E-Paper

একটু হলেও কম একা

আমাদের সকলের মধ্যেই আছে একটা ‘কলোনি’, কারণ আমরা সকলেই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়ে পড়া মানুষ। যেখানে যাই সেখানে নতুন করে সামাজিক শিকড় চারিয়ে দিই, সম্পর্কও।

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৪:২৪

উত্তর কলকাতার কবিতা’য় প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, উত্তর কলকাতা মানচিত্রে কোনও নির্দিষ্ট স্থানের নাম নয়, আমাদের সকলের মধ্যেই একটা উত্তর কলকাতা আছে। একই সুরে এও বলা যায়, উদ্বাস্তু এলাকার বিভিন্ন নাম-ঠিকানা থাকলেও, সেগুলি শহরের মধ্যে আর একটি শহর, যার নিজস্ব সত্য, সত্তা ও ব্যক্তিত্ব আছে। আমাদের সকলের মধ্যেই আছে একটা ‘কলোনি’, কারণ আমরা সকলেই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়ে পড়া মানুষ। যেখানে যাই সেখানে নতুন করে সামাজিক শিকড় চারিয়ে দিই, সম্পর্কও। মধ্য কলকাতার জৌলুস, উত্তরের বনেদিয়ানা, দক্ষিণ কলকাতার চাকচিক্যবিহীন কলোনির এই অস্তিত্ব ও সংঘর্ষ।

দূরত্বের নিরিখে যাদবপুর বাঘাযতীন গড়িয়া, যোধপুর পার্ক বা হিন্দুস্তান পার্কের থেকে খুব বেশি দূরে না হলেও কলোনির ইতিহাস, সমাজ, কাঠামো ও মানুষে-মানুষে আদানপ্রদান আলাদা। নব্বইয়ের দশকে, যখন আমার শৈশব কৈশোরে এসে মিশছে, তখন কলোনির ভরা যৌবন। ও-পার থেকে আশা-আশঙ্কা নিয়ে আসা মানুষ যে যার জায়গায় বসে, কিছুটা থিতু হয়ে তত দিনে বাসা পাকা করার সামর্থ্য জুটিয়েছে। প্রচলিত প্রবাদ ছিল, “দখল করেছে ছয় ফুট, ছাড়েনি ছয় ইঞ্চি।” সেই না-ছাড়ার প্রভাব আজও কলোনির আনাচ-কানাচে। বহু রাস্তায়, বা একই রাস্তার অনেক জায়গায় দু’টি রিকশা পাশাপাশি যেতে পারে না।

ট্যাক্সি বা গাড়ি এলাকায় ঢুকলে তা ছিল চাঞ্চল্যকর ঘটনা। বাড়ির হাফ পর্দা ফাঁক হয়ে দেখা দিত সন্দিগ্ধ, অনুসন্ধানী চোখ। খোয়া বা ইটের রাস্তা এখন পাকা হলেও, চওড়ায় তার বাড়তে পারা অসম্ভব। অথচ উদারীকরণের প্রভাবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষার দাপটে, ঋণের সহজীকরণে, গাড়ি এখন বাড়িতে বাড়িতে। ঢুকতে-বেরোতে গায়ে-গা লাগলেই গলা চড়বে, চোখ লাল হবে। কলোনি মানেই ইঞ্চির লড়াই, যা আজও অব্যাহত। সল্ট লেক বা নিউ টাউনের প্রশস্ততা সেখানে অলীক ধারণা।

জায়গা, জমি, রাস্তার ধারণা কলোনিতে পৃথক; তার পত্তন, নির্মাণ, উন্নয়নের ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব ভিন্ন। উদ্বাস্তু মানুষের আবেগ-অনুভূতি, অধিকারবোধ ও সম্প্রদায়চেতনাও আলাদা। কলোনির পুজো, ক্লাব, পাঠাগার, পুকুর, মাঠ, সেই মাঠে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা রবীন্দ্রজয়ন্তী— এই সব কিছুর ভিতরে যে শক্তি ও উদ্দীপনা, তার আর এক নাম সঙ্ঘবদ্ধতা। গত দু’-তিন দশকে মানুষের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ অনেক কমেছে, ক্লাবগুলি চলে গেছে পার্টির অধীনে, ধুঁকছে বহু পাঠাগার। কমেছে শিল-কাটাও, ছুরি-ধারওয়ালার আনাগোনা। পুকুর বুজেছে, মাঠ লুপ্তপ্রায়। টিন-দরমা-টালি, একতলা, উঠোন, গাছ হটিয়ে উঠেছে বহুতল বাক্সবাড়ি। ঘুড়ি ধরা, ডাংগুলি খেলা, পেয়ারা বা আম চুরি যেন অন্য জন্মের স্মৃতি, দুয়ারে বা ঘরে ঢুকে পড়া সাপ কেঁচো বিছে ভাম যেন ভিনগ্রহী প্রাণী। মুছে গেছে কারও বাড়িতে গিয়ে সিনেমা বা খেলা দেখার চল। টেলিভিশন আর ল্যান্ডফোন যে নব্বই দশকের মাঝামাঝিও কী দুর্লভ ছিল কলোনির মধ্যবিত্তের কাছে, বর্তমান প্রজন্ম বিশ্বাস করবে কি?

কলোনিতে লোডশেডিং হলে শোনা যেত রসিকতা: ‘জ্যোতিবাবু গেলেন’, আর বিদ্যুৎ ফিরে এলে, ‘জ্যোতিবাবু এলেন’। রাস্তা তখনও এত আলোকিত নয়। কিছু বাল্‌ব টিমটিমিয়ে জ্বলত। সেই পাড়াতেই আলো গেলে, রাস্তায় নামত খালিগায়ে মানুষের ঢল। সন্ধে হলে ডানপিটে ছেলেকে বাড়ি ফেরাতে মাঠের কাছে বাবা-জেঠাদের গম্ভীর উপস্থিতিই ছিল যথেষ্ট। দুপুরে স্কুল-ফেরত পাশের বাড়ির জেঠিমার বাড়িতেই গিয়ে ওঠা, বাবা-মা না আসা পর্যন্ত সেখানেই খাওয়া বা থাকা ছিল অতি সহজ স্বাভাবিক ঘটনা।

পাড়াতুতো আদানপ্রদান, যাতায়াতও কমে এসেছে। ব্যক্তি-কেন্দ্রিক দ্রুতগামী জীবনে, সামাজিকতায় ভাটা এক নাগরিক সত্য। তা সত্ত্বেও পাশের বাড়িতে ফোন করে যাওয়াটা— কলোনিতে অভাবনীয়। লেখা, পড়া, ঘুমনো— তারই মধ্যে পাশের বাড়ির দাদা-কাকার প্রবেশ কলোনিতে এখনও অস্বাভাবিক নয়। অন্য এলাকায় যা অনধিকার চর্চা, কলোনিতে অনেক ক্ষেত্রেই তা আন্তরিকতা, সামাজিক রেওয়াজ। রান্নার বাটি, উপহার বা মতামত-বিনিময়, উপদেশ-নির্দেশের ঘোরাফেরা আজও রয়ে গেছে অনেক কলোনির বাড়িতে। পড়শির জন্য হাসপাতালে দৌড়নো, এক সঙ্গে বেরিয়ে ভোট দিতে যাওয়া, অন্যের বাড়ি পাহারা দেওয়া— দাবি ও দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে আত্মীয়ের চেয়েও বেশি। কলোনিজীবন আজও তাই একটু হলেও কম একাকী। দরজা বন্ধ করে দিলেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নয়, অন্যের ব্যাপারে নাক-কান গলানোও তার সামাজিকতার অচ্ছেদ্য অঙ্গ।

কলোনিতে এক ধরনের সর্বজনীন দৃশ্যমানতা কাজ করে। তার চার পাশ সর্বদাই দেখে, মাপে ও সেই ব্যাপারে মতামত পোষণ করে। অনেকের কাছে এটা অপ্রয়োজনীয় নজরদারি, আবার অনেকের কাছে এ এক সামাজিক সুরক্ষাকবচও। নানা বিবর্তন সত্ত্বেও, অনেক ক্ষেত্রেই এখনও কলোনির জীবন শহরের অন্যান্য অংশের মতো বিক্ষিপ্ত ও দূরত্বপীড়িত নয়। এখানে যে যার মতো নয়, অনেকেই অনেকের জন্য।

সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Colony North Kolkata south kolkata Central Kolkata

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy