E-Paper

রানা প্রতাপের হার-জিত

প্রচলিত ইতিহাস এত দিন বলে এসেছে যে, হলদিঘাটের যুদ্ধে মহারানা প্রতাপ আকবরের সেনাদলের হাতে পরাস্ত হয়েছিলেন। দিয়া কুমারীর সৌজন্যে কী ভাবে যুদ্ধের ফল পাল্টে গেল?

সুমন কল্যাণ মৌলিক

সুমন কল্যাণ মৌলিক

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৫৪

মৃত্যুর পর চার শতাধিক বছর অতিক্রান্ত, তবু রাজপুত বীর মহারানা প্রতাপের পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক। এ বারের বিতর্ক তৈরি করেছে রাজস্থানের উপমুখ্যমন্ত্রী, তথা বিজেপি নেত্রী ও অম্বর রাজঘরানার কন্যা দিয়া কুমারীর এক বক্তব্য। এক আলোচনা সভায় তিনি সগর্বে জানিয়েছেন যে, সাংসদ হিসাবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল, তিনি হলদিঘাটের যুদ্ধে রানা প্রতাপকে জয়ী ঘোষণা করতে পেরেছেন। প্রচলিত ইতিহাস এত দিন বলে এসেছে যে, হলদিঘাটের যুদ্ধে মহারানা প্রতাপ আকবরের সেনাদলের হাতে পরাস্ত হয়েছিলেন। দিয়া কুমারীর সৌজন্যে কী ভাবে যুদ্ধের ফল পাল্টে গেল? খুবই সহজে— হলদিঘাটে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার লাগানো ফলক বদলে দিয়ে। সেখানে এখন থেকে জয়ী হিসাবে চিহ্নিত হবেন মহারানা প্রতাপ।

নতুন সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই এ ভাবে ইতিহাসের পুনর্লিখন করা যায়? কেবল এক জন জনপ্রতিনিধির ইচ্ছায়? বিশেষ করে সাধারণ মানুষের ইতিহাস চেতনা, কোনও ঐতিহাসিক বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের ফলকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেখানে এই বিকৃতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কোন ইতিহাস তুলে ধরবে, সে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন তৈরি করছে।

১৫৭৬ সালের জুন মাসে সংঘটিত হলদিঘাটের যুদ্ধ নিশ্চিতভাবে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্যের কোনও কমতি নেই। আবুল ফজ়লের আকবরনামা, বদায়ুনির মুন্তাখাব-উৎ-তাওয়ারিখ, খাজা নিজামউদ্দিন আহমেদের তাবাকাৎ-ই-আকবরী’তে এই যুদ্ধের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি রাজপুত কাহিনি সঙ্কলন অমর কাব্য, যেখানে রানা প্রতাপের বীরত্বগাথা, তার প্রিয় ঘোড়া চেতক নিয়ে অনেক পরস্পর-বিরোধী কথা রয়েছে, সেখানেও কিন্তু হলদিঘাটের যুদ্ধে রানা প্রতাপকে বিজয়ী বলা হয়নি। তবে এই যুদ্ধে পরাজয়ের পরেও রানা প্রতাপ অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে মেবারের অনেক অংশ পুনর্দখল করেছিলেন, সে বিষয়েও ইতিহাসবিদরা সহমত।

হলদিঘাটের যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল মেবারের ভৌগোলিক অবস্থান। মেবার থেকে হিরে বাণিজ্যের কেন্দ্র গুজরাতে পৌঁছনো সহজ ছিল। এ কথা প্রমাণিত যে, মোগল বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মান সিংহ এই যুদ্ধে রানা প্রতাপকে বেকায়দায় ফেলে দেন, এবং পরিস্থিতির প্রতিকূলতা বিচার করে রানা প্রতাপ আরাবল্লী পর্বত এলাকায় আশ্রয় নেন। এই যুদ্ধে রানা প্রতাপের কৌশলী পশ্চাদপসরণ মোগলদের কোনও দীর্ঘস্থায়ী সুবিধা দেয়নি। রানা প্রতাপ গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মেবারের একটা বড় অংশে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন। রমেশ চন্দ্র মজুমদার, জি এন শর্মা, কে এস লাল প্রমুখ ইতিহাসবিদ তাই মোগলদের জয়কে ‘আংশিক’ বলেছেন।

দিয়া কুমারী ও তাঁর সমর্থকরা ‘প্রকৃত’ ইতিহাস লেখার নামে যে আখ্যান তৈরি করতে চান, তার সঙ্গে আজকের বাস্তবতা জড়িত। এর প্রধান লক্ষ্য ভারতে মোগল যুগের অস্বীকৃতি। দিয়া কুমারী তাই বলেছেন বহিরাগত মোগলরা রাজপুতদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পদ্ধতিতে শাসন করতে চেয়েছিল, রাজপুতরা একত্রিত হয়ে তা ব্যর্থ করে। তাঁরা হলদিঘাটের যুদ্ধকে হিন্দু রানা প্রতাপ ও মুসলিম আক্রমণকারী আকবরের বাহিনীর মধ্যে এক সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসাবে দেখাতে চান। মান সিংহের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে তাঁরা আগ্রহী নন। মজার কথা হল, আকবরের পক্ষের এই সেনাপতি ছিলেন অম্বরের রাজা (বর্তমান নাম জয়পুর), আজকের উপমুখ্যমন্ত্রী দিয়া কুমারী সেই মান সিংহের উত্তরসূরি। অপর দিকে, রানা প্রতাপের বাহিনীর অন্যতম সেনা নায়ক ছিলেন হাকিম খান সুরি, যিনি আবার শের শাহ সুরির উত্তরসূরি। তাই হিন্দু-মুসলিম চেনা ছকে হলদিঘাটের যুদ্ধকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

ইতিহাস রানা প্রতাপকে মনে রাখবে, কারণ যে সময়ে রাজপুতানার বেশির ভাগ শাসক নানান সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন ও মোগল দরবারের বিভিন্ন উচ্চপদ অলঙ্কৃত করেন, সে সময়ে রানা প্রতাপ প্রতিরোধকে বেছে নিয়েছিলেন। অবশ্যই, ইতিহাসের বইতে যা লেখা থাকে তা ধ্রুব সত্য নয়, নতুন উপাদানের ভিত্তিতে তার পরিবর্তন হয়। কিন্তু হলদিঘাটের যুদ্ধের ফল উল্টে দেওয়ার পিছনে সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই, রয়েছে রাজস্থানের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গৌরবের রাজনীতি। প্রথমটি হল রাজপুত, যাঁদের প্রতিনিধি হলেন রানা প্রতাপ, অপরটি হল জাঠ সম্প্রদায় যা মহারাজা সুরজমলকে নিয়ে গৌরব করে। পরিচিতির রাজনীতির ফলে এখানে তৈরি হয়েছে ‘করণী সেনা’-র মতো সংগঠন, যা রাজপুত ঐতিহ্যের ‘অভিভাবক।’ তারা স্থির করে, রাজপুত ঐতিহ্যের পক্ষে কোনটা মর্যাদার, কোনটা অমর্যাদার। চিত্র পরিচালক, নাট্যকার, লেখক, সবাই তাদের রোষের শিকার হয়েছেন। এই সমস্যা শুধু রাজস্থানকে নিয়ে নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে বলিউডের চিত্রতারকা— সবাই আজ নিদান দিচ্ছেন নতুন ইতিহাস রচনার। এই নব-রচয়িতাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মোটের উপরে এক— সুলতানি ও মোগল সাম্রাজ্য, মধ্যযুগে যাদের গৌরবজনক উপস্থিতি আজকের শাসকদের কাছে ভাল লাগার বিষয় নয়। আমরা সবাই জানি, যে-হেতু হিন্দু-মুসলিম বিরোধ আজকের শাসকদের রাজনৈতিক বিস্তারের অন্যতম শর্ত, সে-হেতু তাঁরা মুসলমানদের যে ছবি জনমানসে চিত্রিত করতে চান তা হল বহিরাগত, ধ্বংসাত্মক, বর্বর ও নৈতিক ভাবে অধঃপতিত। এই ধরনের শক্তি হলদিঘাটের যুদ্ধে জয়লাভ করবে, এই অমৃতকালে তা আশা করাই বাতুলতা। তাই রানা প্রতাপকে জেতাতেই হত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP ASI

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy