E-Paper

আশঙ্কার রোজনামচা

২০২৩ সালের ৩ মে থেকে শুরু করে গত ২১ মাসে মণিপুরে সামাজিক-রাজনৈতিক-জাতিগত হিংসায় ২৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, বাস্তুচ্যুত এবং গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা অগুনতি। দু

অনিন্দিতা ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:১১
প্রহরী: কেন্দ্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটো করার চেষ্টা, ইম্ফল, ১৪ ফেব্রুয়ারি।

প্রহরী: কেন্দ্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটো করার চেষ্টা, ইম্ফল, ১৪ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।

মণিপুর, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এক ছোট রাজ্য। জাতীয় মিডিয়ার শিরোনামে উঠে আসে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি। মণিপুরের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ পদত্যাগের ৩ দিন পর, ভারতের সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে মণিপুরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়েছে। এই প্রথম বার নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন আরোপ করা ভারতীয় রাজ্যের তালিকায় মণিপুরের স্থান শীর্ষে। স্বাধীনতার পর থেকে মোট এগারো বার তেমন ঘটেছে।

২০২৩ সালের ৩ মে থেকে শুরু করে গত ২১ মাসে মণিপুরে সামাজিক-রাজনৈতিক-জাতিগত হিংসায় ২৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, বাস্তুচ্যুত এবং গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা অগুনতি। দুই প্রধান যুযুধান গোষ্ঠী, ইম্ফল উপত্যকায় বসবাসকারী মেইতেই এবং পাহাড়ের বাসিন্দা কুকি-জোমি-চিন সম্প্রদায়ের মধ্যে শুরুতে সমস্যা হয়েছিল, মেইতেই সম্প্রদায়দের তফসিলি জনজাতি বা এস-টি মর্যাদা পাওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে। তার পর জমি ও সরকারি চাকরিতে অধিকারের প্রশ্নে, জাতিগত ঘৃণা এবং হিংসার মাত্রা এতটা বেড়ে গিয়েছে যে, মণিপুরে পাহাড় আর উপত্যকার বাসিন্দারা দু’ভাগ হয়ে গেছে। অতি প্রয়োজনেও, নিজেদের এলাকা ছেড়ে বেরোনোর কথা কেউ কল্পনা করতে পারছেন না।

জেনিভা-ভিত্তিক সংস্থা ‘অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’-র রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার ৯৭ শতাংশ বাস্তুচ্যুতি, মণিপুরের সহিংসতার ফলে হয়েছে। সংঘাতের কারণে, যেখানে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মোট ৬৯,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, শুধু মণিপুরে গৃহহীন হয়েছেন ৬৭,০০০। মণিপুরে গৃহযুদ্ধের শামিল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি শেষ ২১ মাসে নিয়ন্ত্রণ তো দূরস্থান, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, আহত মানুষ ও নিহতের পরিজনের কান্নার রোল।

এই পরিস্থিতিতে, কফিনে শেষ পেরেকের মতো উঠে আসে ফাঁস হওয়া একটি অডিয়ো ক্লিপ। এতে শোনা গেছে, এন বীরেন সিংহ সরকারি ভান্ডার থেকে অস্ত্রশস্ত্র লুণ্ঠন করতে সম্ভবত মেইতেই সম্প্রদায়ের কাউকে নির্দেশ দিচ্ছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে তৎক্ষণাৎ বার্তা যায়, এই অগ্নিগর্ভ অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে না দিলে মণিপুরে সরকারের পতন হতে পারে। এর পরেই দিল্লি থেকে ফিরে এন বীরেন সিংহ পদত্যাগ করেন।

কিন্তু কেন জাতিগত সংঘর্ষের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হল না? উত্তর খোঁজার জন্য মণিপুরের ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টি খেয়াল করা যাক। মণিপুরের পশ্চিমে অসম, দক্ষিণে মিজ়োরাম এবং উত্তরে নাগাল্যান্ডের সীমান্ত। এ ছাড়া মায়ানমারের সঙ্গে ৩৯৮ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমানা। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে, ভারত সরকার বুঝতে পেরেছিল যে ভারত-মায়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে জনজাতির মানুষদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে, তাঁদের ঐতিহ্যগত জীবনধারা এবং জীবিকা নির্বাহে অসুবিধা হবে। এই ভাবনা থেকে, ১৯৫০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, যার মাধ্যমে, “পাহাড়ি জনজাতি, যাঁরা হয় ভারতের বা বর্মা ইউনিয়নের নাগরিক এবং যাঁরা ভারত-বর্মা সীমান্তের উভয় পাশে ৪০ কিমির মধ্যে যে কোনও অঞ্চলে বসবাসকারী”, তাঁরা ভ্রমণ-নথি ছাড়া এই সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন। এই বিশেষ ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয় ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সীমান্তের ওপারে বসবাসকারী জনজাতীয়দের জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন বজায় রাখার পাশাপাশি সীমান্তের উভয় পাশের মানুষের অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য এই রেজিম চালু রাখা হলেও, অভিযোগ রয়েছে যে কুকি, জোমি, চিন, নাগা, মিজ়ো জনজাতির মানুষেরা এই ফ্রি মুভমেন্ট রেজিমকে ব্যবহার করে গেছেন অস্ত্র, ড্রাগ, কাঠ এবং আফিম চোরাচালানের নেটওয়ার্ককে বজায় রাখার জন্য।

২০২১ সালে মায়ানমারে অভ্যুত্থানের পরে, মায়ানমার থেকে মণিপুরে শরণার্থীদের অভিবাসন রোধের জন্য, সরকার ২০২২-এর সেপ্টেম্বর থেকে ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম স্থগিত করার চেষ্টা করে। এই অঞ্চলে অস্ত্র ও মাদক পাচার, সোনা চোরাচালান নেটওয়ার্কগুলি ধ্বংস করার জন্য, মণিপুর সরকার ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে ‘আন-অ্যাডমিনিস্টার্ড এরিয়া’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সীমানা নির্মাণ, মিজ়ো এবং নাগাদের মায়ানমারে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের থেকে আলাদা করবে, এই যুক্তিতে মিজ়োরাম এবং নাগাল্যান্ড সরকার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার বিরোধিতা করে। এই শেষ ক’মাসে অনেক বার মিডিয়া রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে যে, এই ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম-এর কারণে, ভারত-মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে নাকি ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কুকি যোদ্ধারা ঢুকছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে, ভারত-মায়ানমার সীমান্তে মাত্র ৩৮ কিলোমিটার সীমান্তে এখনও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকি সীমান্ত এখনও খোলা আছে।

এই বিবাদে কুকি-চিন-জোমিদের বক্তব্য ছিল, মেইতেইদের কিছু ছোট ছোট বিচ্ছিন্নতাবাদী দল, রাজ্য সরকারের মদতে নাকি তাঁদের পাহাড় থেকে বিতাড়িত করে, পাহাড়ের জমির দখল নিতে চায়। নাগারা কুকি-বিরোধী, কিন্তু এই সমস্যায় তাঁরা কারও পক্ষ নেননি। মণিপুরের নাগা অঞ্চলে, সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী মেইতেইদের ঢোকার অধিকার নেই। তাঁরা এই অঞ্চলকে বৃহত্তর নাগালিমের অংশ করতে চায়। যেখানে মিজ়ো বা নাগাদের তবু নিজেদের একটা রাজ্য আছে, কুকি-চিন-জোমিদের কাছে চূড়াচাঁদপুর হচ্ছে একমাত্র নিজের জায়গা।

মেইতেইরা চান, মণিপুরে জমি আর চাকরির উপর মূল অধিকার থাকুক তাঁদের। মণিপুরের বাসিন্দা আদিবাসীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক দিক। মণিপুরে শেষ ২১ মাসে যে অস্ত্র ঢুকেছে, তা জোগান দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি থেকে, যাকে ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ বলা হয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। এই দেশগুলিতে খুব সস্তায় অস্ত্র পাওয়া যায়, এরা ড্রাগনেটওয়ার্কের সঙ্গেও যুক্ত। সম্প্রতি নাকি ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি মণিপুরে ড্রোন হামলার পিছনে বিদেশি শক্তির যুক্ত থাকার সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়েছে। তাই মণিপুরে এ বারের সংঘর্ষে দু’রকম পরিপ্রেক্ষিত ছিল বলা যায়। এক, প্রায় দুই ডজন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তাদের স্বাধীন ভূমির দাবিতে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছিল, দুই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল, মেইতেইদের সঙ্গে কুকি-জোমি-চিনের লড়াই। এই সাঁড়াশিচাপের মুখে পড়ে, মণিপুরের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।

এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। মণিপুরের নিজস্ব আর্মড পুলিশ বাহিনী আছে, তার উপর ডেকে আনা হয়েছে আস্যাম রাইফেলস-এর জওয়ানদের। কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরে পাঠিয়েছিল বিএসএফ এবং সিআরপিএফ জওয়ানদের। কাজ হয়নি। রাষ্ট্রপতি শাসন শুরু হলে রাজ্যপাল অজয় কুমার ভল্লা স্বেচ্ছায় অস্ত্র সমর্পণের জন্য এক সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দেন, যা ব্যর্থ হলে ‘অল-আউট অপারেশন’ হবে বলে সতর্কতা জারি করা হয়। এর মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী উপত্যকা এবং পাহাড়ে অভিযান জোরদার করে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে, প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র এবং চোরাই যানবাহন উদ্ধার করে।

এই প্রচেষ্টা ইতিবাচক ভাবেই নিয়েছে কুকি-চিন-জোমিরা, স্বেচ্ছায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইতিমধ্যে সমর্পণ করেছে। বরং, মেইতেই মহিলা জাগ্রত গোষ্ঠী, মেইরা পাইবিসের কর্মীরা ইম্ফল এবং উপত্যকার অন্যান্য অংশে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মশাল মিছিল করে, বিক্ষোভ দেখায়। মণিপুর ঐক্যের সমন্বয় কমিটি, গ্রামের স্বেচ্ছাসেবকরা, যাঁরা নাকি নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন।

প্রশ্ন হল, মণিপুরে ‘সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন’ নামে ‘হাঁসজারু’ গোছের বিধানসভা রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? সে কি এই জন্য যে, বিধানসভা ভেঙে দিলে ছয় মাসের মধ্যে ভোট করতে হবে? বিজেপি নেতৃত্ব কি তা হলে কাশ্মীর মডেলকেই বেছে নিলেন, এই পরিস্থিতিতে মণিপুরে ভোট হলে গদি হাতছাড়া হতে পারে ভেবে?

ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Manipur President Rule

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy