Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Sri Lanka

ক্রোধ যখন রাস্তায় আছড়ে পড়ে

এক সমৃদ্ধ দেশের দিশা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন রাজাপক্ষে।

নীলোভা রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩৮
Share: Save:

যেহেতু শ্রীলঙ্কার গৌরবের দিনে সে দেশকে দেখার সুযোগ হয়েছে, তাই ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রের আজকের পরিস্থিতি কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছে। তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে খাবার, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সবেতেই টান পড়েছে, কমেছে সে দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা। মানুষের বিক্ষোভ সামলাতে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হচ্ছে, কার্ফু জারি করা হচ্ছে। যাঁরা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী, সেই ক্ষমতাসীনদের গদিচ্যুত করার ডাক উঠেছে। কিন্তু প্রশাসনের অবস্থা এখন এতই অস্থির, সঙ্কটজনক যে, তার সমাধান করার, স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোর দায়িত্ব কেউ নিতে চাইছে না। নেওয়ার ক্ষমতা কারও আছে বলেও মনে হচ্ছে না।

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এমন এক পরিবার থেকে এসেছেন, যাঁরা এলটিটিই-কে মুছে ফেলে তিন দশকের সন্ত্রাসবাদ শেষ করেছিলেন, যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসবাদী অশান্তিকে শেষ করা, এক সমৃদ্ধ দেশের দিশা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন রাজাপক্ষে। সিংহল আধিপত্যবাদের ঢেউয়ের চূড়ায় বসে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া নিজের বড় ভাই মহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেন, এবং স্বজনপোষণের এক ভয়ানক নিদর্শন দেখিয়ে নিজের আরও দুই ভাই চামাল এবং বাসিলকে মন্ত্রিত্বের আসনে বসান। আমেরিকার নাগরিক বাসিল বসেন অর্থমন্ত্রীর পদে। রাজাপক্ষে পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার এগারোটা মন্ত্রক ভাগ করে নেন।

এই জন্যই অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘোরালো হয়ে উঠতে তার দায় সরাসরি রাজাপক্ষে পরিবারের উপরে বর্তাচ্ছে, অস্বীকারের কোনও উপায়ই থাকছে না। ভোটাররা দেশের নেতাদের থেকে কৈফিয়ত দাবি করছেন, আর্থিক সঙ্কটের নিরসনও চাইছেন। রাজাপক্ষেরা বরাবরই দেশের মানুষের থেকে বিপুল সমাদর, সমর্থন পেতে অভ্যস্ত, আজ তাঁরা পড়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে। আজ তাঁদের দেশবাসীকে দেওয়ার মতো কোনও উত্তর নেই।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকারেরই অনেকগুলি ভুল সিদ্ধান্তের ফলে এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। রাসায়নিক সার বন্ধ করে সম্পূর্ণ জৈব চাষে যাওয়ার ফলে ফসল উৎপাদন মার খেয়েছে, দেখা দিয়েছে কৃষির সঙ্কট। একই সঙ্গে করোনা অতিমারির জন্য পর্যটন শিল্প থেকে রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারের হাতে আর বিদেশি মুদ্রা অবশিষ্ট নেই। ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়েছে জাতীয় মোট উৎপাদন বা জিডিপি-কে। জোটসঙ্গীদের একটা বড় অংশের পদত্যাগের পরে রাজাপক্ষেরা ক্রমশ আরও কোণঠাসা, সহায়হীন হয়ে পড়ছেন। এখন তাঁদের ‘গো গোতা গো’ স্লোগান শুনতে হচ্ছে, সরকারের দায়িত্ব নিতে কেউ এগিয়ে আসছেন না।

প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই আর্থিক বিপর্যয় ভারতের জন্য কী অর্থ বহন করছে? বস্তুত তা ভারতের সামনে একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে— অতিমারির পর দক্ষিণ এশিয়াতে প্রাধান্য ফিরে পাওয়ার সুযোগ। তাই কলম্বোর ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে দিল্লি উদ্যোগী হয় প্রতিবেশী দেশটির সহায়তায়। এ বছর ভারত কলম্বোকে আড়াই বিলিয়ন আমেরিকান ডলার দিয়েছে খাদ্য ও জ্বালানির জন্য, ঋণ খেলাপের লজ্জা থেকে বাঁচার জন্যও। এই প্রতিবেশিতা হয়তো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করবে, কিন্তু ভারতকে এ-ও দেখতে হবে যে, এই সহায়তা যেন রাজাপক্ষেদের বাঁচানোর চেষ্টা বলে না দেখা হয়। রাজাপক্ষে পরিবার চিনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ভারতের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বার্থরক্ষায় শ্রীলঙ্কার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনের ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গন থেকে শ্রীলঙ্কাকে সরিয়ে আনাই ভারতের আশা।

যদিও ভারত উপকারী বন্ধুর ভূমিকা নিতে চায়, তবু পরিস্থিতির মধ্যে বেশ কিছু স্ববিরোধ থেকে গিয়েছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকে গোতাবায়া খোলাখুলি নিজের সিংহলী পরিচিতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্ব অংশের তামিলদের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও কাজের বেলা তা হয়নি। ২০১৯ সালের ইস্টারে সন্ত্রাসী হানার পর মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপর বৌদ্ধ সিংহলীদের আক্রমণে তেমন কোনও লাগাম টানা হয়নি।

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি ভারতের প্রশাসকদের জন্যেও বার্তা বহন করে না কি? সংখ্যাগুরুর অবাধ আধিপত্য কায়েম করেও দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির জন্য বাহুবলী নেতাদের প্রতি জনরোষ আটকানো যায়নি। শ্রীলঙ্কায় বন্দরের মতো জাতীয় সম্পদ বিক্রি করা, বিপুল ঋণের বোঝা তৈরি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। ভারতের ঋণের সঙ্গে জিডিপি-র অনুপাত ইতিমধ্যেই পঁচাশি শতাংশ ছাড়িয়েছে। ভারতে যে ভাবে দ্রুত বাড়ছে খাবার আর পেট্রল-ডিজ়েলের দাম, তাতে সেই দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে অচিরেই সীমা ছাড়িয়ে যাবে। আর তখন মানুষের ক্রোধ আছড়ে পড়বে রাস্তায়— কলম্বো সেই বার্তাই দিচ্ছে দিল্লিকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sri Lanka Sri Lanka Crisis gotabaya rajapaksa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE