উন্নয়নের পমেটম-মাখা স্মার্ট সিটির আওতায় কিছু দিন আগেও সজ্জিত, অধুনা মনমরা ডাল লেকের পিছনে রয়েছে আর একটা ডাল লেক! পর্যটকরা এখানে সুসময়েও আসতেন না, কারণ এটি ভুবনপ্রখ্যাত লেকটির পশ্চাদ্বাহী রুগ্ণ সরু নালা বই নয়। এখানে রাতে বিশ্রাম নেয় শিকারাগুলি, বসবাস করেন রোগাভোগা চালকরা। পোশাকি নাম বারু মহল্লা। ব্যস্ত রাজপথ থেকে ঢুকে যাওয়া গলি ধরে কয়েকশো মিটার এগোতেই চিনার, কাঠবাদাম-সহ হরেক গাছের জঙ্গল শুরু। আরও এগোতে তা এতটাই ঘন যে এখানে দুপুরেও ঝিঁঝি ডাকে। লেক থেকে বয়ে আসা শেওলা-সবুজ জলের ধারে ঝিমোয় বাতিল শিকারা। গত আশ্বিনে এই ভূস্বর্গে মেঘকে গাভীর মতো চরতে দেখেছি।
আজ যেখানে রক্তের ছাপ আর বারুদের গন্ধ, মাত্র কয়েক মাস আগেই সেখানে বাতাস ছিল উজ্জ্বলতর। দশ বছর কায়মনোবাক্যে অপেক্ষার পর বিধানসভা ভোট আসার আকাঙ্ক্ষা পূরণ ছিল সেই ভোট-উৎসবে। কারণ, কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়ার উষ্মা কিছুটা হলেও তো ব্যালট বাক্সে ঢেলে দেওয়া যাবে। বহু দিন পর সুযোগ এসেছিল নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পরখ করার। আর আজ এই রুগ্ণ জলধারার, বাতিল শিকারার ধারে আজমল ডর-এর কাঠের লগবগে বাড়ির উঠোনে ভাগাভাগি করে ছড়িয়ে আছে আতঙ্ক আর পেট চালানোর অনিশ্চয়তা। এলাকার প্রাচীন বাসিন্দা তনভিরের কথা মনে পড়ছে, আগে যাঁর একটি হাউসবোটের আংশিক মালিকানা ছিল। কোভিডের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেচে দিয়েছিলেন। ছেলেরা হাল ধরেছিলেন সংসারের, যে যে ভাবে পারেন। পর্যটন সংক্রান্ত ছোটখাটো জোগাড়ে কাজ আপাতত তাঁর নেমে গিয়েছে শূন্যে। জমা পুঁজি সে তো কবেই শেষ।
‘গুলির বদলে গোলা’ চলেছে। ভারতীয় সেনা, অমিতবিক্রম এবং সাবধানি প্রত্যাঘাতে পাকিস্তানকে সবক শিখিয়েছেন, দশকের পর দশক ধরে ভারতের বুকে হাজার ক্ষত তৈরি করার কিছুটা বিধান মিলেছে ন’টি জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে। কাশ্মীর নিয়ে বাস্তবতার নতুন মাপকাঠি (নিউ নর্মাল) তৈরি করা হয়েছে, এবং আমেরিকা তাতে বাদ সাধায় কূটনৈতিক চাপান-উতোরও বড় কম চলছে না।
কিন্তু এই সব বড় বড় ব্যাপারের তলায় আজমল ডরদের কাঠের লগবগে বাড়িগুলো যে চাপা পড়ে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য, সেই বাস্তবতার কী হবে? কয়েক মাস আগে কাশ্মীরের ভোট আবর্তিত হয়েছিল ৩৭০ সংখ্যাটিকে ঘিরে। জম্মু ও কাশ্মীরের গরিবগুরবো মানুষের বক্তব্য ছিল, কেন্দ্র তাঁদের পরিচয়চিহ্ন কেড়ে নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু উপত্যকায় ভোট করিয়ে সেই চিহ্ন ফেরত দেওয়া হয়েছে। বিজেপি প্রচারেও সেই কথাই বলত। তবে একটু ঘনিষ্ঠতার পরই অভিযোগ শোনা যেত, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নামে রাস্তার বাতির টেন্ডারও বাইরের সংস্থা থেকে। সিমেন্ট বালি আসছে অন্য রাজ্য (বিজেপি-শাসিত) থেকে। নতুন রাস্তা হচ্ছে স্মার্ট সিটির অধীনে, তার পাথর আসছে বাইরে থেকে। হকদার কাশ্মীরিরা সেই তিমিরেই, যেন সেখানকার পাহাড়ে পাথর নেই! অভিযোগ গুরুতর, কাশ্মীরের অর্থনীতিই গুজরাতের মতো রাজ্যের হাতে চলে যাচ্ছে। আমলাদের দিয়ে ডাল লেক পর্যটনের গুড় খাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। যাঁরা পর্যটনের প্রাণ সেই সব শিকারা-চালকরা কোনও মতে মাথা গুঁজে রয়েছেন। স্থানীয় ছেলেপিলেদের জন্য কোনও স্কুল, হাসপাতালের ব্যবস্থা নেই।
মাথা গুঁজে হলেও তবু তো টিকে ছিলেন তাঁরা। গত বছর লোকসভা নির্বাচনের সময়ও আশায় বুক বেঁধে মানুষ নেমেছিলেন ভোট দিতে। তার পর বিধানসভার ভোট। এটাও ঘটনা, শ্মশানের শান্তি বিরাজমান থাক (পহেলগাম কাণ্ডের পর সেটাই মনে হচ্ছে) বা না থাক, পর্যটন ফিরেছিল— যা এখানকার রুটি-রুজির প্রধান উপায়। গত বছর অগস্টে জম্মু ও কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল মনোজ সিন্হা প্রকাশ করেছিলেন জম্মু ও কাশ্মীর চলচ্চিত্র নীতি। নিরাপত্তার কারণে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল কাশ্মীরের মনোহর নিসর্গ (১৯৮০-র পর থেকে সেখানকার সিনেমাহলে তালা ঝুলছে)। চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সেই জায়গাগুলিতে সহজে প্রবেশাধিকার দিতেই নয়া নীতি তৈরি করা হয়েছিল। আসলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের পর, কাশ্মীরে যে স্বাভাবিকতা ফিরেছে, তার অন্যতম সূচক হিসেবে গত কয়েক বছরে পর্যটন শিল্পকেই বার বার তুলে ধরতে মরিয়া ছিল মোদী সরকার, তার কিছু ফয়দা অবশ্যই মানুষের কাছে পৌঁছেছিল।
২০১৮ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছিল ২২৮টি। তা থেকে কমে ২০২৩ সালে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয় ৪৬টি। এই শান্তি জম্মু ও কাশ্মীরের অর্থনীতিকে নতুন দিশা দেখাচ্ছিল। জম্মু ও কাশ্মীরের জিডিপির অনেকটাই আসে পর্যটন শিল্প থেকে। ২০১৮ সাল থেকে এই খাতে প্রায় একটানা বৃদ্ধিই ঘটেছে। এখানকার পর্যটন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে ১.৬ কোটি পর্যটকের পা পড়েছিল। ২০২০-তে কোভিড শুরু হওয়ায় পর্যটক সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ৪১,০০০-এ। তার পর সংখ্যা ক্রমে বেড়েছে। ২০২৩-এ ২ কোটির বেশি, ২০২৪-এও ২ কোটি ৩০ লক্ষের বেশি পর্যটক এসেছিলেন বলে কিছু দিন আগেই বিধানসভায় জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। যার মধ্যে ৬৫,০০০ বিদেশি পর্যটকও ছিলেন। ২০২৫ সালের মরসুমও আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল। মাত্র ২৬ দিনে শ্রীনগরের টিউলিপ গার্ডেনে ৮.১৪ লক্ষ পর্যটক ভিড় জমিয়েছিলেন। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে রাজ্যের জিডিপির ৭.০৬ শতাংশ বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। এই বৃদ্ধির ভিত্তিতে আগামী ৪-৫ বছরে পর্যটন শিল্প থেকে জিডিপির ১৫% সংগ্রহ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল জম্মু ও কাশ্মীর সরকার।
এই সব পরিকল্পনাই এখন ডাল লেকের গভীর জলে। ভ্রমণ-সফর বাতিলের অনুরোধে জেরবার হয়ে যাচ্ছে ট্রাভেল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব কাশ্মীর। ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পর্যটন বাতিলের দাবি বাতাসে ঘুরছে। জনপ্রিয় ট্রেকিং রুট বৈসরন পাইনবনে থমথম করছে দীর্ঘশ্বাস। দেড় হাজারের বেশি হাউসবোট, হাজার তিনেক হোটেল, অগণিত ট্যাক্সি অপারেটর, ট্যুর গাইড, ঘোড়ার সহিস, হস্তশিল্প বিক্রেতা, শিকারা-চালক ক্রমশ আবার ফিরে যাবেন কর্মহীনতা এবং কালক্রমে নৈরাজ্যের দিকে। সন্ত্রাসবাদ এবং দারিদ্রের মধ্যে যে অলাতচক্রটি রয়েছে, তাকে কোনও সুদর্শনচক্র (এস ৪০০) রক্ষা করতে পারবে কি না, সন্দেহ থেকে যায়।
পর্যটকদের মধ্যে ধর্মপরিচয় নিশানা করে বাছাই করা হত্যালীলা উপত্যকার দীর্ঘ নাশকতার ইতিহাসেও এক নতুন ও বিরল বর্বরতা। গত কয়েক বছর ধরে অতি যত্নে যে শান্তি ও স্বাভাবিকত্বের ভাষ্য তৈরি করেছিল মোদী সরকার, তা রক্তাক্ত আজ। এই নজিরবিহীন বীভৎসতার স্মৃতি মুছে বুক বাঁধতে জম্মু-কাশ্মীরের অর্থনীতির কত সময় লাগবে জানা নেই অন্তত এখন।
তবুও সেনার এই জলপাইরঙা শাসনের মধ্যেই দু’পাশের আপেল, উইলো গাছগুলোয় পাতা ঝরা শুরু হবে যথানিয়মে। ইস্কুল যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়াবে শিশুরা। দাওয়ায় একটি টিউবওয়েল বসানোর স্বপ্ন নিয়ে আবার হয়তো ভোটবাবুদের দিকে তাকাবেন জম্মু-কাশ্মীরবাসী। ফিরন, পশমিনা, আখরোট কাঠের গহনা-বাক্স, মনোহর সুগন্ধের তেল, শুকনো ফলের দোকানি, সুদিন কাছে আসার স্বপ্ন দেখেই যাবেন। ঝিলমের পাশের বেঞ্চে বেয়নেটকে তোয়াক্কা না করে ভালবাসার স্বপ্ন দেখবে নতুন প্রজন্মের ডেনিম যুবক-যুবতী। একমাত্র স্বপ্নই তো রয়েছে এই হতভাগ্য উপত্যকার অবশিষ্ট সম্পদ, যা বুলেটে বিদীর্ণ হয় না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)