E-Paper

যুদ্ধেরও থাকে স্থাপত্যশিল্প

যুদ্ধ ও গণহত্যার পিছনে শুধু যে অর্থনীতি কাজ করে তা-ই নয়, তাকে অস্ত্রের মতো কাজেও লাগানো হয়। এই দায়ভাগ তৎকালীন ব্রিটিশ প্রভুরা কি অস্বীকার করতে পারেন?

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৫ ০৬:৩২
লক্ষ্য: বাড়ির ভিতরে থেকেও ধ্বংস থেকে রক্ষা পাননি প্যালেস্টাইনের মানুষ, গাজ়া, ২৮ জুন।

লক্ষ্য: বাড়ির ভিতরে থেকেও ধ্বংস থেকে রক্ষা পাননি প্যালেস্টাইনের মানুষ, গাজ়া, ২৮ জুন। ছবি: পিটিআই।

পঞ্চাশের সেই মন্বন্তরে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বাংলায়? প্রায় ত্রিশ লক্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। যুদ্ধক্ষেত্রে খাদ্যবস্ত্রের চাহিদা মেটাতে যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হয়েছিল কয়েক লক্ষ নিরীহ প্রাণ। এ তো গণহত্যারই শামিল। কাজেই যুদ্ধ ও গণহত্যার পিছনে শুধু যে অর্থনীতি কাজ করে তা-ই নয়, তাকে অস্ত্রের মতো কাজেও লাগানো হয়। এই দায়ভাগ তৎকালীন ব্রিটিশ প্রভুরা কি অস্বীকার করতে পারেন?

এই অবধি আমাদের জানাই ছিল। বিষয়টি আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল বিশেষত গাজ়া ভূখণ্ডে ইজ়রায়েলের ব্যাপক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে। দুর্ভিক্ষে ধুঁকছে সেই বধ্যভূমি। রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে নাকি প্রতি দিন জমা পড়ছে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ। ইজ়রায়েলি ফৌজের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভূরি ভূরি উদাহরণ পেশ করছেন যাঁরা, তাঁদের কারও-কারও উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে আমেরিকান প্রশাসন। এমনকি হেগ-এর আন্তর্জাতিক আদালতে ফৌজদারি মামলায় ইজ়রায়েল ইতিমধ্যেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত। কিন্তু আমেরিকার মদতপুষ্ট হওয়ায়, তার টিকি ছোঁয়া যাচ্ছে না।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পৃথিবী জুড়ে উপনিবেশ-অবসান ভেবে আমরা যারা স্বপ্নে বিভোর থেকেছি, তাদের অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে পশ্চিম এশিয়ায় নতুন উপনিবেশের এই দ্বারোদ্ঘাটন। আর উপনিবেশ মানেই লুণ্ঠন ও যুদ্ধ। লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ। প্যালেস্টাইনে এই মুহূর্তে যা অবাধ ও লাগামহীন।

প্যালেস্টাইন যে ইজ়রায়েলের উপনিবেশ— গাজ়ার বসতি-বিন্যাসই তা চোখে আঙুল দিয়ে বলে দেয়। ইজ়রায়েলি প্রভুদের বসতি পাহাড়ের নিরিবিলি উচ্চ মিনারে। নীচে, তাঁদের নজরদারিতে, উপত্যকায় প্যালেস্টাইনিদের ঘিঞ্জি ঘরদোর। ইজ়রায়েলিদের জন্য উন্মুক্ত হাইওয়ে। প্যালেস্টাইনিদের ভাগ্যে একের পর এক চেকপয়েন্ট। উপরে নিরাপত্তা ও মুক্তি, নীচে বিপন্নতা ও অবরোধ।

প্রায় এক শতক ব্যাপী দীর্ঘকালীন এই যুদ্ধ। প্যালেস্টাইনিরাও নিজের জমি কামড়ে রয়েছেন। জারি থেকেছে তাঁদের কড়া প্রতিরোধ। যুদ্ধাপরাধে পিছপা নন তাঁরাও। তবে ক্রমে যুদ্ধ হয়ে উঠেছে পুঁজি ও যন্ত্রের রঙ্গভূমি, আদ্যন্ত এক কৌশলের খেলা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পূরণ করল শিল্প ও দর্শনের স্থান। ভয়ঙ্কর কেজো যুদ্ধের আবহে সুকুমার বৃত্তির তালমিল ঘটানোই মুশকিল, তবু শিল্প দর্শন ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটেছে একটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখায়, স্থাপত্য-বিদ্যা।

স্থাপত্য-বিদ্যার প্রয়োগ-ক্ষেত্র উন্মুক্ত স্থান। যে কোনও শূন্যস্থানকে ব্যবহারিক নির্মাণে পরিণত করাই তার উদ্দেশ্য। গত শতকের উত্তর-আধুনিক দর্শনে স্থান বা পরিসর নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা উন্মোচিত হয়েছিল। ‘অন্দর-বাহির’, ‘উঁচু-নিচু’, ‘সামনে-পিছন’এর প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিয়ে এই দর্শন বিকল্প কিছু ধারণা পেশ করেছিল। এই সব বিমূর্ত বিচিন্তনের যে কোনও ফলিত রূপ সম্ভব, তা এত দিন ছিল চিন্তার অতীত। অথচ ‘বামপন্থী’ ঘরানার সেই ফসল, উত্তর-আধুনিক দর্শনকেই গোলায় তুলেছে ‘দক্ষিণপন্থী’ শিবির। তাকে কাজে লাগাচ্ছে খোদ যুদ্ধক্ষেত্রে।

গাজ়া ভূখণ্ডে সাবেক প্যালেস্টাইনি শিবির হল অলিগলিময় এক গোলকধাঁধা। গায়ে-গায়ে লাগা বাড়ি। গলিঘুপচির মধ্যে কোথায় শমন দাঁড়িয়ে বলা মুশকিল। ইজ়রায়েলি ফৌজের চিরুনি-তল্লাশে নামতেই যেন ভয়। তাই তারা অভিযানের সময় শরণ নেয় ফরাসি উত্তর-আধুনিক ভাবুকদের। হ্যাঁ, সৈনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ক্লাসঘরে এখন মুখে মুখে ফেরে জিল দ্যল্যোজ়, ফেলিক্স গুয়াতারি, গি দ্যবর-এর নাম। এই সামরিক কেন্দ্রগুলিকে কর্তারা বলেন ‘স্থপতি’ গড়ার ইস্কুল।

স্থাপত্য-বিদ্যা ও যুদ্ধের মধ্যে মূলগত সাদৃশ্য চোখ এড়িয়ে যাওয়ার নয়। দু’টিরই সংযোগ স্থানের সঙ্গে, স্থানের দখল ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে। ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিদরা জানেন, সাবেক যুদ্ধশাস্ত্র দিয়ে হবে না। প্যালেস্টাইনি সৈনিকদের নাস্তানাবুদ করতে হলে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে। অপ্রচলিত আঙ্গিকে ‘অন্দর ও বাহির’-এর দিকে তাকাতে শিখতে হবে। গলিঘুঁজিরাস্তাকে ‘বাহির’ আর ঘরকে ‘অন্দর’ ভাবার গতানুগতিক স্থানাঙ্ককে উল্টে দিতে হবে। ঘরের ভিতরটাকে ‘বাহির’ এবং বিপজ্জনক গলিঘুঁজিকে ‘অন্দর’ ভাবা অভ্যাস করতে হবে।

যেমন কথা তেমন কাজ। গাজ়ার গলিঘুঁজি মানে প্যালেস্টাইনি বাহিনীর গড়। অতএব তাকে পরিহার করে প্যালেস্টাইনিদের বাড়ির মধ্যে দিয়ে নতুন ‘রাস্তা’ বানিয়ে নিতে শুরু করল ইজ়রায়েলি সেনা। স্যাটেলাইট ও ড্রোনের মাধ্যমে ছবি তুলে প্রথমে প্রতিপক্ষ শিবিরের একটি আনুপুঙ্খিক মানচিত্র নির্মাণ। তার পর, গলি বা বাড়ি শুধু নয়, ঘরের খুঁটিনাটি আসবাবের অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান। তার পর, প্রয়োজনমাফিক কখনও হাতুড়ি, কখনও বিস্ফোরক, কখনও বুলডোজ়ার বা ট্যাঙ্ক দিয়ে বাড়ি ভেদ করে রাস্তা বানাতে বানাতে অভিযান।

সদর দিয়ে প্রবেশ না করে, ধরা যাক, শয়নকক্ষের দেওয়াল ভেঙে প্রবেশ-পথ গড়ে নেওয়া হল। নিজ কক্ষে নিদ্রামগ্ন প্যালেস্টাইনি রাতে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে দেখলেন সশস্ত্র ইজ়রায়েলিরা তাঁর বিছানার চার পাশে দাঁড়িয়ে। তার পর বাসিন্দাদের বাড়ির কোনও একটা ঘরে তালাচাবি দিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি ও কিছু লোককে হত্যা করে ফেলা হল। তার পর দুই বাড়ির মধ্যবর্তী দেওয়ালে ছ্যাঁদা করে পরের বাড়ির দিকে বাহিনী মন দিল।

রান্নাঘর, বাথরুম না কি ঘরের সিলিং— ইজ়রায়েলি সৈনিক বাড়ির ঠিক কোন দেওয়ালটা ফুঁড়ে ঢুকবে এক জন প্যালেস্টাইনির পক্ষে আগে তা আন্দাজ করা প্রায় অসাধ্য। বস্তুত, উত্তর-আধুনিক এই ‘অপ্রত্যাশিত’র নিপুণ ব্যবহার ইজ়রায়েলি সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। মৌমাছির মতো ঝাঁক বেঁধে সৈনিকের এই চলাচল মোটেই একরৈখিক নয়। বরং যুগপৎ বিভিন্ন প্রস্থান-বিন্দু থেকে শুরু হয়ে জালের মতো ছড়ানো ও বহুরৈখিক।

বাস্তুশাস্ত্র ও নগর পরিকল্পনায় একটা শব্দ ইদানীং বিশেষজ্ঞ মহলে বেশ চালু হয়েছে— আর্বিসাইড বা নগরনাশক। পুকুর গায়েব করে প্রোমোটারি তার এক হালকা উদাহরণ। গোটা এক নগর বা তল্লাটকে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে নগরোন্নয়ন-উদ্যোগ। এই ধারণাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এখন প্যালেস্টাইনের বুকে ইজ়রায়েলি বসতিগুলিতে। বিশেষ বুলডোজ়ারের সাহায্যে প্যালেস্টাইনি শিবিরগুলি ভিতের তলা থেকে চেঁছে তুলে ফেলা হচ্ছে। শুধু ঘরবাড়ি নয়, রাস্তাঘাট গাছপালা কৃষিজমি সমেত গোটা এক সভ্যতাকে ঘষে মুছে ফেলা হচ্ছে। ১৯৪৮ থেকে ২০০০, কমবেশি পঞ্চাশ বছরে প্রায় শ-চারেক প্যালেস্টাইনি গ্রামকে স্রেফ উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দুই দেশের মাঝখানে টানা ‘সবুজরেখা’র মান্যতা রাখার কোনও প্রয়োজনই আর নেই। অধিকৃত প্যালেস্টাইনে ইজ়রায়েল ইতিমধ্যেই অসংখ্য বসতি স্থাপন করে ফেলেছে। সার্বভৌম প্যালেস্টাইনের অস্তিত্বই আজ অর্থহীন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গাজ়ায় যা চলছে তার নাম দেওয়া যায় ‘গণহত্যার অর্থনীতি’। কেউ কেউ বলছেন ‘গণহত্যার স্থাপত্যশিল্প’। আপাত বিশৃঙ্খলার নীচে রয়েছে পরিকল্পিত বিশাল আর্বিসাইড-এর নীল নকশা। সেই নকশা অনুযায়ী গাজ়া এখন দুই ভাগে বিভক্ত। সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে তার উত্তর ভাগটি খালি করে মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে চলে যেতে। এই অংশটিতেই অধিকাংশ উর্বর কৃষিজমি। এবং বোমাবর্ষণ করে এলাকা খালি করার পর বাহিনী ঢুকছে বড়-বড় পে-লোডার নিয়ে। বিধ্বস্ত বাড়িগুলির ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাঙাচোরাগুলো জমিয়ে রাখা হচ্ছে সযত্নে। ভবিষ্যতে ইজ়রায়েলি বসতি-নির্মাণের কাঁচামাল হিসেবে। এই ভাবে ক্রমশ প্যালেস্টাইনিরা নিজভূমে পরদেশি হয়ে উঠবেন, প্যালেস্টাইন হয়ে উঠবে ইজ়রায়েল।

‘ফরেনসিক আর্কিটেকচার’। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কর্মীদের কাছে চেনাজানা নাম। ফরেনসিক স্থপতিরা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে ধ্বংসস্তূপের চরিত্র দেখে ধ্বংসকারীর উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করেন। পরে যাতে প্রমাণগুলি আন্তর্জাতিক আদালতে পেশ করা যায়।

শক্তিশালী এক দেশের বিরুদ্ধে কাজ। স্বভাবতই তাঁদের পথ খুব বন্ধুর। প্যালেস্টাইনে যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে মানবাধিকার কর্মীদের পক্ষে এই কাজটি করছেন ইজ়রায়েলি বংশোদ্ভূত এক স্থপতি— আইয়েল ভাইজ়মান। বলা বাহুল্য, তিনি বা তাঁর সহযোগীরা এখন হয়ে উঠেছেন ইজ়রায়েলি পথের অন্যতম বড় কাঁটা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

gaza palestine

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy