুথার হোল্ট নিদান দিয়েছিলেন, বাচ্চাকে হাপুস নয়নে কাঁদতে দাও, সারা ক্ষণ তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করার আদিখ্যেতা ছাড়ো। বাচ্চা মানুষ হোক ন্যানির কাছে, রাতে শুতে যাওয়ার আগে বাচ্চাকে আনা হোক মায়ের কাছে। কেন শিশু মায়ের কাছেই সারা ক্ষণ লেপ্টে থাকতে চায়, আচরণবাদীরা তার কেজো ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, খিদে পেলে শিশুর মুখে মা-ই খাবার তুলে দেন, তাই মায়ের প্রতি ছেলের এত টান। আবার ফ্রয়েডবাদীরা বললেন, শৈশবে ‘ইগো’-র বিকাশ হয় না, ফলত তারা মায়ের স্তনবৃন্ত ছাড়া কিছুই চেনে না। মোটকথা, বিগত শতকে শিশুপালনের তত্ত্বটা দাঁড়াল এই রকম: শিশুদের চোখের দেখা দেখো, কিন্তু তাদের কথা কানে তুলো না। তাদের নিউট্রিশন আর শরীরের টেম্পারেচার যদি ঠিকঠাক বজায় রাখতে পারো তো ব্যস, তুমি আদর্শ মা, আর শিশুও মুক্তছানা। মায়ের স্নেহ, ভালবাসা, আদরের শরীরী স্পর্শ সব ফালতু।
এই ধরনের চিন্তা শিশুর মানসিক বিকাশে একটা বড় ক্ষতি করেছিল। শিশুকে অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলেও, মাকে সেখানে থাকতে দেওয়া হত না। হাসপাতালে মাকে মনে করা হত অপ্রয়োজনীয় উপদ্রব, মায়ের স্নেহ আবেগতাড়িত উৎপাত। যুগটা ছিল রোগের ‘জার্ম থিয়োরি’র যুগ। আগে মনে করা হত রোগব্যাধির কারণ হল দূষিত বাতাস। এখন বলা হল বাতাস নয়, সব রোগের মূলে আছে জীবাণু। তাই তিনিই সবচেয়ে ভাল মা যিনি তাঁর শিশুকে সবচেয়ে কম ছোঁয়াছুঁয়ি করেন। ১৯৫০-এর দশকে ব্রিটিশ মনোরোগবিদ জন বোলবি কিন্তু বললেন, শিশুরা স্রেফ অবলা জীব নয়, তাদেরও সংবেদনশীল মনোযোগ প্রয়োজন। ‘অ্যাটাচমেন্ট থিয়োরি’র প্রবক্তা বোলবি মা-শিশুর আত্মিক বন্ধনের উপর জোর দিলেন। বললেন, শিশুরা মায়ের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে ভালবাসার উষ্ণতা, সম্পর্কের ধারাবাহিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা। তা না পেলে শিশু বেড়ে ওঠে উদ্বিগ্ন, অবসাদগ্রস্ত, সংযোগহীন, আগ্রাসী হয়ে। হ্যারি হারলোর গবেষণা বলল, ‘ম্যান ক্যাননট লিভ বাই মিল্ক অ্যালোন। লাভ ইজ় অ্যান ইমোশন দ্যাট ডাজ় নট নিড টু বি বটল- অর স্পুন-ফেড’।
সারা আমেরিকা জুড়ে ১৯৯০-এর দশকে ক্রাইম রেট ভয়াবহ বেড়ে গেল। কেন? লিবারালরা বললেন, এর জন্য দায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। কনজ়ারভেটিভরা দায়ী করলেন পুলিশি তৎপরতার জন্য বাজেট বৃদ্ধিকে। আইনজ্ঞরা বললেন এর জন্য দায়ী গর্ভপাতকে আইনি স্বীকৃতিদান। নিউরোলজির অধ্যাপক রবার্ট স্যাপলস্কি ইদানীং এর একটা নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। প্রশ্ন করছেন, একটি জীবন কখন অপরাধ জগতের দিকে ধেয়ে চলে? সে-ই কি অপরাধী হয়ে ওঠে, যে মনে করে সে মায়ের কাছে বাঞ্ছিত নয়, যার বেঁচে থাকা, না থাকা মায়ের কাছে সমমূল্যের?
এটা ও-দেশের গল্প। কিন্তু গল্পটা এ-দেশে কি অচেনা? আমরা কতটুকু সময় দিই আমাদের শিশুদের জন্য? যেটুকু দিই তা বেশির ভাগই স্কুলের হোম টাস্ক কেন্দ্রিক। শিশুদের ব্যস্ত রাখতে আমরা তাদের হাতে যে খেলনা তুলে দিই, তা প্রায়শই যুদ্ধাস্ত্র। যে বাড়িতে বাচ্চা আছে, সে বাড়িতে সারা ক্ষণ একটাই আবহ সঙ্গীত: ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই, ঢিসুম ঢিসুম। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন টিভি, ফিল্ম, সংবাদ, মিউজ়িক ভিডিয়ো, ভিডিয়ো গেমসে ভায়োলেন্সের ছবি দেখতে দেখতে শিশু নিজেকেই ভায়োলেন্স সংগঠনের কেন্দ্রীয় চরিত্র কল্পনা করতে থাকে। নিজেকে একটা নায়কোচিত ভূমিকায় দেখতে ভালবাসে।
স্কুলে বাচ্চারা প্রায়ই সমবয়সিদের বুলিং বা হুমকির শিকার হয়, কিংবা নিজেরাই বুলিং-এ হাত পাকায়। মনোবিদরা বলছেন, বুলিং সংগঠক প্রধানত দু’ধরনের। এক, স্বভাব-উদ্বিগ্ন, অন্যমনস্ক, বোকাসোকা বাচ্চা বুলিং করে স্রেফ ফ্রাস্ট্রেশন থেকে, বন্ধুমহলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য। দুই, আত্মবিশ্বাসী, নির্দয়, নিরুদ্বেগ যে কিশোররা বুলিং করে তারা নাকি ভবিষ্যতের ‘সোশিয়োপ্যাথ’, যারা পরবর্তী জীবনে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে সামাজিক নিয়ম উপেক্ষা করেই। স্যাপলস্কি বলছেন, যারা স্কুলে দুর্বলের উপর বুলিং করে, বাড়িতে তারা নিজেরাই বাবা-মা বা দাদা-দিদির বুলিং-এর শিকার হয়। তাঁর মতে, এরাই বড় হয়ে হাতে অস্ত্র ধরে, হুমকি দিয়ে বেড়ায়।
আজ আমাদের চার পাশে এত রকমের হাতকাটা মদন আর কানকাটা কানাইদের দাপাদাপি, হুমকি আর থ্রেট কালচারের এত রমরমা, এত রকমের নির্বিচার ধর্ষণ আর বিকারগ্রস্ত ধর্ষকের উপদ্রব। এ দেশে ও দেশে প্রকাশ্য জনস্থানে বর্বর উন্মত্ততা। এ সবের শিকড় কোথায় নিহিত, খোঁজ করা যায়?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)