আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’। বিরোধী-বক্তব্য নস্যাৎ করতে আসনসংখ্যা তুলে ধরার ‘ঐতিহ্য’ নতুন নয়। দলনির্বিশেষে শাসকের মুখে একই গোছের কথা শোনা গেছে ও যাচ্ছে। রাজনৈতিক তরজায় ক্ষমতাসীন দলের নিজ অবস্থানকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মত বলে চালানো এক রকম নিয়মে পর্যবসিত, এবং তা শুধু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ভারতে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু, তাতে কিছু ব্যতিক্রম বাদে আইনসভায় আসনসংখ্যার বিচারে শাসককে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি ভাবা যায় না। নির্বাচনে মোট ভোটের শতাংশের হিসাবেই তা স্পষ্ট। তাই পরিস্থিতি বিশেষে বিরোধী দলগুলি দুর্বল হলেও, সামগ্রিক ভাবে শাসক দল তথা সরকারের বিরোধিতা কখনও দুর্বল হয় না। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যেই নানা কারণে সরকার-বিরোধিতার মনোভাব থাকে। ভোটবাক্সে হয়তো তা বোঝা গেল না, কিন্তু রাজপথে সেই শক্তি সংহত হতে পারে। এই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতার অভাবই শাসকের ক্ষমতার দম্ভ হয়ে ফুটে বেরোয়। শাসক-বিরোধিতা তীব্রতর হয়।
এই বিরোধিতাই দেশের গণতন্ত্রকে সজীব, বেগবান রাখে, সেই বোধের অস্তিত্বই এ কালে ক্রমশ প্রশ্নের মুখে পড়ছে। শুধু কেন্দ্রীয় স্তরে নয়, পাড়া বা গ্রাম স্তরেও শাসক ও বিরোধী-সমর্থকদের পারস্পরিক আদানপ্রদানে ছায়া ফেলছে এই প্রবণতা। আশাপূর্ণা দেবী লিখেছিলেন, হয়তো যাকে হিংস্র অত্যাচারী মনে হয়, সে মূলগত ভাবে হিংস্র নয়, অত্যাচারী নয়, অবোধ মাত্র। এই বোধহীনতাই পরে অত্যাচারের চেহারা নেয়। তৃণমূল স্তরের এই বোধহীনতা কাজে লাগিয়ে ভোটের আগে-পরে বা কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক শোরগোল উঠলে পাড়ায় পাড়ায় আরও বিভেদ তৈরি করে স্বার্থান্বেষীরা।
নির্বাচনে জিতে গেলে প্রশাসনের দখল হাতে আসে, সেই ক্ষমতায় দমিয়ে দেওয়া যায় ঘনীভূত বা বিক্ষিপ্ত বিরোধী স্বরকে। এই ভাবনা থেকেই বার বার আসে আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বিষয়ে কথা বললে সরকারি সাহায্য তো বটেই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে সংবিধান আরোপিত দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করার প্রবণতাও দিন দিন প্রকট হয়— এই ভাবনা থেকেই। দায়িত্বভার নেওয়ার সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভয়, পক্ষপাত ও দ্বেষবিরহিত ভাবে সংবিধান রক্ষা করার যে শপথ নিতে হয়, সহজেই তিনি তা বিস্মৃত হন। মতাদর্শগত ভাবে সমর্থকই হোক বা বিরোধী, তাঁরা যে সকলের প্রতিনিধি, সেই সত্যের বিস্মরণ খুব দ্রুত ফুটে ওঠে তাঁদের কাজেকর্মে। ইদানীং এমনও দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমের পরিসরেও তাঁরা ফুটিয়ে তুলছেন নিজেদের মূঢ়তা।
আসলে রাজনীতি আজ সমষ্টিকেন্দ্রিকতা ছেড়ে বড় বেশি করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। শাসক দেখাচ্ছেন, যেন নেতা বা নেত্রী নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা সামর্থ্য থেকে জনহিতকর প্রকল্পের সুবিধা ‘দান’ করছেন। ঠিক একই ভাবে বিরোধী দল বা তার সমর্থকরাও সুবিধাভোগীকে ‘ভাতাজীবী’ কিংবা ‘ভিখারি’ হিসাবে দাগিয়ে দিতে কসুর করছেন না। কিন্তু সাংবিধানিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে দুই অবস্থানই শত যোজন দূরে। কোনও ভারতীয় নাগরিক সরকারি প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করলেও, অন্য নানা বিষয়ে তাঁর সরকারের বিরোধিতা করার অধিকার কোনও ভাবেই খর্ব হয় না। মূলত এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকেই রাজনীতিতে এক ‘বাইনারি’র ধারণা গড়ে উঠছে— হয় তুমি আমার দলের পক্ষে, নয় তুমি বিরোধী। আর যদি তুমি পক্ষে হও, তা হলে কোনও বিষয়েই বিরোধিতা করতে পারবে না। একই ভাবে এক বার কোনও বিষয়ে বিরোধিতা করলে আর কোনও বিষয়ে সমর্থনকেই দেখা হবে সন্দেহের চোখে। খোঁজা শুরু হবে অন্তর্ঘাতের তত্ত্ব।
দলীয় রাজনীতির এই চক্রব্যূহ থেকে মুক্তির দিশায় এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন যেন ঘন মেঘে এক রুপোলি রেখা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও মানুষ নিজেদের ছোট ছোট উৎকণ্ঠাগুলিকে তুলে আনছেন প্রতিবাদের ভাষায়। তবে ব্যক্তিগত স্তরে ক্ষমতার বিরুদ্ধে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের এই রাজনীতি কতটা প্রতিষ্ঠা পেল, দলীয় পতাকার পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বেরিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানোর পরিসরকে কতটা সম্প্রসারিত করতে পারল সাম্প্রতিক গণআন্দোলন-প্রবণতাগুলি, তা ভবিষ্যৎই বলবে। এই আন্দোলনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে ভবিষ্যতে যদি শাসক দলের প্রতিনিধিরাও দলের প্রতি নিজের আনুগত্যকে প্রশ্নের মুখে না ফেলে শাসনব্যবস্থার নানা ফাটল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন, সেটাও এই আন্দোলনেরই এক অর্জন বলে মানতে হবে। ভয় শুধু ঘোলা জলে মাছ ধরার কারবারিদের নিয়ে, সেই আশা তারা বাস্তবে রূপ নিতে দেবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy