Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Fascism

বাছাই প্রতিবাদের বিপদ

দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি শুধু তৃণমূল স্তরের বিষয় নয়, বার্তা উপর থেকেই আসে।

সুমন কল্যাণ মৌলিক
সুমন কল্যাণ মৌলিক
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২১ ০৭:৩১
Share: Save:

কোনও অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, রাজপথে আওয়াজ উঠছে তাকে রুখে দেওয়ার— সংসদীয় রাজনীতিতে এ দৃশ্য সুলভ নয়। সেই বিরল ঘটনার সাক্ষী পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। বিরল হলেও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। বিজেপি-আরএসএস’এর অনুপ্রেরণায় যে ভাবে বিরুদ্ধ মত পদদলিত হচ্ছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আধিপত্য স্থাপিত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর প্রশ্নচিহ্ন উঠে যাচ্ছে, একটি ধর্ম সম্প্রদায়কে দেশের পক্ষে বিপজ্জনক বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, তাতে ফ্যাসিবাদী লক্ষণযুক্ত এই দলকে পরাভূত করার দাবি ন্যায়সঙ্গত। আখ্যানে গোলমাল নেই। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা যদি নির্দিষ্ট দলকে চাঁদমারি করার মধ্যেই সীমায়িত থাকে, তা হলে যে রাজনীতি-সমাজনীতি-সংস্কৃতি ফ্যাসিবাদের ভিত্তি প্রশস্ত করে, তা আলোচনার বাইরে চলে যায়। সেই দুর্বলতার সুযোগে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি সমাজ-জীবনে গেড়ে বসে, নির্বাচনী ফলাফলে ন্যায্যতা পায়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ২ কোটি ৩০ লক্ষ।

কথাগুলো আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, যখন কোনও এক পঞ্চায়েত এলাকায় বিজয়ী দলের পক্ষ থেকে লিফলেট বিলি করা হয়— তালিকাভুক্ত লোকেরা অন্য দল করেন বলে তাঁদের জিনিস বিক্রি করা যাবে না, ধোপা-নাপিত বন্ধ। নির্বাচনের মাসাধিক কাল পরেও যদি কয়েকশো রাজ্যবাসী ঘরছাড়া থাকেন, যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এলাকায় প্রবেশ করতে না পারেন, তবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভোটবিজয় উদ্‌যাপন অর্থহীন। আরামবাগ, গোঘাট, গড়বেতার রক্তাক্ত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, তখনও গােয়র জোরে বিরুদ্ধ মত শাসন করা হত। বিরোধী থাকলে গণতন্ত্রপ্রেম আর ক্ষমতায় বসলে নিজেই শেষ কথা— এই রাজনীতিই ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্রের সীমারেখাটা ভেঙে দেয়।

দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি শুধু তৃণমূল স্তরের বিষয় নয়, বার্তা উপর থেকেই আসে। ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভ বা সমালোচনাকে আইনের দ্বারা রুদ্ধ করা এ দেশে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই মামলার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি রাষ্ট্রদ্রোহিতার সংজ্ঞা ও সীমা নতুন করে নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। তার মধ্যে একটির পটভূমি, অন্ধ্রপ্রদেশে শাসক দলের এক সাংসদ মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডির সরকারের সমালোচনা করলে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছে তাঁর দলেরই সরকার। অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানায় চোদ্দোটি গণসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা, অথবা ছত্তীসগঢ়ে পূর্বতন বিজেপির মতো কংগ্রেস সরকারেরও আদিবাসীদের উপর ‘এনকাউন্টার’-রাজ স্থাপন করা এমনই স্বৈরাচারী রাজনীতি, যা ফ্যাসিবাদকে আমন্ত্রণ পাঠায়। বহু অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, সমালোচনা না শোনার মানসিকতা উত্তরপ্রদেশের যোগী-রাজত্বের মতো সব রাজ্যেই কম-বেশি এক রকম।

ফ্যাসিবাদকে রোখার সবচেয়ে বড় দাওয়াই গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বহু দায়, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ও পুর-প্রশাসনের মডেল সেই লক্ষ্যেই চালু হয়েছিল। কিন্তু দলীয় আধিপত্য ও দুর্নীতির ফলে প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি জনগণের মধ্যেই নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হয়েছে। তাই ইয়াসের পর যখন জানা যায় যে, আমপানের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর রাজ্য সরকার ত্রাণ বিলির দায়িত্ব আমলাতন্ত্রের হাতে তুলে দিচ্ছে, তখন খুশি হই, কিন্তু ভেবে দেখি না যে, আমলাদের উপর অতি নির্ভরতা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করে দেয়। স্কুল, কলেজ, গ্রন্থাগার, পর্ষদ— সব পরিচালন সমিতিতেই আজ ‘মনোনীত’দের ভিড়। আশির দশকে ছাত্রজীবনে দেখেছি, কলেজগুলিতে অন্তত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হত। বিরোধীশূন্য সংসদ তৈরির খেলা শুরু নব্বইয়ে, আর আজ কিছু ‘লাইটহাউস’ বাদে নির্বাচন বিষয়টাই উঠে গিয়েছে। অন্য দিকে, নীতিগত ভাবে কেন্দ্রের শ্রম কোডের বিরোধিতা করব, কিন্তু শ্রম দিবস নষ্ট হওয়ার অজুহাতে শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নেব— এই দ্বিমুখী অবস্থানও গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রমাণ করে না। আজ যখন বিজেপি যে কোনও প্রতিবাদীকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে ইউএপিএ-তে মামলা দায়ের করে, তখন যথার্থ ভাবেই ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শুনতে পাই, কিন্তু অ-বিজেপি দলগুলিও (দক্ষিণ ও বাম উভয়েই) যে ভাবে এর যথেচ্ছাচার ঘটিয়েছে, তা যদি বিস্মৃত হই, তা হলে ফ্যাসিবাদ রোখার লড়াইয়ে গোড়ায় গলদ থেকে যাবে।

রাজনৈতিক দল নয়, ফ্যাসিবাদের স্বরূপ উন্মোচন করে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে নাগরিক সমাজ। এ বারের ভোট তার প্রমাণ। নাগরিক উদ্যোগের সামনেও আজ বড় পরীক্ষা। যে কোনও শাসকের অন্যায্য সিদ্ধান্ত, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল করে দেওয়াই ফ্যাসিবাদের পথ প্রশস্ত করে— এই সারসত্য বুঝে নাগরিক উদ্যোগকে প্রতিবাদের পথে স্থির থাকতে হবে। বাছাই করা প্রতিবাদ অংশগ্রহণকারীদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রচারকেও বিপথগামী করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fascism West Bengal Election2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE