Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Jadavpur University Student Death

প্রবৃত্তি বিষয়ে কিছু ভাবনা

ভারতীয় জীবনবোধে প্রবৃত্তি শব্দটির গভীর তাৎপর্য। ন্যায়দর্শনে প্রবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে ‘কায়মনোবাক্যে বৈধাবৈধ কার্যে প্রযত্নবিশেষ’।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৪৯
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা ছেলেবেলায় দিদিমা-ঠাকুমার মুখে শোনা একটি শব্দের দিকে নতুন করে তাকাতে প্ররোচিত করল। তাঁরা অনেক সময় বলতেন ‘তোর এমন নীচ পবিত্তি!’ অগ্রজেরা, তাঁদের মতে ভাল নয় এমন কোনও কাজে যোগদান করতে না চাইলে বলতেন, ‘ও-কাজে প্রবৃত্তি হয় না।’ প্রবৃত্তি শব্দটি আজকাল বাঙালির মুখে আর শুনি না। এক কিশোরকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে যারা নিগ্রহ করেছে তারা হীন প্রবৃত্তির বশীভূত। অপরকে নিখরচায় ব্যক্তিগত চাকরের মতো খাটানো, তার শরীরকে মর্যাদাহীন দৃশ্যবস্তুতে পরিণত করা, শারীরিক নিগ্রহ, এ সবই আধিপত্যকামী প্রবৃত্তি— প্রাণহন্তারক বলে গুরুদণ্ডের বিষয়। রঘুবংশ-এ হীন প্রবৃত্তিকে বলা হয়েছে কলুষ।

ভারতীয় জীবনবোধে প্রবৃত্তি শব্দটির গভীর তাৎপর্য। ন্যায়দর্শনে প্রবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে ‘কায়মনোবাক্যে বৈধাবৈধ কার্যে প্রযত্নবিশেষ’। প্রবৃত্তি বলতে তো কেবল অবৈধ কাজের বাসনাকেই বোঝায় না, বৈধ ভাবে জীবনকে উপভোগের বাসনা ও উদ্যমকেও বোঝায়। জীবনকে বৈধ ভাবে উপভোগ করার যে উদ্যম তাকে অস্বীকার করে সবাইকে এক ছাঁচে ‘যোগী’ বানিয়ে তুলতে চাইলে অবদমিত ভণ্ড যোগীতে দেশ ভরে যাবে। প্রবৃত্তিমার্গের সমর্থকরা ‘উৎকৃষ্ট ভোগ’ ও ‘নিকৃষ্ট ভোগ’-এর পার্থক্য নির্দেশ করেছিলেন। ‘উৎকৃষ্ট ভোগ’ মানুষকে ভোগের অমরাবতীতে স্থিতি দেয়, ‘নিকৃষ্ট ভোগ’ তাকে নিয়ে যায় ভোগের নরকে।

প্রশ্ন হল, যে প্রবৃত্তি মানুষকে কখনও অমরাবতীর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় আবার কখনও অপরাধের দিকে, তাকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? দু’ভাবে। এক দল মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রবৃত্তিকে উপভোগ করতে সমর্থ। যাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই তাঁদের প্রবৃত্তি প্রশমনকালে যাতে অপরের স্বাধীনতা হরণ না করে, সে জন্য প্রবৃত্তিমার্গে নানা বিধিব্যবস্থা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ভারতীয় প্রবৃত্তিমার্গের বিধিগ্রন্থ, সেখানে বলা আছে, “সুরাধ্যক্ষ দুর্গে, জনপদে, সেনানিবাসে একচেটিয়া ভাবে বা ভিন্ন ভিন্ন সুরাবীজের ব্যবহার ও ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে কোথাও সুরা ক্রয়-বিক্রয় হলে উৎপাদনকারী, ক্রেতা ও বিক্রেতা সবার ৬০০ পণ দণ্ড ধার্য হবে। সুরাধ্যক্ষকে কঠোর ভাবে তিনটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। সুরাপানের পরে মত্ত লোকেরা যেন ঘরের বাইরে বা জনাকীর্ণ স্থানে যেতে না পারে, তাতে ভদ্রজনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে ও বিনা প্রয়োজনে তীক্ষ্ণস্বভাবের লোকেরা অন্যকে শস্ত্রাঘাত করে বসতে পারে।” লক্ষণীয়, মদ্যপান নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু মত্ততা যাতে অপরের স্বাধীনতা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না করে তার জন্য স্পষ্ট কঠোর বিধি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীদের খাওয়া-পরা ও আচার-আচরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে বলে তাঁরা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিকে ঘেরাও করেন। প্রবৃত্তিমার্গের উদ্দেশ্য তাঁদের স্বাধীনতা হরণ নয়, কিন্তু কোথায় কী কতটুকু বিধেয় তা নিয়ে অবশ্যই বিধিবদ্ধ নিয়ম থাকবে। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক পড়ুয়াটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা হস্টেলের মতো গণপরিসরে আছেন, অন্যদের সঙ্গে আছেন। তাঁর যেমন নাগরিক ও পড়ুয়া হিসাবে কতকগুলি অধিকার আছে, অন্যদেরও আছে। তিনি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক হিসাবে মদ্যপান করতে পারেন, সম্মত যৌন সম্পর্কে যেতে পারেন, নিজস্ব যৌন পরিচয় জ্ঞাপন করতে পারেন, কিন্তু কী কেন কোথায় করছেন সে সম্বন্ধে স্পষ্ট বিধিসম্মত নির্দেশ তাঁকে মেনে চলতে হবে।

এর অর্থ এই নয়, বৈধ ভাবে যাঁরা খাওয়া-পরা-সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘অন্য রকম’ তাঁরাই কেবল উদার ও মানবিক। ধুতি-চাদর পরা বিদ্যাসাগর সে কালের পাশ্চাত্যপন্থী উদার হিন্দু কলেজের তুলনায় অতিরক্ষণশীল সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। তিনি যে ভাবে দয়াশীলতার সামাজিকতা স্বীকার করে বিধবা মেয়েদের শরীর-মনের বঞ্চনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, হিন্দু কলেজের গোমাংসসেবী মদ্যপায়ী ছাত্ররা সে ভাবে দাঁড়াতে পারেননি। হিন্দু কলেজের ইংরেজির অন্যতম সেরা ছাত্র মধুসূদন বীরাঙ্গনা কাব্য বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেখানে গুরুপত্নীর সঙ্গে ছাত্রের প্রণয়সম্পর্ক বিষয়ক বিতর্কিত পত্র ছিল। মধুসূদন তাঁর দুর্দশার সময় বিদ্যাসাগরকে পাশে পেয়েছিলেন। কাজেই শুধু খাওয়া-পরা ও অন্যান্য শারীরিক চিহ্ন দিয়ে প্রগতিশীল মানবিকতার বিচার চলে না। যাদবপুরের পড়ুয়াদের মধ্যে এমন অনেকেই হয়তো আছেন যাঁরা পানাসক্ত বা ধূমপায়ী নন, শহুরে স্মার্টনেস দেখাতে তৎপর নন অথচ গভীর সংবেদী ও মানবিক, ক্ষমতার আধিপত্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দাবি তুলতে তৎপর।

শিক্ষকদের ভূমিকা বিষয়ে দু’-একটি কথা। এই যে ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবি তুলে ক্ষমতা ও আধিপত্যকামী মানসিকতার বিরুদ্ধে কথা বলেছে যাদবপুরের ছাত্রসমাজ, তার পিছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের শিক্ষকদের ভূমিকা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাদবপুরের কলা বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যসূচি খেয়াল করলে তা বোঝা যাবে। এই পাঠ্যসূচি প্রশ্ন করতে শেখায়। গত শতকের শেষ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যাঁরা সে সময় পড়াতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেরই পড়াশোনার সঙ্গে জীবনবোধ ও জীবনযাত্রার যোগ ছিল গভীর। ফলে কলা বিভাগে পড়াশোনা নিতান্ত পড়াশোনা নয়, জীবনের সঙ্গে তা অঙ্গাঙ্গি, এই বোধ পড়ুয়াদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পেরেছিল। শিক্ষকদের চলন-বলন, ক্লাসঘরের বাইরে তাঁদের সহাস্য সহজ উপস্থিতির সুযোগে বোঝা গিয়েছিল, যাদবপুরে পড়ুয়া-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে শ্রেণিগত দূরত্ব ও দূরত্বজনিত আধিপত্য তাঁরা বজায় রাখতে চান না।

এ সব দেখাই ছিল এক রকম শিক্ষা। এঁরা সবাই এঁদের আচরণে পড়ুয়াদের প্রশ্নশীল করে তুলতেন। শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া, বাইরে পড়ুয়াদের সাহস জোগানো, ব্যক্তিগত ভাবে পড়ুয়াদের সুবিধে-অসুবিধের কথা জানা— সব মিলিয়ে যাদবপুরের সংবেদী মুখটি ছিল বলেই তার বাইরে নানা বয়সোচিত অবিবেচনা আধিপত্যকামী অসামঞ্জস্য তৈরির সুযোগ পেত না। যে পড়ুয়ারা ক্লাসে না ঢুকে লবিতে দিনের পর দিন বসে থাকতেন তাঁদের উপর শিক্ষকেরা নিয়মের জোর খাটাতেন না। তবে ধূমপায়ী ক্লাস-কাটা পড়ুয়ার উত্তর ভাল হলে শিক্ষক খুশি হতেন, কেন তাঁর ক্লাস করেননি তা নিয়ে খুব মাথা ঘামাতেন না। কারণ আইনের শব্দের (লেটার অব দ্য ল) থেকে আইনের অর্থ (মিনিং অব দ্য ল) উদার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ।

আধিপত্যকামী ক্ষমতার বিরোধিতা করার যে শিক্ষা যাদবপুরে পড়ুয়ারা পান, তারই সূত্রে সাম্প্রতিক অতীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা নানা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। সেই আন্দোলনের যে দৃশ্য পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখেছেন, তা নানা কারণে নজরকাড়া। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখ ও শরীরের ভাষার যে চরিত্র, তা থেকে সম্পূর্ণ অন্য রকম ভাষায় যাদবপুর চার দিক মুখরিত করেছে। সেই মুখরতার শ্রাব্য ও দৃশ্যভাষা অনেক সময় সাধারণ সামাজিকদের হতবাক করেছে, এমনকি যে সব বিষয় নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মুখর সেগুলি নিয়ে যে আদৌ মুখর হওয়ার প্রয়োজন আছে, তাই অনেক সময় পশ্চিমবঙ্গবাসী ভেবে উঠতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের প্রয়োজন ও দাবির বাইরেও যে বৃহত্তর সামাজিকদের জীবনে অন্যান্য প্রয়োজন ও দাবি উপেক্ষিত হয়েছে, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাবে অনেক সময়েই যাদবপুরের আলোকিত আন্দোলনকারীরা তা বুঝতে পারেননি। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সামাজিক দুর্দিনে তাঁরা মানুষের পাশে থাকার আন্দোলন করলেও মিডিয়া-প্রচার পেয়েছে নজরকাড়া যাদবপুর। যাদবপুরের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের সে অর্থে যোগ তৈরি হয়নি। মোটের উপর ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনও রকম পদক্ষেপকেই যাদবপুরের সচেতন পড়ুয়াদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা বলে মনে হয়েছে, ব্যক্তিস্বাধীনতা তাঁদের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই খাওয়া-পরা, সমবেত উল্লাস উদ্‌যাপন, মানবসম্পর্ক নিয়ে পরীক্ষা, লিঙ্গ পরিচয়-নিরপেক্ষ ভাবে যৌনমুক্তির কথা বলার মধ্যেই সম্প্রসারিত ও সীমাবদ্ধ থেকেছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার চিহ্নঘোষণা করতে গিয়ে অনেক সময় নিরাপত্তাদায়ী পদক্ষেপের বিরোধিতাও তাঁরা করেছেন। যে ব্র্যান্ড যাদবপুর নজর কাড়ে তার ছুতোয় প্রগতিশীলতার কতকগুলি চিহ্ন, বাইরের খোসাই কি বহু ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠেছে?

বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত ফরাসি বিপ্লবের তিন ভাবনাস্তম্ভকে ঠাট্টা করে লিখেছিলেন লিবার্টি-ইকোয়ালিটি-মটরশুঁটি। দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতা ক্রমে আধিপত্যকামী হয়ে ওঠে, অপরের স্বাধীন মর্যাদাকে অস্বীকার করে, ফলে ‘ফ্রেটারনিটি’ বা ভ্রাতৃত্ববোধ পড়ুয়াদের মধ্যে থাকে না। যাদবপুরেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে মর্মান্তিক ভাবে তা-ই হয়েছে। এও যেমন সত্য, তেমনই এই ছুতোয় যে উদারতা ও প্রশ্নশীলতার জন্য যাদবপুর গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রশ্নশীল উদারতাকে সমূলে উচ্ছেদের উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠেছে। ভয় দু’দিকেই। দুই ভয়ের মধ্যে অবশ্যই বড় পার্থক্য আছে। স্বেচ্ছাচারকে বিধি-দায়িত্ব দিয়ে আটকানো সম্ভব, আটকাতে চাইলে শিষ্ট সামাজিকদের গাঢ় সমর্থন পাওয়া যাবে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারের বিপদের কথা বলে উদার ভাবনার পরিসর ধ্বংস করতে চাওয়া ছদ্মশুদ্ধশীলরা যখন ফ্যাসিস্ট রক্ষণপন্থার অনুগামী হয়ে দাঁতনখ বার করে বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করবেন, তখন!

যাদবপুর এই সময়ের এই দ্বৈত সঙ্কটের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE