জুলাই-শেষের সেই মর্মান্তিক রাতে প্রবল চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙেছিল চূড়ালমালার মাইমুনা-র। সভয়ে দেখেছিলেন, বাড়িরমেঝেয় ঘুরপাক খাচ্ছে কাদাজল। জল কোমর ছাড়াতে গোটা পরিবার আশ্রয় নেয় ছাদে। সেখান থেকেই প্রত্যক্ষ করেন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে বাড়ির দোতলা অবধি দখল করে নিচ্ছে কাদাজল, বিরাট পাথরের চাঁই আর ভেসে আসা ধ্বংসস্তূপ। ৩১ জুলাইয়ের সকালে উদ্ধার হওয়ার আগে অবধি কোনও ক্রমে টিকে থাকা ওই ছাদটুকুই ছিল তাঁদের আশ্রয়স্থল। চোখের সামনে দেখেছেন পড়শিদের বাড়ি ভেসে যেতে, সবুজে সাজানো আবাসভূমিকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে।
শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মাইমুনার মতো কোনও ক্রমে বেঁচে যাওয়া ওয়েনাড়ের অধিবাসীরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন, তা স্তব্ধ করে দেয়, নত করে প্রকৃতির এই রুদ্ররূপের সামনে। এই ধ্বংস রুখবে কে? বিরাট, বিপুল, অসীম শক্তির সামনে প্রতিরোধই বা গড়া যাবে কোন উপায়ে? উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম— ভারতের যে সব পাহাড়ি রাজ্য প্রতি বছর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিরিখে শিরোনামে জায়গা করে নেওয়া অভ্যাস করে ফেলেছে, কেরলের ওয়েনাড়ও তাতে সংযুক্ত হল। হয়তো আগামী দিনে এই তালিকা আরও বাড়বে, আরও অসংখ্য অ-প্রস্তুত, অসহায় নাগরিকের অস্তিত্ব স্রেফ কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে ‘নেই’ হয়ে যাবে। যেমনটা হয়েছিল ২০১৩-র জুন মাসে কেদারনাথে, যেমনটা হল এই বছরের জুলাই-শেষের ওয়েনাড়ে।
প্রশ্ন তোলা যায়, এত বিপর্যয়ের পরেও আবহাওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারি বিভাগগুলির মধ্যে সমন্বয়ের এমন বেআব্রু দশা কেন? পূর্বাভাস সময়মতো পাওয়া গেলে যে বহু প্রাণহানি আটকানো সম্ভব, ভারতের ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসের আধুনিক ব্যবস্থাটি তার প্রমাণ। তা হলে পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে, বিশেষত কেরল, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল, সিকিমের মতো অতি বর্ষণ এবং ভূমিধস প্রবণ এলাকাগুলিতে কেন পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দেওয়া হয়নি? ওয়েনাড় প্রসঙ্গে জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র তরফ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের জেলাভিত্তিক ভূমিধসের সতর্কবার্তা দানের মডেলটি এখনও পরীক্ষামূলক স্তরে আটকে আছে। সম্পূর্ণ হতে আরও চার-পাঁচ বছর সময় লাগবে। ইতিমধ্যে এমন আরও বিপর্যয় ঘটলে কি মৃত্যুমিছিল চলতেই থাকবে? সাধারণ বুদ্ধি বলে, পাহাড়ি অঞ্চলে মেঘভাঙা বৃষ্টি, ভূমিধস এবং বন্যার সতর্কবার্তা সময়মতো এবং নিখুঁত ভাবে পাওয়া না গেলে ক্ষয়ক্ষতি রোখা অসম্ভব। শুধুমাত্র অতিবৃষ্টির পূর্বাভাসই এ কাজে যথেষ্ট নয়। সুতরাং, বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিভাগকে একযোগে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে এবং তাদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রস্তুত থাকতে হবে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগকে। পূর্বাভাসে ব্যর্থতার দায় কার— সেই নিয়ে চাপানউতোরের চেয়ে এই কাজ ঢের বেশি জরুরি।
