নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে এক দিন আচমকাই সংসদ ভবনে উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। তার পরে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, কেন কংগ্রেস তথা বিরোধীদের হইহট্টগোলের মধ্যেই রাজ্যসভায় সরকারি বিল পাশ করানো হচ্ছে না?
মোদী সরকারের একেবারে গোড়ার দিকের ঘটনা। সে সময় হামিদ আনসারি উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। আনসারি ইউপিএ সরকারের আমলে উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। দু’দফা মিলিয়ে মোট দশ বছর দেশের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। এর মধ্যে শেষ তিন বছর মোদী সরকারের জমানা। সে সময় লোকসভায় এনডিএ-র বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় বিরোধী সাংসদদেরই সংখ্যা বেশি ছিল। ফলে মোদী সরকারের অনেক বিল লোকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় এসে আটকে যেত।
হামিদ আনসারি তাঁর স্মৃতিকথা বাই মেনি আ হ্যাপি অ্যাকসিডেন্ট-এ লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদী সরকারের ধারণা ছিল, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার ফলে রাজ্যসভার যাবতীয় বাধা দুরমুশ করে ফেলারও নৈতিক অধিকার মিলে গিয়েছে। রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের দফতরে আচমকা ঢুকে পড়ে প্রধানমন্ত্রী সেটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আনসারিকে মোদী বলেছিলেন, ‘আপনার থেকে বৃহত্তর দায়িত্ব প্রত্যাশিত। কিন্তু আপনি আমাকে সাহায্য করছেন না। কেন হইহট্টগোলের মধ্যে বিল পাশ করানো হচ্ছে না?’ আনসারি বলেছিলেন, ইউপিএ সরকারের আমলে যখন বিজেপি বিরোধী আসনে, সে সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, হইহট্টগোলের মধ্যে বিল পাশ করানো হবে না।
কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকরা প্রশ্নহীন আনুগত্য চেয়ে থাকেন। সাংবিধানিক পদেরও সেখানে রেয়াত করা হয় না। বিনা বাক্যে নির্দেশ পালনই শাসকের প্রধান দাবি। নরেন্দ্র মোদীও হামিদ আনসারির থেকে তা-ই আশা করেছিলেন। তার অন্যথা হওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই নরেন্দ্র মোদীর পছন্দ হয়নি। ২০১৭-য় যখন আনসারি অবসর নিচ্ছেন, সে সময় রাজ্যসভায় বিদায় সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কটাক্ষ করেছিলেন, দীর্ঘ দিন পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রে কূটনীতিক হিসাবে কাজ করার ফলে, সংখ্যালঘু কমিশনের পদে থাকার ফলে হামিদ আনসারির চিন্তাভাবনাও সে রকম তৈরি হয়েছে। তাই তিনি হয়তো উপরাষ্ট্রপতির পদে সাংবিধানিক ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে ছটফট করছিলেন।
নরেন্দ্র মোদী সেখানেই থামেননি। ২০২৪-এ তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পর সংসদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যখন ২০১৪-য় তিনি প্রথম ক্ষমতায় আসেন, সে সময় রাজ্যসভায় এনডিএ-র সংখ্যা কম ছিল। রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের ঝোঁকও কিছুটা বিরোধীদের দিকে ছিল। তিনি সে দিন যা বলেননি, তা হল, ২০২৪-এ তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড় (ছবি) পুরোপুরি সরকারের দিকেই ঝুঁকে ছিলেন। আর এই অভিযোগ তুলে বিরোধীরা তাঁকে পদ থেকে অপসারণের প্রস্তাব এনেছিল।
ঠিক এক মাস আগে, গত ২১ জুলাই জগদীপ ধনখড় উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। নতুন উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। সব ঠিক থাকলে সঙ্ঘ পরিবার থেকে উঠে আসা বিজেপি নেতা সি পি রাধাকৃষ্ণন নতুন উপরাষ্ট্রপতি হচ্ছেন। গত এক মাসে ইস্তফার পর থেকে ধনখড় প্রকাশ্যে আসেননি। তবে তাঁর মেয়াদকাল বাকি সমস্ত সাংবিধানিক পদে বা সরকারের শীর্ষপদে আসীন ব্যক্তিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসাবে থেকে যাবে। তা হল, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকদের অনুগত হিসাবে কেউ কাজ করতেই পারেন, সাংবিধানিক পদে থেকে কেউ শাসকের মুখপাত্র হয়ে উঠতেই পারেন (এখন যেমন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বিজেপির মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ), বিনা প্রশ্নে যাবতীয় নির্দেশ পালন করতেই পারেন, কিন্তু তা বলে সম্মান মিলবে, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। প্রয়োজন ফুরোলেই কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক যে কাউকে আবর্জনার ঝুলিতে নিক্ষেপ করতে পারেন। জগদীপ ধনখড় নিজের সময়কাল দিয়ে তা প্রমাণ করে দিয়ে গিয়েছেন।
দীর্ঘ দিন অন্তরালে থাকার পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে জগদীপ ধনখড় নতুন করে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন। সে সময় রাজভবনের সঙ্গে নিত্যদিন নবান্নের সংঘাত বাধত। বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল আটকে রাখা, রাজ্য সরকারের আমলাদের রাজভবনে তলব করা, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া তাঁর রুটিনের মধ্যে পড়ত। এই পথে চললে যে পদোন্নতি নিশ্চিত, তা কলকাতার রাজভবন থেকে দিল্লির উপরাষ্ট্রপতি নিবাসে এসে প্রমাণ করেছিলেন ধনখড়। রাজ্যপাল হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই যে তিনি চলছেন, তা নিয়ে কোনও রাখঢাক ছিল না।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, রাজ্যপাল হিসাবে জগদীপ ধনখড় যা করছেন, তা সংবিধান ও আইন মেনেই করছেন। মোদী সরকারের নিযুক্ত রাজ্যপাল হিসাবে বিরোধী শাসিত রাজ্যে কী ভাবে কাজ করতে হবে, তা তামিলনাড়ু, কেরল, পঞ্জাবের মতো রাজ্যের রাজ্যপালদের সামনে কার্যত উদাহরণ তৈরি করে দিয়েছিলেন ধনখড়।
উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসাবেও জগদীপ ধনখড় অভূতপূর্ব সমস্ত নজির রেখে গিয়েছেন। সংসদে আরএসএসের বিরুদ্ধে মন্তব্য শুনে তিনি ফুঁসে উঠেছেন। রীতিমতো নির্দেশিকা জারি করে বলেছিলেন, আরএসএসের বিরুদ্ধে কথা বলাটা অসাংবিধানিক এবং নিয়মবিরুদ্ধ। দেশের সেবায় গভীর ভাবে নিয়োজিত আরএসএসের অবদান নিয়ে রাজ্যসভার গর্ব করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছিলেন। রাহুল গান্ধী মোদী সরকারের সমালোচনা করলেই জগদীপ ধনখড় সংসদের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে তাঁর নিন্দা করতেন। সনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের সংসদীয় দলের বৈঠকে বলেছিলেন, মোদী সরকারের মন্ত্রী ও সাংবিধানিক পদে আসীন ব্যক্তিরা নিয়মিত বিচারবিভাগকে নিশানা করছেন। জগদীপ ধনখড় সংসদের মধ্যে সনিয়ার সেই মন্তব্যের কড়া নিন্দা করেছিলেন। বিরোধীদের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের অভিযোগেই তাঁর বিরুদ্ধে ‘ইমপিচমেন্ট’-এর প্রস্তাব আনা হয়েছিল।
বিরোধীদের আক্রমণের পাশাপাশি বিচারবিভাগকে নিয়মিত নিশানা করাও উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে জগদীপ ধনখড় তাঁর কর্তব্য বলে মনে করতেন। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হয়ে প্রথম দিনই তিনি বিচারবিভাগকে নিশানা করেছিলেন। মোদী সরকারের জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে দুষেছিলেন। ১৯৭৩ সালের কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘খারাপ নজির’ বলে তকমা দিয়েছিলেন। ওই রায়েই শীর্ষ আদালত প্রথম সংবিধানের মূল কাঠামো বা ‘বেসিক স্ট্রাকচার’-এর কথা বলে। ধনখড়ের যুক্তি ছিল, সংবিধানের মূল কাঠামোর কথা বলে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের একাধিক আইন খারিজ করে দিয়েছে। এতে সংসদের অধিকার কমছে।
জগদীপ ধনখড়ের ইস্তফার পরে সরকারের একাংশের মত ছিল, তাঁর এই বিচারবিভাগকে নিশানা করা মোদী সরকারের পছন্দ ছিল না। কিন্তু আগেই কেন লাগাম টানা হয়নি? জগদীপ ধনখড় কি নিজের খুশি মতো বিচারবিভাগকে নিশানা করছিলেন? মনে হয় না। সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যপালদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিল পাশের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরে ধনখড় তেড়েফুঁড়ে শীর্ষ আদালতের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরবর্তী কালে মোদী সরকার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সেই সব প্রশ্নই সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঠিয়েছে। যা নিয়ে এখন প্রধান বিচারপতির এজলাসে শুনানি চলছে।
মেরুদণ্ড ঝুঁকিয়ে আনুগত্য দেখালে যে সম্মান মেলে না, তা-ও জগদীপ ধনখড় প্রমাণ করে গিয়েছেন। তাঁর ক্ষোভ ছিল, উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁকে দ্বিপাক্ষিক বিদেশ সফরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এলে ভারতের উপরাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর বৈঠক রাখার কথাই ভুলে গিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। এ নিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের কাছে ঘরোয়া আলোচনায় ক্ষোভ প্রকাশও করতেন ধনখড়। বিরোধীরা ভাবতেন, চরম আনুগত্য দেখিয়ে ধনখড় আসলে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য আগাম আবেদনপত্র জমা দিয়ে রাখছেন।
কর্তৃত্ববাদী শাসকের সামনে আনুগত্যের প্রশ্নে যে লক্ষ্মণরেখা পার করা চলে না, জগদীপ ধনখড়ের আচমকা বিদায় তারও প্রমাণ। যে মুহূর্তে তিনি সরকারের ইচ্ছে অমান্য করে রাজ্যসভায় বিরোধীদের বিচারপতি যশবন্ত বর্মাকে অপসারণের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গেই শাসক শিবির গর্জে উঠেছিল। যে অমিত শাহ একদা রাজ্যপাল হিসাবে জগদীপ ধনখড়ের ভূমিকা আইনসঙ্গত বলে শংসাপত্র দিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গেই ধনখড়ের বাদানুবাদ হয় বলে বিরোধীদের দাবি। শাসক শিবিরই জগদীপ ধনখড়কে অপসারণের প্রস্তাব আনতে সই সংগ্রহ শুরু করে দেয়। বাধ্য হয়ে নিজে থেকেই ইস্তফা দেন ধনখড়।
উপরাষ্ট্রপতিত্ব শেষ হলে হামিদ আনসারি প্রথামাফিক রাজ্যসভায় বিদায় সংবর্ধনা পান। ধনখড়ের ভাগ্যে তা জোটেনি। শাসকের অনুগত সাংবিধানিক পদাধিকারীদের জন্য এ-ও এক শিক্ষা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)