সেপ্টেম্বর মাসে জিএসটি-র নতুন হার ঘোষিত হওয়ার সঙ্গেই বলা হল যে, এর ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা উজ্জীবিত হবে। দেশে চাহিদা-জোগানের প্রত্যেক তিন মাসের পরিসংখ্যান সরকারের ঘরে থাকে বটে, কিন্তু কোনও পর্যবেক্ষকের পক্ষে তা তৎক্ষণাৎ আহরণ এবং বিশ্লেষণ করা ভারতে প্রায় অসম্ভব। ফলে জিএসটি-র হার কমলে চাহিদার কী হবে, স্বল্পমেয়াদে তা অনেকটাই তাত্ত্বিক অনুমান-নির্ভর বা পুরনো প্যাটার্নের অনুবর্তী। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, সদ্য জানা গিয়েছে যে, ২০২৫-এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অবধি ভারত জিডিপি বেড়েছে ৮.২% হারে। এই বৃদ্ধিতে কিন্তু জিএসটি-র হার কমার অবদান নেই, বা থাকলেও অতি সামান্য— কারণ, জিএসটি কমেছিল সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ, অতএব এই হিসাবে তার প্রভাব পড়ার সময়ই ছিল না।
যে কোনও ভোগ্যপণ্যের উপরে কর চাপালে তার প্রভাব চাহিদার উপরে কতটা পড়বে, তা নির্ভর করে পণ্যের ধরনের উপর। এক জন কর্মীর যদি পারিশ্রমিক ছাড়া আর কোনও রোজগার না থাকে, তা হলে পণ্যের উপরে কর তার রোজগারের উপরে প্রত্যক্ষ কর আরোপের সঙ্গে সম্পূর্ণ তুলনীয়। এ ক্ষেত্রে, দাম বাড়লেও যে পণ্যের চাহিদা তেমন কমে না, সেগুলি ‘অত্যাবশ্যক পণ্য’— খাদ্যশস্য, দুধ, ওষুধের মতো পণ্য। দামের বাড়া-কমার সঙ্গে এই জাতীয় পণ্যের চাহিদার কমা-বাড়া তুলনায় কম হয়। যে পণ্য অত্যাবশ্যকীয় নয়, সেগুলির চাহিদা দামের ওঠা-পড়ার ক্ষেত্রে বেশি সংবেদনশীল।
জিএসটি যে-হেতু অপ্রত্যক্ষ কর, ফলে জিনিস না কিনলে তা দিতে হয় না; কিন্তু দিতে হলে সেই করের হারে গরিব-বড়লোকের ভেদাভেদ থাকে না। একটি নির্দিষ্ট হারে আরোপিত অপ্রত্যক্ষ কর তাই আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। কোন পণ্য সমাজের কোন স্তরের মানুষের কাছে কতটা আবশ্যক, তার প্রমাণও তাই পাওয়া যায় অপ্রত্যক্ষ কর আরোপ করলে তার চাহিদা কতটা কমছে, তার মধ্যে দিয়ে।
এর যে প্রধান পরিমাপ সেটা জাতীয় আয়কে তিন ভাগে বিভক্ত করে পাওয়া যায়। এক, জিএসটি-র গড় হার; দুই, জিএসটি বাদ দিয়ে ভোগ্যপণ্যের উপরে খরচ; এবং তিন, মোট রাজস্বের কতটা জিএসটি-র গড় হার ও ভোগব্যয়ের দরুন জমা হচ্ছে। তৃতীয় হিসাবটি আসলে জিএসটি-র কার্যকারিতার পরিমাপ। ভারতে শুরু থেকেই বিভিন্ন খুচরো পণ্যের উপর নানা হারে জিএসটি থাকার কারণে একটি গড় হার নির্ণয় করা শক্ত হয়েছে। এখন তা কমে চারটি হলেও হারের ব্যাপ্তির কারণে একটি নির্দিষ্ট হার ব্যবহার করা চলে না। এর অর্থ হল, জিএসটি-র সামগ্রিক কার্যকারিতা ঠিক কতটা তা বলা যায় না। বরং, পণ্যবিশেষে তা বলা সম্ভব, যদি যথাসময়ে ভোগব্যয়ের হিসাব দাখিল করে জিএসটি পরিষদ।
পণ্যের চাহিদার উপর জিএসটি কী প্রভাব ফেলবে, তার মূল ধারণাটি আসে ক্রেতা এবং বিক্রেতা কী ভাবে আরোপিত করের বোঝা ভাগ করে নিচ্ছেন তার থেকে। কিছু কিনতে গিয়ে যদি ক্রেতার মনে হয় যে, কর দিয়ে দাম বড্ড বেশি পড়ছে, তা হলে চাহিদা কমে যাবে। আগের চাহিদা এবং বিক্রি বজায় রাখতে গেলে বিক্রেতাকে কিছু ছাড় দিতে হবে, যার অর্থ হল, তিনিও করের বোঝা আংশিক ভাবে বহন করছেন। জিএসটি-র হিসাব দাখিল করতে যে পরিমাণ খরচ ছোট ব্যবসাকে বহন করতে হয়, তাতে অনেক বিক্রেতাই কোনও ছাড় দিতে পারেন না। চাহিদা বাড়ার ক্ষেত্রে এটা অন্তরায়, এবং বহু মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতা জিএসটি ২.০’র পরেও তাই দাম কমেনি বলেই মনে করছেন। এই ক্রেতারা যে ধরনের ছোট ব্যবসার থেকে প্রধানত জিনিস কিনে থাকেন, সেগুলির একটি বড় অংশ সরাসরি জিএসটি-র রিটার্ন দাখিল করে না, কিন্তু পাইকারি বিক্রেতা জিএসটি দিলে তার প্রভাব এদের উপরেও পড়ে।
অন্য দিকে, এক ধরনের বড়-মাঝারি ব্যবসা কিন্তু ক্রমান্বয়ে জিএসটি ফাঁকি দিয়ে চলেছে, কারণ তারা রসিদ দেয় না। রসিদ না দিলে বিক্রি নেই দেখানো যায়। ক্রেতাকেও কম দাম দিতে হয় জিএসটি-র অংশ বাদ দিয়ে। সরকারি আধিকারিকরা এ বিষয়ে যা নজরদারি করতে পারেন, তা যথেষ্ট নয়। স্বাভাবিক ভাবেই, এর সঙ্গে দুর্নীতিও রয়েছে। ফলে জিএসটি কমে গেলেও এই ব্যবসাগুলোর ক্ষেত্রে চাহিদা লক্ষণীয় রকম বাড়বে না বলেই মনে হয়।
জিএসটি আরোপিত হওয়ায় আশা ছিল পূর্বসূরি যুক্তমূল্য করের (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স বা ভ্যাট) কারণে দামের উপর পরতে-পরতে যে কর ভার চাপত, তা লাঘব হবে। কিন্তু খরচসাপেক্ষ শর্তাবলির জন্যই হোক বা উপাদানের উপরে জিএসটি-র উচ্চ হারের কারণে, পণ্যের মূল দাম কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কমেনি। অথচ মানুষের চাহিদার সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের প্রধান সম্পর্ক দামের মধ্যে দিয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, অপ্রত্যক্ষ কর বাড়া-কমা তাতে সামান্যই প্রভাব ফেলে।
ভারতে যে পণ্যগুলোর উপরে জিএসটি-র হার শূন্য হয়েছে সেগুলি মূলত খাদ্যদ্রব্য— রুটি, পরোটা, পনির, ইউএইচটি দুধ, খাকড়া এবং পিৎজ়া রুটি এখন করমুক্ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপরে জিএসটি কমলেও তার চাহিদা আর কতটা বাড়তে পারে? পেনসিল, নোটবুক, ইরেজ়ার বা মানচিত্র কিনতেও আর কর দিতে হবে না বলে মোট দাম কম হবে এবং স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে এর চাহিদা বাড়তে পারে। শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, ট্যালকম পাউডার এবং চুলের তেল— যাতে আগে ১৮% কর ছিল— এখন তা ৫% হওয়াতে চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে যত শৌখিন পণ্যের কথা ভাবা যায়, তার জন্যে যথাযথ ক্রয়ক্ষমতা থাকাও তো জরুরি। যে দেশে এক টাকায় শ্যাম্পুর স্যাশে কেনেন বৃহৎ অংশের ক্রেতা, সেখানে কর কমলে তাঁরা বিরাট শিশি কিনবেন কি? উৎপাদকদের আশা সেটাই। এবং অনেক মাঝারি ক্রেতা এ বার থেকে আগের তুলনায় বেশি কিনবেন তাও সম্ভব, কিন্তু একটা কিছুর দাম কমলে মানুষ সম্পূর্ণ অন্য খাতে উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যয় করেন সেটাও রীতিমতো একটা সম্ভাবনা। খাকড়ার দাম কমেছে বলে আরও দুটো বাড়তি খাকড়া না খেয়ে মানুষ বেঁচে যাওয়া অর্থ সঞ্চয়ও করতে পারেন। ফলে তাৎক্ষণিক বিচারে ভোগ্যপণ্যের পিছনে খরচ নাও বাড়তে পারে।
ভারতের মূল শক্তি হল তার জনসংখ্যা। কোনও ভাবে যদি এক শ্রেণির মানুষ এই ভোগবাদের মধ্যে অংশগ্রহণ না-ও করে, অন্য কোনও অঞ্চলের মানুষ সম্পূর্ণ বিপরীত আর্থিক অবস্থান এবং ধারণার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে। মোটের উপর, সামগ্রিক চাহিদা যে বাড়বে না, তা মনে করার মতো যথেষ্ট কারণ নেই। যেমন, স্বাস্থ্যব্যবসার চাপেই যে শেষ অবধি স্বাস্থ্যবিমার উপরে জিএসটি প্রত্যাহার করতে হল, তাতে মানুষের কিছুটা উপকার হবে— যদিও এটা এক অর্থে সবাইকে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে ঠেলে দেওয়াও বটে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ খুঁজলে দেখা যাবে, বিদেশের বাজারে চিনের রফতানি কমে যাওয়াতে গত দশ বছরে দেশের বাজারের উপরে তাদেরও নির্ভরশীলতা বেড়েছে অনেক গুণ। দেশের অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে তারা কিন্তু অপ্রত্যক্ষ করের উপরে ভরসা করে না। বরং, কী করলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ে, চাকরি সৃষ্টি হয়, চাকরি প্রত্যাশীদের দক্ষতা বাড়ে, তার আয়োজন চলছে সর্ব ক্ষণ। চিনের বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞানের গবেষণাগার, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো ইউরোপ-আমেরিকার সমকক্ষ, অনেক ক্ষেত্রে উন্নততর।
ভারতের এখন প্রায় সব অপ্রত্যক্ষ কর উঠে গিয়ে রয়েছে শুধু জিএসটি। ঘোষিত হারের পরিবর্তনে রাজ্যগুলোর কী হবে, তার সঙ্গেও মোট চাহিদার একটা সম্পর্ক নেই কি? রাজ্য সরকার যদি যথেষ্ট রাজস্বের অভাবে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়, এবং স্কুল-কলেজে প্রদেয় সাহায্য কমিয়ে দেয়, কিংবা রাস্তাঘাট বেহাল হয়, তাতে সামগ্রিক চাহিদা কমবে না কি? সুতরাং, জিএসটি-র হার কমানো তখনই সুখবর হতে পারে, যখন রাজ্যগুলোর যে রাজস্ব ক্ষতি ঘটছে, কেন্দ্র তা পূরণ করে দেবে আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে— অন্তত যত দিন না দাম কমার প্রভাবে চাহিদা বেড়ে পুরনো রাজস্ব আবার পাওয়া যাচ্ছে। শুধু জিএসটি-র উপরে এত বড় দায় চাপিয়ে দেওয়া চলে না।
অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)