Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
teenage marriage

‘সব করোনার প্রোডাক্ট!’

সরকারি আবাস প্রকল্পের ‘এনকোয়ারি’ চলছে পুনর্ভবার তীরে। মহাভারতে উল্লিখিত নদীর পাশে এই গ্রাম। মাঘী পূর্ণিমার আলপনা ঘরে ঘরে।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:০০
Share: Save:

তালাবন্ধ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের বারান্দায় বসে জাবর কাটছিল এক ছাগল। সেন্টারের চাতালে শুকোতে-দেওয়া শাড়ি তুলতে আসা কিশোরী মেয়েটি মনে করতে পারল না, শেষ কবে এখানে দিদিমণিরা এসেছে। সে মেয়ের কপাল জুড়ে সিঁদুর। পিছন পিছন ছুটে এসেছে দুই ছেলে। মায়ের বয়স কত? পনেরো। জ্যেষ্ঠপুত্রের দুই। কনিষ্ঠটির এক। অর্থাৎ, মা আর দুই ছেলের বয়স জুড়ে দিলে তবে মা সাবালক।

সরকারি আবাস প্রকল্পের ‘এনকোয়ারি’ চলছে পুনর্ভবার তীরে। মহাভারতে উল্লিখিত নদীর পাশে এই গ্রাম। মাঘী পূর্ণিমার আলপনা ঘরে ঘরে। উলু পড়ছে মাঝে মাঝে। উৎসবমুখর গ্রামে কে বলবে কোন পাকা বাড়ি থাকার কথা, কিন্তু নেই? কাগজে সই চাইলেই সব ঘর কলম ফেলে টিপছাপ দিয়ে যাচ্ছে। খালি পায়ে ছুটে এল এক শিশু। দাঁতে জোর দিয়ে কলম চিবোচ্ছে। বলল, পড়ালেখা নেই, বই ইঁদুর কেটে শেষ। পড়া বন্ধের আনন্দে নাচতে থাকে ডুমুর সোরেনের নাতি। বাঁশের ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, হাজার ছক্কা মারবে। নদীর ও পারে স্কুল। ব্রিজ নেই, মাঝির জ্বর, তাই স্কুলে যাওয়া বন্ধ। জানা গেল, মাঝে মাঝে এক দিদিমণি এ পারে সাঁতরে স্নান করতে এলে পড়িয়ে যান, মাসে একশো টাকার বিনিময়ে। কী পড়ে? কোনও বই নেই। সব মুখে মুখে।

আশ্চর্য এই গ্রামের উঠোনে এক মা আর মেয়ে এক সঙ্গে পুতুল খেলছিল। খানিক চেয়ে থেকেও বোঝার উপায় নেই, কে মা, কে মেয়ে। এক বাড়িতে খিদেয় বাচ্চা কাঁদছে। মা কই? কুল পাড়তে গিয়েছে। নাবালিকা মায়ের বাচ্চার যত্ন নেবে কে? বিকাশ কেন্দ্র তো নামেই। এ যুগেও এক গ্রামের একশো ঘরের কোনওটার মাথায় পাকা ছাদ নেই। সব মাটির বাড়ি, টিন বা খড়ের চাল। মনে হয় যেন কোনও চাপাপড়া সভ্যতাকে মাটি খুঁড়ে তুলে এনেছে কেউ। যেখানে সব কিছুই যেন বেমানান।

খাতায় গৃহহীন একশো উপভোক্তার নাম দেখে দুর্নীতি রুখতে ছুটে এসেছেন সরকারি আধিকারিক। থমকে গিয়েছেন গ্রামে ঢুকে। আবাসের টাকা ঢুকবে কোথায়? দিনখাটা মজুর হরতন কিস্কু বলেন, টাকা নেই তাই ব্যাঙ্কের বইও নেই। বয়স কত আপনার? জানি না। গোটা গ্রামের কেউ নাকি জানে না তাদের বয়স। আধিকারিক বোঝেন, বয়স বলতে সবার ভয়। মেয়ের ভয়, মায়ের ভয়, বাবার ভয়। কারণ ঘরে ঘরে ছেলেরা পনেরো-ষোলোর মেয়ে বিয়ে করে এনেছে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর রিপোর্ট বলছে, বিগত পাঁচ বছরে নথিবদ্ধ মোট নাবালিকা বিবাহের প্রায় অর্ধেকই ঘটেছে ২০২০ সালে। পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে এ অপমানের ব্রোঞ্জ মেডেল (সোনার মেডেল গিয়েছে কর্নাটকে)। এই অখ্যাত গ্রামের একশো ঘরের অর্ধেক ঘরেই কচিমুখের কপালে সিঁদুর, হাতে শাঁখাপলা। সদ্য মুম্বই-ফেরত তরুণ শাটারিং মিস্ত্রি জানালেন, “স্যর, সব করোনার প্রোডাক্ট!” পাশের গ্রামের বাবা-মায়েরা নাকি পঞ্জিকাই দেখেননি। মলমাসেও মেয়েকে নিঃশব্দে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন বেয়ানবাড়ি, কাকপক্ষীতেও টের পায়নি, সরকারি কর্তারা তো দূরের কথা। খবরে যে ক’টা বেরিয়েছিল, ব্লক অফিসের নথিতে ছিল। বাকিগুলোর কথা রাষ্ট্র জানে না। শোনা গেল, বিনাপয়সায় মেয়ে বিদায়ের পর করোনার নামে ফুলবাতাসাও ভাসিয়েছেন নদীতে কেউ কেউ। এই কঠিন সময়ে শুধু শাঁখা আর সিঁদুরেই মেয়ে পার করতে পারা, ভাবা যায়?

নদীর ধারে বাস, দুঃখ বারোমাস। অনেক ঘর ঘোরার পরে এক উঠোনে বই দেখে আশা জাগে। শ্বশুর-শাশুড়ি সর্ষে মাড়াই করতে গিয়েছেন। তাঁদের নাম মিলল, সরকারি খাতার লেখাজোখার সঙ্গে। খাতায় যা মেলে না, তা হল তরুণী বধূর গল্প। তার তিন কন্যাসন্তান জন্মেছে— গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী। তিন মেয়ের বোঝা বইতে নারাজ স্বামী পালিয়েছে গত শ্রাবণে। তুলসীতলার পাশেই দোলনায় ছোটটা দুলছে। একটা কোলে। অন্যটা কোথায় কে জানে?

দুর্দশার বিবরণে বিকেল গড়ায়। থোকা থোকা অতসীফুলের পাশে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে মনসা মুর্মু। গ্রামের সবার সরকারি নথি, চিঠি পড়ে বুঝিয়ে দেওয়ার একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। যেখানে সকাল-সন্ধ্যায় ভিড় অপেক্ষা করে রোজ। শিক্ষাগত যোগ্যতা? কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম তিন দিন। চার দিনের মাথায় চার হাত এক হল। কলেজের পড়ালেখা বন্ধ হল, কিন্তু সূর্য ডুবলে গ্রামে বসে যায় এক সান্ধ্যস্কুল। যেখানে ‘মনসা ম্যাম’-এর কাছে নাম লেখা, নামতা শিখতে আসে আস্ত পাড়া। স্কুলছুট শিশুরা সুর মিলিয়ে ছড়া পড়ার চেষ্টা করে। ক’দিন আগেই মেম্বার শাসিয়ে গিয়েছেন। বেশি বাড়িস না মনসা। ভোটে দাঁড়ালে ঠ্যাং ভেঙে দেব। মনসা রোজ রাস্তায় তাকিয়ে থাকে। যদি বর ফেরে।

আধিকারিকের তদন্ত শেষ। গাড়ির জানলা থেকে দেখা যায়, মনসার উঠোন জুড়ে শীতলপাটি। একে একে জ্বলে উঠছে লণ্ঠন। দেশের সব স্কুল বন্ধ হলে খুলে যায় এ স্কুল। চাঁদের আলোয় এক সাঁওতাল সরস্বতী, যার মন্ত্র নেই, অঞ্জলি নেই। এক এক জন সাক্ষর মানুষই যেন তার পুষ্পপাত্রের এক একটি পলাশফুল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

teenage marriage NCRB West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE