গত কয়েক বছর ধরেই গোটা দেশের পাশাপাশি এ রাজ্যের এঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় দেখা দিয়েছে ভাটার টান। এক বার জয়েন্টের বেড়া টপকে এঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে পারলেই মোটা অঙ্কের চাকরি অথবা যে স্বপ্নের জীবনের ছবি দেখত সমাজ, আজ তা উত্তরোত্তর ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে এই মন্দার বাজারে।
কাজের বাজারে যখন প্রতিকূলতা বাড়ছে, তখন আরও কঠিন হচ্ছে প্রতিযোগিতা। এমন আবহে এ রাজ্যের এঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকার ফল প্রকাশ ও ভর্তিতে এ বারের বেনজির বিলম্ব এই রাজ্যের পড়ুয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্কটকে বাড়িয়ে তুলেছে। ইতিমধ্যে রাজ্যে বিলম্বিত স্নাতক স্তরের ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে। এই বিলম্বের সম্ভাব্য কারণ— আদালতের আদেশে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে সরকারি নির্দেশনামা বাতিল হওয়া। রাজ্যের উচ্চ আদালতের নির্দেশে সেই ভর্তির সংশোধিত নিয়ম জারি হয়েছে। অথচ, জটিলতার সূত্রপাত গত বছর, যখন উচ্চ আদালত পদ্ধতিগত ত্রুটি উল্লেখ করে সংরক্ষণের তালিকা বাতিল করেছিল, শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার অনেক আগেই বিষয়টি বিবেচনা করা যেত। সংরক্ষণ বিষয়ক উচ্চ আদালতের নির্দেশ তো এসেছে প্রায় বছরখানেক আগে। কিন্তু প্রশাসন সে বিষয়ে এত দিন নড়চড়ে বসেনি। এখন এত দেরিতে টনক নড়ার জন্য গোটা ভর্তি প্রক্রিয়াটাই পড়েছে বড় মাপের অনিশ্চয়তার মুখে।
এমন অনিশ্চয়তার আবর্তে পড়ে যখন ঢেঁকি গেলার মতো আদালতের নির্দেশে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় অনলাইন ব্যবস্থায় রাজ্যের সাধারণ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি শুরু করেছে, তখন একই ভাবে এঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের ভর্তিও কেন পাশাপাশি শুরু হচ্ছে না? এমনকি রাজ্য স্তরে এঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট এন্ট্রান্স এগজ়ামিনেশন’ (ডব্লিউবিজেইই) অনেক দিন আগে নেওয়া হলেও, তার ফল এখনও প্রকাশিত হয়নি। পরে হলেও, কোর্সগুলির বহু রাউন্ডের কাউন্সেলিং এবং ভর্তি শেষ হয়ে ক্লাস শুরু করতে পুজোর ছুটি এসে পড়বে। সে ক্ষেত্রে কোর্সের শুরুতেই জাতীয় স্তরের শিক্ষাসূচির তুলনায় তিন মাস পিছিয়ে পড়বে রাজ্যের পড়ুয়ারা।
বুঝতে অসুবিধা নেই, এই অপ্রত্যাশিত বিলম্ব এবং অনিশ্চয়তার আবহে রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উচ্চ ও মধ্য মেধার পড়ুয়াদের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে ভিন রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। পড়ে থাকছে জয়েন্টের সম্ভাব্য সফল উচ্চ মেধার পড়ুয়ারা, যাদের আর্থিক ক্ষমতা সীমিত। অগত্যা জয়েন্টের ফলপ্রকাশের অপেক্ষায় এদের একটা বড় অংশ ভর্তি হয়ে থাকছে সাধারণ স্নাতক কোর্সে। এ বার এদের মধ্যে এঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে সফল পড়ুয়ারা চলে গেলে, স্নাতক স্তরের প্রচুর আসন খালি থেকে যাবে। অত্যন্ত কম সংখ্যক পড়ুয়ার আবেদনের কারণে ইতিমধ্যে এ বছর রাজ্যের স্নাতক স্তরের অনলাইন ভর্তির সময় বাড়াতে হয়েছে। গত বছর রাজ্যে স্নাতক স্তরে মোট পাঁচ লক্ষ এবং রাজ্যের প্রায় ৩৫ হাজার এঞ্জিনিয়ারিং আসনের এক-তৃতীয়াংশ খালি ছিল। সেই নিরিখে এ বারের আসন খালির সঙ্কট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল।
ফলে সরকারি স্তরে ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনার খামতির কারণেই আজ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ পড়ুয়াকে এমন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সরকার-পোষিত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে সাধারণ মানুষের করের টাকায়, সরকারি অনুদানে। যাদবপুরের মতো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে একটা আসনের পিছনে বছরে গড়ে খরচ হয় প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। এমন প্রতিষ্ঠানের ২০ শতাংশ আসন খালি গেলে, আনুমানিক অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক ৩০ কোটি টাকা আর গোটা শিক্ষাক্রমে ১২০ কোটি টাকা। এ দিকে, বেতন বৈষম্যের কারণে যখন গবেষক এবং শিক্ষকদের সিংহভাগ ছুটছেন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে, তখন রাজ্য সরকারের মর্যাদার প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ভাল ছাত্র পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি নীতিপঙ্গুত্বের কারণে। ফলে সরকারি অনুদানের ঘাটতির পাশাপাশি উন্নত মানের পড়ুয়ার ঘাটতিও এ বার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজ্যের বহু সরকার-পোষিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
মনে রাখা দরকার যে, জাতীয় স্তরের প্রবেশিকা ‘জয়েন্ট এন্ট্রান্স এগজ়ামিনেশন (মেন)’ পরীক্ষার পথ পরিহার করে, বহু কেন্দ্রীয় চাপ উপেক্ষা করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ডব্লিউবিজেইই-কে মান্যতা দিয়ে ছাত্র ভর্তি করে এসেছে রাজ্যের পড়ুয়াদের স্বার্থেই। কিন্তু এই ভাবে রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার মান এবং ভর্তি জটে প্রতি বছর এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভর্তি বিলম্বিত হতে থাকলে, ভবিষ্যতে যাদবপুরেও জাতীয় স্তরের প্রবেশিকার ভিত্তিতে পড়ুয়া ভর্তির দাবি ওঠা অন্যায্য কি?
সরকারের উচিত, অবিলম্বে এই বিষয়ে পদক্ষেপ করা। অন্যথায় এই বিলম্বের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে রাজ্যের পড়ুয়াদেরই। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মান এবং ভাবমূর্তিরও। এবং সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিরও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)