নোম্যান’স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। কেউ কেউ অশক্ত পায়ে বসে পড়েছেন আলপথে, ঘাসের আড়ালে। পায়ের নীচে মাটি আছে বটে, কিন্তু সরে গিয়েছে জমি— দেশের জমি, বাপ-দাদার জমি।
আগে ছিল যথেচ্ছ ডি-ভোটারের নোটিস, পুলিশের ধরপাকড়। তবু ভরসা ছিল, জেলে যেতে হলেও সে হাজতের ঠিকানা হত অসমেই। সপ্তাহান্তে পরিবারের মানুষ দেখা করতে পারতেন। আদালতে মামলা চালানো যেত। আশা ছিল জামিনের, নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার। কিন্তু এখন তো সোজা সীমান্তপার। রাতের আঁধারে, হাত বেঁধে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে যখন ধাক্কা দিয়ে সীমান্ত-গেটের বাইরে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তার পরে তাঁরা আঁচ করতে পেরেছেন, কী সর্বনাশ ঘটে গেল। আর তো তাঁদের কোনও দেশ থাকল না! এমনকি ‘সদ্য-প্রাক্তন’ দেশের দিকে দৌড়ে যেতে গেলেও চলছে গুলি।
অসম পুলিশ ‘বাংলাদেশি পাকড়াও’ অভিযান শুরু করার পর থেকে ধুবুড়ি, চিরাং, বরপেটা, দরং, মরিগাঁও, কোকরাঝাড়-সহ বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ আসছে, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা পুলিশের ধরপাকড়ের পর থেকেই উধাও। সে দিন অসমের দরং জেলায় ৪২ বছরের মানিকজান বেগমের বাড়ির দরজায় ধাক্কা পুলিশের। কোলে আট মাসের মেয়ে, তবু মানিকজানকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। দুই দিন পরে বাংলাদেশে ‘ঠেলে পাঠানো’ ১৩ জনের ভাইরাল ভিডিয়োতে মেয়ে কোলে মানিকজানের দেখা মিলল।
মরিগাঁও জেলার সরকারি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, ৫১ বছরের খইরুল ইসলাম। ২০১৬ সালে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল বিদেশি বলে চিহ্নিত করেছিল তাঁকে। ২০১৮ সালে হাই কোর্ট সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। তাঁকে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই বছর কাটিয়ে ২০২০-র অগস্টে জামিনে মুক্তি পান। সুপ্রিম কোর্টে তাঁর মামলা এখনও বিচারাধীন। সেই খইরুল ২৪ মে পুলিশ ধরার পর থেকে উধাও। পরে দেখা গেল, বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, “আমি, আমার বাবা-মা সকলেই অসমে জন্মেছি। বাবার নাম ১৯৫১ সালের এনআরসি-তে রয়েছে। অন্যায় ভাবে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আমায় বিদেশি সাজিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। তবু আমায় দেশ থেকে বার করে দেওয়া হল।”
ভিডিয়োতে খইরুলের পাশেই বরপেটার ৫৯ বছর বয়সি সোনা ভানুকে দেখতে পেয়েছে তাঁর পরিবার। ২০১৩ সালে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করে। রায় বহাল রাখে হাই কোর্ট। কিন্তু ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট হাই কোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়। সোনার ভাই আশরফ আলি জানান, ২৫ মে সোনাকে এসপি অফিসে ডেকে পাঠায় পুলিশ। পরের দেখা বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের অভিযোগ, গত মাসে ১২৩৯ জনকে তাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে ভারত। এ নিয়ে ভারতকে ৬টি চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। তাদের প্রস্তাব, যা করা হবে তা যেন গায়ের জোরে নয়, কূটনৈতিক পর্যায়ে, সঠিক পদ্ধতি অনুযায়ী করা হয়। কিন্তু অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলছেন, “বিদেশিদের ফেরানো হবে না কোনও ভাবেই। অবশ্য যাঁদের মামলা চলছে, তাঁদের কথা আলাদা।”
মামলা তো চলছিল অনেকেরই। বিজিবি-ও তাদের দেশে ঢুকতে দেয়নি। খইরুলের ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসার পরে চাপ বাড়ে ভারত সরকারের উপরে। ফলে, পুশ-ব্যাক করা ৬০ জনের বেশি মানুষকে ফেরাতে বাধ্য হয়েছে ভারত। খইরুল, রহিমা বেগম, হাজেরা খাতুন, সোনা ভানুদের মতো অনেকে ফিরেছেন বাড়িতে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন ‘সিটিজ়েনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ জানিয়েছে, অসম থেকে অন্তত ৩৩০ জনকে বাংলাদেশি সন্দেহে ধরা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৪৫ জনের এখনও খোঁজ নেই।
বিরোধীদের দাবি, মুসলিম ভোট বিজেপি পাবে না তা জানেন হিমন্ত। তাই সেই ভোটব্যাঙ্ক বিরূপ হওয়ার আশঙ্কা তাঁর নেই। বরং আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে বহু দুর্নীতি, অভিযোগ, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ধাক্কা থেকে বাঁচতে পুশ-ব্যাক একাধারে হয়ে উঠেছে তাঁর ঢাল ও তরোয়াল। ‘মিঁঞা (বাংলাভাষী মুসলমান) ভোট লাগবে না’ বলে ঘোষণা করা হিমন্ত নিজেকে ‘হিন্দুদের মসিহা’ প্রমাণের মরিয়া চেষ্টায় সংখ্যালঘুদের আকাশে সিঁদুরে মেঘ ছড়িয়ে ঘোষণা করেছেন, “পুশ-ব্যাক থামবে না, বরং বাড়বে।” সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়েছে, অসম সরকার বিদেশিদের শনাক্ত বা বহিষ্কার করতে আর আদালতের অনুমোদন নিতে বাধ্য নয়। জেলাশাসকরাই বহিষ্কারের আদেশ জারি করার ক্ষমতা রাখেন। ফলে, পরিস্থিতি এমন, সংখ্যালঘুপ্রধান এলাকার মানুষ এখন রাতে বাড়িতে পুলিশি হানার আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন। উকিলের দরজায় ঘুরছেন। যদি আগাম কোনও রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা যায়।
সরকার হিসাব দিয়েছে, অসমে শনাক্ত হওয়া বিদেশির সংখ্যা ১,৬৫,৯৯২। তাঁদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ৩০,১১৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পলাতক অবস্থায় আছেন ৮৫,০২৪ জন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সন্দেহভাজন বিদেশিদের আর অনির্দিষ্ট কাল আটকে রাখা চলবে না। কিন্তু তাঁদের পাঠানো হবে কোথায়! তাঁদের তো বাংলাদেশের ঠিকানা নেই। বাংলাদেশ সরকার তাঁদের গ্রহণ করবে না, বলা বাহুল্য। অগত্যা পুশ-ব্যাক। এ দিকে, বিদেশি শনাক্ত করার জন্য ১৮০০ কোটি টাকা দিয়ে, ৬ বছর ধরে যে এনআরসি তৈরির কাজ চলল, তা গত ২০১৯ থেকে হিমঘরে পড়ে আছে। রাজ্য জানিয়েছে, ওই এনআরসি তারা মানে না।
এই সব হিসাব-নিকাশের কথা মাথায় না ঢোকা, বরপেটার গরৈমারির ‘দেশে-খেদানো’ মালেকা বেগম বাংলাদেশের এক পরিবারের আশ্রয়ে বসে কাতর হয়ে ভিডিয়ো-বার্তায় বলছিলেন, “আমি অসমে ফিরতে চাই, ঘরে ফিরতে চাই। আমার স্বামী-ছেলে ওখানে। আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চল...”
ফিরব বললেই ফেরা যায় না কি? আপাতত হারিয়ে গিয়েছে তাঁর, তাঁদের দেশ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)