E-Paper

বাংলা ভাষার শ্রীহীন সময়

ভাষার শ্রীহীন সময়কে সুসময়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বলিষ্ঠ উপায় হতে পারে বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার উদ্যম তৈরি করা, ভাষাটিকে জ্ঞান-কল্পনা অর্জনের সহায়ক করে তোলা।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৪০

বা‌ংলা ভাষার ‘অসময়’ চলছে। কারণ হিসাবে অন্য ভাষার আধিপত্যের কথা অনেকেই বলছেন, শুধু বলছেন না সেটাকেই ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ হিসাবে চালাতে চাইছেন। হিন্দি-ইংরেজি এই দুই ‘নন্দ ঘোষ’ বাংলা ভাষার ‘দমবন্ধ’ করে দিচ্ছে। এ ভাবনা বাইরের। সমস্যার মূল ভিতরে, বাংলা যাঁদের ভাষা তাঁরাই এ ভাষার প্রতি নানা কারণে বিশ্বাস হারিয়েছেন। এক দিকে অর্থনৈতিক ভাবে বিত্তশালী ভদ্রলোকদের বড় অংশ আন্তর্জাতিকতার ধুয়ো তুলে ‘ইন্ডিয়া’ নামক ব্যবস্থাপনার অংশ হয়ে ইংরেজিমুখী, তাঁদের বাড়ির নব্য প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা দুয়োরানিও নয়, ‘ডোমেস্টিক হেল্প’-এর ভাষা। আর তার বাইরের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ বাঙালি? পশ্চিমবঙ্গের সরকারি মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়গুলি বিভিন্ন কারণে বহু ক্ষেত্রে শিক্ষক-সামর্থ্যহীন। রাজ্যের বৃহত্তম এই বাংলা ভাষা-মাধ্যম বিদ্যালয়-ব্যবস্থা দিশাহারা, বাংলা ভাষার উঠোনে আত্মবিশ্বাসী ছেলে-মেয়েদের অভাব দেখা দিচ্ছে। নানা ‘শ্রীময় প্রকল্প’-এর অর্থ নিতান্ত পড়ে পাওয়া কয়েক আনা হয়েই থাকছে।

যে টাকা সুব্যবস্থাপনা ও সুশিক্ষার সহযোগে বলকারক ও পুষ্টিদায়ক হয়ে উঠতে পারত, তা দুর্নীতি আর ‘পাইয়ে দিচ্ছি’ মনোভাবের মাতব্বরিতে হানিকারক— নিতান্ত তেলচিটে রাজনৈতিক উৎকোচ, ঘুষ। মানুষকে অসম্মানিত করে, অসম্মানের বোধও টাকা-আফিমের মৌতাত নষ্ট করে দেয়। শিক্ষার প্রতি যত্ন নষ্ট হয়। ভোট-মতলবের মন-ভোলানি রাজনৈতিক দান ভবিষ্যৎ নাগরিকদের অর্জন করার শক্তি, উদ্যম, ইচ্ছে, কল্পনা হরণ করে। ফলে বাংলা ভাষা দু’-পক্ষেই ও তাদের পারস্পরিক বিযুক্তিতে শ্রীহীন।

ভাষার শ্রীহীন সময়কে সুসময়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বলিষ্ঠ উপায় হতে পারে বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার উদ্যম তৈরি করা, ভাষাটিকে জ্ঞান-কল্পনা অর্জনের সহায়ক করে তোলা। আর চাই এই দুই পক্ষের মানুষের মধ্যে সংযোগ সাধন। কেউ কেবল শুধু বাংলা ভাষায় আনন্দ করে নানা কাজ করলে, ভাবলে ছোট হয়ে যান না, আবার ইংরেজি-হিন্দি ভাল জানা বাঙালিমাত্রেই বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করেন না। এমন একটা ব্যবস্থাপনা উনিশ শতকে বাঙালি তৈরি করতে পেরেছিল। সফল উদাহরণ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ। কানে শোনা আর চোখে দেখা পৃথিবীর প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল ‘শুধু বাংলা’ জানা রামকৃষ্ণদেব ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা পড়া-লেখা জানা বিবেকানন্দের আচার্য। রসিক ঠাকুর আবার পড়া-লেখা জানা গিরিশ-নরেনকে তর্ক করতে বলতেন, দেখে-শুনে উপভোগ করতেন।

উনিশ শতকের কথা থাক, একুশ শতকের একটা প্রচেষ্টার কথা বলি। জীবনের শেষ পর্বে, এই শতকের গোড়ায়, বাংলা ভাষার ভিতরের দুর্বলতার উপসর্গগুলি যখন উঁকি মারছিল তখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলা প্রাইমার লেখায় মন দিয়েছিলেন। শঙ্খ ঘোষের সহযোগিতায় প্রকাশিত সেই প্রাইমারটির নাম শুনি দেখি পড়ি লিখি। হাতে নিলে বোঝা যায় পদাতিক কবি শোনা-দেখার জগতের নানা শ্রেণির খেটে-খাওয়া বাঙালির সঙ্গে পড়া-লেখার জগতের নানা শ্রেণির বাঙালির যোগ সাধন করতে চাইছিলেন বাংলা ভাষা দিয়ে। পড়ি-লিখির জগতের আগেই তো শোনা-দেখার জগতে মন ভরে ওঠে। সেই ভরা মন মানুষেরা নিরক্ষর হতে পারেন, কিন্তু নির্জ্ঞান তো নন। বরং তাঁদের জ্ঞান কল্পনার সাহায্য যদি পড়া-লেখার জগৎ নিতেন! নিলে ‘আক্ষরিক’ অর্থেই বাঙালির মানবজমিন পতিত থাকত না, সোনা ফলত। যেমন ফলেছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সহযোগে।

তার আগেও কি সোনা ফলেনি? ফলে যে ছিল তার সশব্দ অস্তিত্ব এই অসময়ে বাঙালির কানে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে অনীকের নাটক আক্ষরিক। পঞ্চানন কর্মকার রামকৃষ্ণদেবের চেয়ে বয়সে বড়। কামার বাড়ির মেহনতি ছেলে, নিজেকে নিতান্ত কামার বলে অবশ্য ভাবেননি তিনি। অক্ষর-শিল্পী এই বোধে আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছিলেন। জাত ব্যবসার পথ ধরে অন্যান্য ধারালো-লোহার কাজের পাশাপাশি ধাতব বাসনপত্রে আলপনা আঁকতেন লতা-পাতার। সেই লতাপাতা আঁকিয়ে মানুষটিই বাংলা মুদ্রণ প্রযুক্তির জগতে বিপ্লব এনেছিলেন। পুঁথি থেকে বই এসেছিল বাংলা মুদ্রণের কল্যাণে। শুরু হয়েছিল পড়া-লেখার নতুনতর ইস্কুল ব্যবস্থা। এরই আদিপর্বে সাহেবরা নিজেরা ভাষা শেখার জন্য বাংলা ব্যাকরণ, অভিধান নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছিলেন। ধর্ম প্রচারের জন্য বাইবেল অনুবাদে নেমেছিলেন। পঞ্চানন সেই কাজের সহযোগী, তবে ছাপাখানা এলে শুধু তো সাহেবদের মতলবই পূর্ণ হবে না, বাঙালি নেটিভদের চোখের সামনে খুলে যাবে জ্ঞানের আদিগন্ত। সেই দিগন্তের উন্মোচক উচ্চবর্ণের ভদ্রলোক নন, বর্ণব্যবস্থায় পিছিয়ে থাকা শ্রমনিষ্ঠ কর্মকার। তাঁর কাজে বর্ণব্যবস্থার জল-অচল ভেদ গিয়েছিল ভেঙে। হ্যালহেডের ব্যাকরণ বইয়ের জন্য বাংলা হরফে যে পদগুলি ছাপা হবে তার জন্য বাংলা অক্ষরের ধাতব সাঁট কেটে দিয়েছিলেন তিনি। পরে উইলিয়াম কেরিরও যোগ্য সহযোগী পঞ্চানন। পঞ্চাননের রামকৃষ্ণদেবের মতোই খানিক পাঠশালার বিদ্যে ছিল, তবে প্রজ্ঞা আর কল্পনা অর্জন করেছিলেন দেখাশোনার জগৎ থেকেই।

এই নাটকে কামারশালা আর ছাপাখানার শ্রমের শব্দ পড়া-লেখার আত্মগত নীরবতার ধ্বনির সঙ্গে মিশে যে সুর তৈরি করেছে, তাই তো ভাষার বনেদকে মজবুত করে, দু’-পক্ষের পারস্পরিক আলিঙ্গন। নাটকে পঞ্চানন খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, বাংলা বর্ণমালার সাঁট তো তাঁর মতো বাঙালি কামারই ধাতু কেটে তৈরি করবেন। এ বঙ্গের প্রকৃতির লতাপাতা, জলের ঢেউ, বাড়ির বৌয়ের সুছাঁদ মনে যে আলপনার রূপ তৈরি করে, তাই তো তাঁর বাংলা হরফের শরীরে ডৌলে মিশে যায়। সে তো কেবল পড়া-লেখার বর্ণ নয়, দেখা-শোনার ছবি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রাইমারের শেষে কী যত্ন করে যে বঙ্গদেশের নিজস্ব আলপনার ছাঁদ থেকে বাংলা বর্ণমালার শরীর তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছিল। বঙ্গদেশের আলপনার মধ্যে যে নদীমাতৃক দেশের প্রাকৃতিক ঢেউ মিশে আছে এ-কথাটা তো আর গোপন নেই। তা হলে কী করেই বা বাংলা বর্ণমালা কেবল ভদ্রলোকের পড়ালেখার জগতের ‘একান্ত’ সম্পদ হবে! তার উৎসমুখে দেখা-শোনার লোকজ জগৎটি শত জল-ঝর্নার ধ্বনি নিয়ে বসে আছে। বাঙালির ছাপা বর্ণপরিচয় তো কেবল বিদ্যাসাগরের উদ্যমে গড়ে ওঠেনি, তার আদিতে আছে পঞ্চানন কর্মকারের শ্রম আর কল্পনা। শ্রম আর কল্পনার জগৎ, দেখা-শোনার জগৎ যখন পড়া-লেখার জগৎ থেকে আলাদা হয়ে যায় তখনই তো ভাষার দুর্দিন। রামকৃষ্ণদেবের ভিক্ষা-মা ছিলেন ধনী কামারনি, তিনি তাঁর কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়েছিলেন।

ভাষার দুর্দিনের বোধ যখন বাঙালি ভদ্রলোকদের মনে জেগেছে তখন তাঁরা দুই পক্ষের সংযোগ ঘটাতে চেয়েছেন। ১৮৭২-এ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র চেয়েছিলেন ‘কৃতবিদ্য’ (ওয়েল এডুকেটেড ক্লাস) ও সাধারণের মধ্যে সেতু তৈরি হোক। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শিক্ষা বিকীর্ণ হোক প্রতিষ্ঠানের বাইরে— বাংলা ভাষার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘ওরা চালিত হবে, আমরা চালনা করব দূর থেকে, উপর থেকে’ এমন মনোভাব জাগলে সংযোগ স্থাপন অসম্ভব। তাই জেগেছিল ক্রমশই, ফল এই: ‘মিলতে দেয় না, ভেদকে জাগিয়ে রাখে।’ পরে বঙ্গজ বামপন্থীরা একদা এই সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতায় এক রকম ভাবে ব্যর্থতার কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ কৃষিবিভাগের কর্তৃপক্ষের কথা শুনে নির্দিষ্ট জমিতে আলু চাষ করতে গিয়ে একশো মন সার ইত্যাদি খরচ করেন। কৃষিবিভাগের প্রকাণ্ড তালিকায় ফসল ফলল, কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের কোনও সামঞ্জস্য রইল না। তার পর? “এ-সব দেখে” রবীন্দ্রনাথের “এক চাষী প্রজা বললে, ‘আমার ’পরে ভার দিন বাবু!’ সে কৃষিবিভাগের তালিকাকে অবজ্ঞা করেও প্রচুর ফসল ফলিয়ে” ভদ্রলোক কবিকে লজ্জিত করলে। সমাজ-ভাষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভদ্রলোকেরা কে আর কবে সাধারণকে এই ভার অর্থাৎ দায়িত্ব-কর্তৃত্ব দিয়েছেন?

ভদ্রলোকের বামপন্থা সাধারণের উপর চেপে বসে যে শীলিত সাজানো বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি তৈরি করেছিল তারই বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গে বামেদের পতনের পর আর এক ভাষা-সংস্কৃতির রমরমা। তার মধ্যে আক্ষরিকের পঞ্চাননের মন-কল্পনা-উদ্যম আর প্রাকৃতিকতা নেই। পরিশীলনের প্রতি অবজ্ঞা থেকে ভেংচি-কাটা রাগ, খিস্তি-খেউড় আর তীব্র যৌন রসিকতা আছে মাত্র। তা শুধুই অন্তর্ঘাত ঘটায়, গড়ে না। পঞ্চাননরা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই গড়তে চেয়েছিলেন, ‘ভার নিয়েছিলেন’। রামকৃষ্ণ বলতেন, নাটকে ‘লোকশিক্ষে’ হয়। আমাদেরও পঞ্চাননের কথা শুনে একটুও যদি হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Bengali Language

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy