মহারাষ্ট্র সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাজ্যে সরকার-পোষিত সমস্ত স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে শিশুদের ‘বেসিক মিলিটারি ট্রেনিং’ দেওয়া হবে। মহারাষ্ট্রের শিক্ষামন্ত্রী দাদা ভুসে গত ৩ জুন এই ঘোষণা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসের সম্মতি নিয়েই এই প্রকল্প তৈরি হয়েছে। শিশু বয়স থেকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা এবং শারীরিক সক্ষমতা তৈরির জন্যই এই প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, ঘোষণা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। রাজ্য জুড়ে স্কুল-ছাত্রছাত্রীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিযুক্ত হবেন আড়াই লক্ষ প্রশিক্ষক। তাঁদের মধ্যে থাকবেন প্রাক্তন সেনাও।
প্রথম শ্রেণিতে একটি শিশুর বয়স থাকে পাঁচ বছর। এই বয়সের একটি শিশুকে সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ‘দেশপ্রেম’-এর তালিম দেওয়ার অর্থ, গোড়াতেই তার মধ্যে একটা কল্পিত শত্রুর ধারণা তৈরি করা। দেশের কোনও এক আপাত-অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সে প্রস্তুত হচ্ছে, এই ধারণা তার মধ্যে একই সঙ্গে একটা ভয়, আর একটা ছদ্ম-বীরত্বের মনোভাব তৈরি করবে। এই কি শিশুর বিকাশের পথ? আমরা কি চাই যে, বিশ্বকে ভাল করে চেনার আগেই আমাদের সন্তানরা যে কোনও দেশ, যে কোনও মানুষকে শত্রু-মিত্র শিবিরে ভাগ করার অভ্যাস রপ্ত করুক? বিশেষত যখন সেই শিক্ষা দেবেন এক জন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী। যিনি নিজের কর্মজীবনে শিখে এসেছেন যে শৃঙ্খলা মানে প্রশ্ন না করা। আদেশ মেনে চলা। সারিতে দাঁড়ানো, এবং কোনও কারণেই তার বাইরে না যাওয়া।
প্রাথমিক স্কুলে প্রবেশ করেছে যে শিশু, তার মনে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে অপার কৌতূহল। তার কল্পনা প্রতি মুহূর্তে ডানা মেলে জানা থেকে অজানায়। বেড়া ভাঙার চাঞ্চল্যই তার স্বাভাবিক। সে সব কিছু দেখতে চায়, জানতে চায়। সেই সময় এই সামরিক শৃঙ্খলা তার চিন্তার বিকাশকে অবরুদ্ধ করবে, এই ভয় থেকে যায়। যে অবাধ কল্পনাকে এই সময় উস্কে দেওয়া জরুরি, মিলিটারি শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ বিপরীত দিকেই নিয়ে যাবে তাকে। মাঠের সামরিক প্রশিক্ষণ যদি তার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, তা হলে ক্লাসেও শিক্ষককে প্রশ্ন করতে, বা অন্য ভাবে ভাবতে ভয় পাবে সে।
শিশুর শরীরচর্চার জন্য ‘ফিজ়িক্যাল এডুকেশন’-এর মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক না নিয়ে প্রাক্তন সেনা নিয়োগ হল কেন, এই প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। তবে কি শিশুর দেশপ্রেম জাগানোর চাইতেও সরকারের কাছে বড় মাথাব্যথা, আড়াই লক্ষ প্রাক্তন সেনাকর্মীর কাজের ব্যবস্থা? কী ভাবেই বা দেশপ্রেম জাগাবেন এই সেনারা, তা-ও কম কৌতূহলের বিষয় নয়।
ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ মনে করেন যে মহারাষ্ট্র সরকার আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পরামর্শক্রমেই এই কার্যক্রম তৈরি করেছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে কিছু কাল আগে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় এবং নবোদয় বিদ্যালয়গুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তারা যেন দেশের সৈনিক স্কুলগুলিকে মডেল ধরে নিয়ে তাদের স্কুলের সিলেবাস এবং পরিচালন পদ্ধতি তৈরি করেন। তাঁদের আরও পরামর্শ ছিল যে ছাত্রছাত্রীদের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সৈনিক স্কুলের মতো দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ও শারীরিক সক্ষমতা অর্জন প্রয়োজন। কিন্তু এই সৈনিক স্কুলগুলির সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের সংযোগ নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ২০২১ সালে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেয় যে, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে একশোটি নতুন সৈনিক স্কুল খোলা হবে। সম্প্রতি ‘তথ্যের অধিকার’ আবেদনের উত্তরে, এবং অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে যে, নতুন স্কুলগুলির পরিচালনার ভার পেয়েছে সে সব সংস্থা, যার অধিকাংশেরই মালিকানা সঙ্ঘ পরিবার অথবা বিজেপির সদস্য, বা সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠের।
মহারাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোথাও সে ভাবে চর্চা হচ্ছে না। অথচ, এই পরিকল্পনা দেশের শিক্ষা ভাবনার গোড়া ধরে টান মারছে। শিশুশিক্ষার গোড়ার কথা শিশুমনকে অনুসন্ধিৎসু করে তোলা। তাকে ভাবতে ও প্রশ্ন করতে শেখানো। সামরিকীকরণ তার সহায়ক কি না, সে বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা চর্চা করলে সমাজ আলোকিত হতে পারত। কিন্তু সবার নীরবতা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে মহারাষ্ট্রের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা দারুণ সাফল্যের সঙ্গে চলছে। অর্থের অভাবে স্কুল বাড়িগুলো ভেঙে পড়ছে। শিক্ষক শিক্ষিকার অভাব, শিক্ষাকর্মীর অভাব, ঠিকমতো বইপত্র দিতে না পারা, এ সব সমস্যা অন্যান্য রাজ্যের মতোই। মহারাষ্ট্র সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের দেওয়া হিসাবে অনুসারে মহারাষ্ট্রের অন্তত ৮৬০০ গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুলও নেই। এই অবস্থায় আড়াই লক্ষ প্রশিক্ষক নিয়োগ করে দেশপ্রেমের পাঠ দেওয়ার টাকা কোথা থেকে আসবে? শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে কাটছাঁট করা হবে না তো?
দেশ জুড়ে এখন ‘দেশপ্রেম’-এর জোয়ার চলছে। ফলে মহারাষ্ট্র সরকারের এই ভাবনা অচিরেই আরও বহু রাজ্য, বিশেষত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সঙ্ঘ পরিবারও অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যকে একই ‘দেশপ্রেমী’ নীতি নিতে পরামর্শ দিতে, বা বাধ্য করতে পারে। তাই মহারাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের কথা বলা জরুরি। প্রাথমিকের শিশুকে সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশপ্রেমের পাঠ দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বিনা প্রতিবাদে কার্যকর হবে, এটাই বা কী করে মেনে নেওয়া যায়!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)