২০২২ সালেই ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রক সংসদে জানিয়েছিল, ২০১৫-২২ সময়কালে ভারতে সংঘটিত ভূমিধসের প্রায় ৬০ শতাংশই কেরলে ঘটেছে। অর্থাৎ, ওয়েনাড়ের বিপর্যয় খুব অপ্রত্যাশিত নয়। ২০১১ সালে গঠিত পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক এক বিশেষজ্ঞ প্যানেল যেমন এই সাম্প্রতিক ভূমিধস নিয়ে স্পষ্ট জানিয়েছে, পশ্চিমঘাট আসলে দীর্ঘ দিনের অবহেলার শিকার। তাঁদের প্রস্তাব, অবিলম্বে পশ্চিমঘাটকে বাস্তুতন্ত্রের দিক থেকে ‘স্পর্শকাতর এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হোক। সমগ্র অঞ্চলকে কয়েকটি ‘গ্রেড’-এ ভাগ করে সেইমতো সেখানে মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হোক। এই প্রস্তাব শুধুমাত্র পশ্চিমঘাটই নয়, হিমালয়ের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত জরুরি।
জরুরি, পর্যটনকে নিয়ন্ত্রণও। বিশেষত বর্ষাকালে। লক্ষণীয়, উত্তর ভারতের অনেক পর্বতবেষ্টিত ধর্মস্থানই ভূপ্রকৃতিগত দিক থেকে সংবেদনশীল এলাকায় অবস্থিত। সেখানে ভূপ্রকৃতিগত প্রয়োজনেই পর্যটকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত জরুরি। তা ছাড়া কেদার-বদ্রী’সহ অনেক মন্দিরে মূলত বর্ষাকালটিই পুণ্যার্থী আগমনের মূল সময় হওয়ায় অতিবৃষ্টিতে সমস্যাও বাড়ে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে উদ্ধারকাজ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যেই প্রমাণিত কেদার-বদ্রী পথে প্রতি বছর ধারণক্ষমতার বহুগুণ বেশি পর্যটকের পা পড়ে। পর্যটকের সংখ্যা সেখানে বেঁধে দেওয়ার বহু প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা পড়লেও কাজ হয়নি। ধর্ম ও পর্যটনের বিনিময়ে লক্ষ্মীলাভ এবং সাধারণ মানুষের প্রাণের মধ্যে বিচার করা হলে অবশ্যই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনদরদি সরকারের চোখে দ্বিতীয় বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তেমনটা যে হয়নি, পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে অনিয়ন্ত্রিত ভিড় তার প্রমাণ। সংবেদনশীল অঞ্চলে পর্যটকদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে গিয়ে স্থানীয়দের রুজিরোজগারে টান পড়লে বিকল্প কর্মসংস্থান রাজ্য সরকারকেই করতে হবে। কিন্তু এই অজুহাতে একের পর এক প্রাণহানি ঘটতে দেওয়া চলবে না।
একের পর এক দুর্যোগ-শেষে নিশ্চিহ্ন জনপদ, ভাঙাচোরা ঘর-সংসার, সর্বস্বহারা মায়ের কান্নার ছবি আর কত দিন সহ্য করব আমরা? না কি এমনটাই নিয়তি ধরে আগামী দুর্যোগের প্রহর গুনব? জলবায়ু পাল্টাচ্ছে। যা অনুমান করা হয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি দ্রুত। সেই গতিকে আটকানো অ-সম্ভব, যেমন ক্রমশ অ-সম্ভব বোধ হচ্ছে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখা। তাই আগামী দিনের ভয়াল বিপর্যয়কে প্রায় অবধারিত মেনে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করতে হবে সরকারকে, নাগরিককেও। পাহাড়ি নদী আটকে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রাখা, ধূলি-ধূসর পাহাড়কে ফের সবুজে ভরিয়ে দেওয়া, কিংবা পাহাড় কেটে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা— এ সব এখন অলীক কল্পনা। উন্নয়নের তোড় কবেই সে সব রঙিন সম্ভাবনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। অতঃপর হাতে যে কয়েকটা অস্ত্র পড়ে আছে, তার সদ্ব্যবহার করার সময়। বিপর্যয় যদি এড়ানো না যায়, আরও কিছু প্রাণ অন্তত বাঁচুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy