Advertisement
০৮ মে ২০২৪
Dengue

ডেঙ্গিতে মৃত্যু এখন ‘স্বাভাবিক’

মৃত্যু বড়ই বেদনার, বিশেষ করে ডেঙ্গিতে শিশু, তরুণদের মৃত্যু। অথচ, আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে, প্রতি বছর পুজোর আগে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যাবে।

এখন এ রাজ্যে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গিতে।

এখন এ রাজ্যে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গিতে।

শ্যামল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২১
Share: Save:

কোভিডে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুমিছিল কিছুই শেখাতে পারল না আমাদের। বছরভর রোগ নিয়ে চরম উদাসীনতা, তার পর হঠাৎ পর পর মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে এলেই চরম আতঙ্ক— সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। মারি নিয়ে ঘর করা বাঙালি এতটাই আধুনিক! অগস্টের শেষ থেকে রাস্তার পিচ খুঁড়ে একের পর এক বাঁশের খুঁটি পোঁতা শুরু হয়ে যায়। একটু বৃষ্টি হলেই খুঁটির গোড়ায় জল জমে। জল জমে সাফ না-হওয়া আবর্জনার স্তূপে, খোলা নালায় ভাসতে থাকা প্লাস্টিকের ব্যাগে, থার্মোকলের থালা-বাটিতে। এই জলে-ফোটা ডিম থেকে বেরিয়ে আসে ‘বাঘ বাহাদুর’-এর দল। সাদা-কালো ডোরাকাটা ‘টাইগার মসকিটো’ ডেঙ্গির বাহকমাত্র। তাকে আবাহন করে নিয়ে আসে শারদীয় উৎসব ঘিরে আমাদের নির্বোধ প্রতিযোগিতা।

বর্ষার সঙ্গে জ্বরের সম্পর্ক বহু যুগ ধরে মানুষ জানে। আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দীতে বর্ষার শেষে কয়েক মাস শ্রমণরা আক্রান্ত হতেন ‘তকমন’ বা জ্বরে। চরক সংহিতাতেও এমন জ্বরের উল্লেখ রয়েছে। ঋক, সাম পেরিয়ে যজুর্বেদে বর্ণাশ্রম প্রথা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট প্রবল। সেখানে জ্বর সাধারণ মানুষের শরীরে ক্রুদ্ধ মহাদেবের রাগের ফল! দু’হাজার বছর পেরিয়ে ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এত উন্নত হলেও, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জ্বরের প্রকোপ প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে প্রতি বছর। এখন এ রাজ্যে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গিতে— তাতে মৃত্যু বাড়ছে— বাড়ছে ম্যালেরিয়াও। চিকুনগুনিয়াও ছড়ায় মশার হুলেই।

যে কোনও মৃত্যুই বড় বেদনার, বিশেষ করে ডেঙ্গিতে শিশু, তরুণদের মৃত্যু। অথচ, আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে, প্রতি বছর পুজোর আগে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যাবে। রাস্তায় প্যান্ডেল বাঁধতে, আলোকস্তম্ভ বানাতে পুরসভার অনুমোদন লাগে না। রাজপথে খানাখন্দ, যত্রতত্র না-বোজানো গর্ত, তা নিয়ে কারও হেলদোল নেই। রাস্তার গর্তে বৃষ্টির জল জমে, জমা জলে দ্রুত লয়ে ডিম পাড়ে মশকবাহিনী। মশার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ভোর আর সন্ধ্যায় পায়ে হুল ফুটিয়ে যায়। এক জন থেকে দশ জনের শরীরে ভাইরাস ছড়ালে রোগ ছড়ানোর দায়টা কার— পথের, মশার, না পাড়ার ক্লাবের?

পাড়ায় রোগ হলেই সমালোচনার লাঠিসোঁটা নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি পুরসভার উপরে। ভুলেও নিয়ম করে সাফ করি না নিজের বাড়ির ছাদের, বা বারান্দার টবে, বালতিতে জমা জল। বাড়ির ময়লা ফেলি যেখানে সেখানে, ফুলদানির জল এক ভাবে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। মাত্র আধ ইঞ্চি জমা জলেও ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার মশা ডিম পাড়ে, বছরভর এ নিয়ে কমবেশি প্রচার চালায় পুরসভার স্বাস্থ্যবিভাগ। বর্ষা এলেই ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গি নিয়ে নানা জায়গায় চোখে পড়ে বড় বড় হোর্ডিং, দেখেও কি দেখি আমরা? জ্বর হলেই, ‘ও কিছু না, ভাইরাল ফিভার’ ধরে নিই। হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করাতে গড়িমসি করেন বহু মানুষ। সেটা তাঁর নিজের জন্য, সেই সঙ্গে সবার জন্য বিপদ ডেকে আনে। এ বছর ভয়ঙ্কর আকার নিতে চলেছে ডেঙ্গি, এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

কোভিডের একের পর এক ভয়ঙ্কর ঢেউ, এতগুলি মর্মান্তিক মৃত্যু চোখের সামনে দেখেও আমরা বুঝলাম না যে, রোগ রুখে দেওয়ার উপায় আমাদের হাতেই আছে, তা প্রয়োগের ইচ্ছা আর উদ্যম থাকা দরকার। এবং সেই উদ্যম বজায় রাখতে হবে সারা বছর, সব কাজে। বড় বড় নির্মাণ করতে গিয়ে একটা এলাকার জলনিকাশি ব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে যায়। যে সব চক্র বৈধ বা অবৈধ নির্মাণ করতে গিয়ে গোটা এলাকার মানুষকে এ ভাবে বিপদে ফেলে, সে সব ঘুঘুর বাসা ভাঙতে মাঝেমাঝে হুঙ্কার দিলে কাজ হয় না। বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে শহরের জলনিকাশি ব্যবস্থার শুধু নয়, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ও নির্দিষ্ট নানা রোগব্যাধি প্রতিরোধের সম্পর্ক গভীর। বেআইনি নির্মাণকে ‘জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ বলে দেখা দরকার পুরসভার।

কোভিডের তাণ্ডব কিন্তু থেমে যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব, প্রতি দিন বিশ্বের নানা দেশে কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, অনেকে মারাও যাচ্ছেন। ভারতে রোগীর সংখ্যা সামান্য কমলেও, নিয়মিত ত্রিশ-বত্রিশ জন নাগরিকের মৃত্যু ঘটছে। ভাইরাস-ঘটিত জটিল রোগগুলো একে অন্যের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত। কোভিডের ভয় স্তিমিত হওয়ার পর থেকে ‘জাতীয় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ নিয়ে শাসকের চোখে আঙুল, কানে তুলো। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’— এই ঘোষণার কথা এখন আর কোনও রাজনৈতিক দল উচ্চারণ পর্যন্ত করে না। স্বাস্থ্যখাতে, বিশেষত জনস্বাস্থ্যে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানো দূরের কথা। স্বাস্থ্যও এখন পণ্য। ‘ফেলো কড়ি, নাও বড়ি’ নীতিতে ধুঁকছেন দেশের কোটি কোটি মানুষ।

রোগ প্রতিরোধে ব্যর্থতার কালো টিকা মাথায় নিয়েই কলকাতা এগোচ্ছে পুজোর ঐতিহ্যের বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়ার উদ্‌যাপনে। পুরস্কার বড় কথা, কিন্তু প্রাণের সুরক্ষা আরও বড়। ডেঙ্গির চিকিৎসায় রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লেটলেট প্রায়শই অপরিহার্য। রোগী বাড়ছে, প্লেটলেটের অভাব দেখা দেবেই। বঙ্গে প্রাক্-উৎসবের অঙ্গ হোক পাড়ায় পাড়ায় রক্তদান শিবির।

স্ত্রীরোগ বিভাগ, আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dengue Death Toll West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE