Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
Labour

সুতোয় ঝোলা জীবন

কর্মস্থলে জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা, সুরক্ষার প্রশ্নে ভারতের সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি নথিভুক্ত কারখানাতে (২০২০) কর্মরত দু’কোটিরও বেশি শ্রমিকের ভাগ্য কার্যত সুতোর উপর ঝুলছে।

labour working in factory

নতুন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। Sourced by the ABP

সত্যব্রত পাঠক
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩ ০৭:৪৩
Share: Save:

উত্তরপ্রদেশের বাসতি জেলার বাসিন্দা একুশ বছরের আমন শুক্লা আমদাবাদের এক ছাপাখানায় কাজ করতে এসেছিলেন। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁকে বিদ্যুৎচালিত প্রেস অপারেটরের কাজ দেওয়া হয়। কাজে যোগ দেওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেস-মেশিনে দুর্ঘটনায় আমনের হাতের আঙুল কাটা পড়েছে। কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ কত মিলবে, সে মামলা লেবার কোর্ট-এ এখনও ঝুলছে। আমনের সঙ্গে ওই দিনই আর এক শ্রমিকও আহত হয়েছিলেন। আইনি দায় এড়াতে তাঁদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, যথাযথ চিকিৎসাও হয়নি। দু’জনেরই স্থায়ী অঙ্গহানি হয়েছে। আইনি ঝামেলার ভয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনার কোনও রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট এলাকার কারখানা পরিদর্শক বা পুলিশকে জানাননি, কারখানা আইন অনুসারে যা বাধ্যতামূলক।

এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কর্মস্থলে জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা, সুরক্ষার প্রশ্নে ভারতের সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি নথিভুক্ত কারখানাতে (২০২০) কর্মরত দু’কোটিরও বেশি শ্রমিকের ভাগ্য কার্যত সুতোর উপর ঝুলছে। এর বাইরে থাকা বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের কথা না বলাই ভাল। সরকারের কাছে তাঁরা নাম-পরিচয়হীন সংখ্যামাত্র। কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ২০১১-২০২০ সালের মধ্যে ভারতে মোট ১১,১৩৮টি শিল্প-দুর্ঘটনায় মোট দেড় লক্ষেরও বেশি শ্রমিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত, দুর্ঘটনার ফলে মৃত অথবা স্থায়ী ভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ার শিকার হয়েছেন বারো হাজার শ্রমিক। অথচ, কারখানা আইন লঙ্ঘনের দায়ে মাত্র দশ জনের কারাদণ্ড হয়েছে, এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে শ্রমিকদের মোট প্রাপ্তির পরিমাণ কমবেশি তিন কোটি টাকা।

এই রিপোর্টও সম্পূর্ণ ছবিটা তুলে ধরেনি, কারণ এতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের দুর্ঘটনা ধরা নেই। সংগঠিত ক্ষেত্রেরও শুধু সেই ঘটনাগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যেগুলি কারখানা পরিদর্শক রিপোর্ট করেছেন। কারখানা পরিদর্শনের অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর সুযোগ নিয়ে বহু কারখানা কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার খবর চেপে যান। রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে কারখানা পরিদর্শক, নিরাপত্তা পরিদর্শক, চিকিৎসা পরিদর্শকের প্রায় অর্ধেক পদ শূন্য। এখন ভারতে গড়ে এক জন কারখানা পরিদর্শকের অধীনে প্রায় পাঁচশো কারখানা রয়েছে। ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ক বিধিগুলো পালিত হচ্ছে কি না, তা দেখা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া মালিকদের সঙ্গে আধিকারিকদের যোগসাজশ, রাজনৈতিক চাপের অভিযোগ তো আছেই। ১৯৮৬ সালে নথিভুক্ত কারখানার ৬৩ শতাংশে পরিদর্শন হয়েছিল, ২০১৫ সালে হয়েছিল মাত্র ১৮ শতাংশে— এ থেকেই আন্দাজ করা যায়, শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলি কতটা আগ্রহী।

পশ্চিমবঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপত্তা কতটুকু? প্রথমেই বলা দরকার, উপরোক্ত সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২০ সালে কোনও তথ্য দেয়নি কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রককে। শ্রম দফতরের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘লেবার ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’ ২০১৫-১৬ সালের পরে আর প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু তাতে সুরক্ষাহীনতার ছবিটা চাপা পড়ে না। আবাস নির্মাণ এখন পশ্চিমবঙ্গের এক প্রধান শিল্প। বহুতল নির্মাণের কাজে প্রায়ই দেখা যায়, শ্রমিকরা উপযুক্ত নিরাপত্তার পোশাক, হেলমেট, সেফটি নেট ইত্যাদি ছাড়াই কাজ করছেন। প্রতি দিন বহুতলের উঁচুতে কাজ করতে ওঠার আগে শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, চোট আঘাতের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা তৈরি রাখা, এমন সব বিধানই আইনে আছে। কাজে সে সব মানা হয় না, পরিদর্শনও তেমন হয় না। ফলে বহুতল থেকে পড়ে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, অঙ্গহানির ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখা যায়।

পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত ১৬,৭৪৪ (২০১৩-১৪) কারখানার জন্য পরিদর্শক আছেন মাত্র চল্লিশ জন। এর সঙ্গে রয়েছে শ্রমিকদের পেশাজনিত রোগ। পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা আক্রান্ত হন সিলিকোসিসে, বিড়ি যাঁরা বাঁধেন, তাঁরা তামাকের ক্ষতিকর মশলার থেকে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণজনিত নানা অসুখে ভোগেন। মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো বিড়ি শ্রমিক অধ্যুষিত জেলাতেও শ্রমিকদের কাজ সংক্রান্ত নথিপত্র, সামাজিক সুরক্ষা বাবদ প্রাপ্য টাকা, ন্যায্য মজুরি, শ্রমিক কল্যাণের ব্যবস্থা, নিরাপত্তা তথা স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা নেই। বিড়ি কোম্পানিগুলো মহাজনদের মাঝে রেখে কর্মীদের প্রতি দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়। ফলে পশ্চিমবঙ্গের কুড়ি লক্ষ বিড়ি শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশই মহিলা, কার্যত অসুরক্ষিত।

কেন্দ্র বা রাজ্য কেউ জানে না, পেশাগত রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা কত, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ইএসআই চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত রাজ্যের মাত্র ছয় শতাংশ শ্রমিক। ইএসআই-এর আওতার বাইরে থাকা শ্রমিকদের পেশাগত রোগের বিষয়ে ‘কর্মচারী ক্ষতিপূরণ আইন’-এর ভূমিকা কী, সে বিষয়ে কারখানা মালিক, শ্রমিক, ট্রেড ইউনিয়ন কারও সম্যক ধারণা নেই। নেই প্রশাসনের তরফ থেকে কোনও সচেতনতা তৈরির জন্য প্রচার বা কর্মশালার উদ্যোগ। আইন রয়ে গিয়েছে কেবল বইয়ে, সুরক্ষাহীনতাই শ্রমিকের ভাগ্য হয়ে উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE